Showing posts with label জনসংখ্যা রাজনীতি উন্নয়ন. Show all posts
Showing posts with label জনসংখ্যা রাজনীতি উন্নয়ন. Show all posts

উদ্বাস্তু কী? উদ্বাস্তু একটি বৈশ্বিক মানবিক সমস্যা

উদ্বাস্তু কী বর্তমান বাস্তবতার আলোকে আলোচনা

ভূমিকা:- মানুষের ভাগ্য অনুসন্ধানের প্রবণতার কারণে একা বা দল বেঁধে মানুষ এক দেশ থেকে অন্য দেশে যায়। মহামারি, যুদ্ধ, রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা ইত্যাদি কারণে মানুষ দল বেধে স্থানান্তর হয়। বিভিন্ন প্রাকৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণে মানুষ নিজের দেশ ত্যাগ করে অপর কোনো দেশে আশ্রয় গ্রহণ করে বা এক দেশ থেকে অন্য দেশে ভাসমান অবস্থায় অবস্থান করে তাদেরকে উদ্বাস্তু  বলে।

উদ্বাস্তু কী? উদ্বাস্তু একটি বৈশ্বিক  মানবিক সমস্যা

 

উদ্বাস্তুঃ উদ্বাস্তু (Refugee) হল এমন ব্যক্তি, যিনি "বাস্তবভিত্তিক ভয়"–এর কারণে তার নিজ দেশ ছাড়েন—জাতি, ধর্ম, রাজনৈতিক মত, সামাজিক গোষ্ঠী কিংবা মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে । ২০২৪ সালের শেষ পর্যন্ত ৪২.৭ মিলিয়ন উদ্বাস্তু এবং মোট ১২৩.২ মিলিয়ন (অন্তর্বাসী, আশ্রয়প্রার্থীসহ) মানুষ কিছু না কিছুভাবে এলাকা‑পরিবর্তনকারী হিসেবে রয়েছেন। 


উদ্বাস্তু একটি বৈশ্বিক মানবিক সমস্যা-

১। ফিলিস্তিন উদ্বাস্তু সমস্যা: ভাগ্যর নির্মম পরিহাস ফ্যাসিবাদের হাতে তাড়া খেয়ে ইহুদি জাতিই পরবর্তীতে সৃষ্টি করে পৃথিবীর এক ভয়াবহ সমস্যা উদ্বাস্তু সমস্যা। ১৮ এবং ১৯৪৮ ও ১৯৬৭ এর সংঘাতের পর, ৫.৬ মিলিয়নেরও বেশি ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তু আজও বিভিন্ন ক্যাম্প ও আশ্রয়ে রয়েছেন—বিশেষ করে যর্ডান, লেবানন, সিরিয়া, গাজা ও পশ্চিম তীরে ।

২। আফগানিস্তান উদ্বাস্তু সমস্যা: ১৯৭৯ সালে আফগানস্তানের ৩০ লক্ষ লোক উদ্বাস্তু হয়ে আশ্রয় নেয় ইরান ও পাকিস্তানে। ২০২৩‑এ প্রায় ৩.২ মিলিয়ন অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু (IDPs) এবং ৬.৪ মিলিয়ন আফগান উদ্বাস্তু যে অন্যান্য দেশে আশ্রয় নিয়েছেন—অধিকাংশই ইরান ও পাকিস্তানে । ২০২৫‑এ প্রায় ৬ মিলিয়ন অধরা আফগান উদ্বাস্তু অন্তর্ভুক্ত আছে; একই সময় আফগানিস্তান থেকে তাদের প্রত্যাবর্তন, পুনর্মিলন মানবিক ও নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। 


৩। ইরাক উদ্বাস্তু সমস্যা: ২০০৭‑এ প্রায় ৪ মিলিয়ন ইরাকি উদ্বাস্তু (বিদেশি ও অভ্যন্তরীণ) ছিল; ২০০৭‑এ ২ মিলিয়ন ইরাকি অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু, আর ২ মিলিয়ন দেশের বাইরে। ২০২৪‑এ উন্নতি আসলেও এখনও ১.১৪ মিলিয়ন অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু রয়েছেন। 


৪। মায়ানমার (রোহিঙ্গা) উদ্বাস্তু সমস্যা: ১৯৯১ সালে বর্মি সরকার পরিচালিত অপারেশন নিয়ে যাবার ফলে প্রায় তিন লক্ষ রোহিঙ্গা মুসলিম শরণার্থী বাংলাদেশে অবস্থান করে। ২০১৭ সালের গণহত্যার পর থেকে, বাংলাদেশে ২০১৮ সালপ  ৭২৩,০০০+ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছেন।  আরও সম্প্রতি, ১ মিলিয়নেরও বেশি রোহিঙ্গা এখন কোক্সবাজারে অবস্থান করছেন; গত ১৮ মাসে প্রায় ১৫০,০০০ নতুন আগমন ঘটেছে । এছাড়া, ২০২৫‑এ বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ ও উদ্বেগ রয়েছে। 

৫। তিব্বত উদ্বাস্তু সমস্যা: তিব্বতের স্বাধীনতাকামীরা ১৯৫৯ সালে চীন থেকে স্বাধীন হওয়ার আন্দোলন চালাই ফলে চীন সরকারের নিপীড়ন হতে রক্ষা পেতে ১ লক্ষ তিব্বতীয় ভারতে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়।২০০৯ সালের তথ্য অনুযায়ী, ১৫০,০০০ তিব্বতি উদ্বাস্তু (ডায়াস্পোরা) বিভিন্ন দেশে অবস্থান করেন, তার মধ্যে ভারতে ৯৪,২০৩, নেপালে ১৩,৫১৪ এবং বাকি পৃথিবীজুড়ে ।

৬। কাশ্মীর উদ্বাস্তু সমস্যা: ভারতের শোষণ ও শাসনের অবসান ঘটানোর জন্য কাশ্মীরের মুসলিম জনগণ স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করে যার ফলে ভারত সরকার সেনাবাহিনী দ্বারা নির্যাতন করলে তারা উদ্বাস্তু হয়ে পাশ্ববর্তী দেশ পাকিস্তানে আশ্রয় নেয়।

৭। বাংলাদেশ উদ্বাস্তু সমস্যা: ১৯৭১ সালে  স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে বাংলাদেশের প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ উদ্বাস্তু হিসেবে ভরতে আশ্রয় নেয়। 

৮। সোমালিয়া উদ্বাস্তু সমস্যা: সোমালিয়া ও ইথিওপীয়র বিরোধের ফলে উদ্বাস্তু সৃষ্টি হয় এবং কয়েক লক্ষ সোমালিয়া অন্যদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়।


উপসংহার: বিশ্বব্যাপী ৪২.৭ মিলিয়ন উদ্বাস্তু, ১২৩.২ মিলিয়ন অপহ্রস্ত ব্যক্তি রয়েছে, যাদের পুনর্বাসন ও নিরাপতি মানবিক-আইনগত গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ । ফিলিস্তিন, আফগানিস্তান, ইরাক, মায়ানমার (রোহিঙ্গা) ও তিব্বতের সংকট সবচেয়ে গুরুতর এবং দীর্ঘস্থায়ী। বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু নয় একটি নির্দিষ্ট দেশভিত্তিত উদ্বাস্তু সমস্যা, তবে তা আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বজুড়ে আশ্রয় ও সমাধানের দ্রুত প্রয়োজন রয়েছে

ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড কি? বাংলাদেশ কীভাবে এর সুফল পেতে পারে?

ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড কী এ বাংলাদেশ কীভাবে সুফল পেতে পারে 

ভূমিকাঃ- ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড হলো কোন দেশের কর্মক্ষম জনসংখ্যা।  বিশেষত, যখন কর্মক্ষম জনসংখ্যার (সাধারণত ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী) হার, অপেক্ষাকৃত কম নির্ভরশীল জনসংখ্যার (১৪ বছর বা তার কম এবং ৬৫ বছরের বেশি) হারের চেয়ে বেশি থাকে। সহজ কথায়, একটি দেশের কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা যখন নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যার চেয়ে বেশি হয়, তখন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড আসে

ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড কী


ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড (Demographic Dividend) হলো কোন দেশের জনসংখ্যার বয়স কাঠামো যা ১৫-৬৪ বছর বয়সি জনসংখ্যা আধিক্য যার কাঠামোগত পরিবর্তনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সম্ভবনা তৈরি হয় । যখন এই কর্মক্ষম জনসংখ্যা দেশের মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশ বেশি থাকে তখন ঐ দেশে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড হয়। মনে করা হয়, এ জনসংখ্যা কোন না কোনভাবে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখে। ইউএনডিপির প্রতিবেদন অনুযায়ী বর্তমানে বাংলাদেশে কর্মক্ষম জনশক্তি ১০ কোটি ৫৬ লাখ যা মোট জনসংখ্যা ৬৬ শতাংশ। ২০৩০ সালে দেশে কর্মক্ষম লোকের সংখ্যা আরো বেড়ে দাঁড়াবে ১২ কোটি ৯৮ লাখ ২০৫০ সাল নাগাদ এ সংখ্যা ১৩ কোটি ৬০ লাখে উন্নতি হবে।

বাংলাদেশের ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড এর সুফল পাওয়ার উপায়সমূহ-

১। সঠিক পরিকল্পনাঃ কর্মক্ষম মানুষকে কাজে লাগাতে প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা। যদি সঠিকভাবে মাস্টার প্লান করে প্রতিটি সেক্টর নিয়ে চিন্তা করে এলাকা ভিত্তিক দক্ষ লোক গড়ে তোলা যায়, কারিগরি শিক্ষার প্রসার করা যায়, হাতে কলমে শিক্ষার মাধ্যমে বিপুল জনসংখ্যা কে মানবসম্পদে পরিণত করা যায় তবেই দেশ সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাবে। 

২। যুগোপযোগী শিক্ষা ও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাঃ স্বল্প সম্পদ ও নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যে জনসংখ্যা এখন এদেশের সম্পদ ও সম্ভাবনার বড় জায়গা। এই জনসংখ্যাকে যুগ উপযোগী শিক্ষা প্রয়োজনীয় ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াবে। যেভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে চীন। এই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্টকে কাজে লাগিয়ে দেশটি আজ অর্থনীতিতে রাজত্ব করছে। 

৩। পদক্ষেপ, পলিসি ও প্লানিং  এর সমন্বয় সাধনঃ বাংলাদেশের জনসংখ্যা বেশি হলেও তা এখন দেশের জন্য আর্শিবাদ হয়ে দেখা দিয়েছে। সত্যিকারের সোনার বাংলা গড়ার এক অপূর্ব সুযোগ তৈরি হয়েছে। এখনই যদি আমরা এই তরুণ কর্মক্ষম জনসংখ্যা কে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারি তবে দেশের অর্থনীতির অল্প দিনে ঘুরে দাঁড়াবে।  কিন্তু তার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ, পলিসি নিতে হবে  তাদের নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি প্ল্যানিং করতে হবে। সর্বোপরি গৃহীত প্ল্যানিং অনুযায়ী সঠিক পদক্ষেপ নিতে হবে সময়ের মধ্যে।

৪। সকলের জন্য কর্মসংস্থানের সুব্যবস্থাঃ দেশের ১৬ কোটি জনগণের মধ্য প্রায় ১১ কোটি মানুষ কর্মক্ষম যাদের বয়স ১৫ থেকে ৬৪ এর মধ্যে। এই ১১ কোটির মধ্যে যাদের বয়স 15 থেকে 29 বছর এমন তরুণ প্রয়োজনম আছে প্রায় চার কোটি। তরুণদের বয়স যদি ৩৬ পর্যন্ত ধরি তবে তাদের সংখ্যা বেড়ে হবে সাড়ে ৫ কোটি। এদের কেউ কাজে ঢুকছে ও ঢুকবে। এছাড়া প্রায় এক কোটি ৩০ লাখ যুবক আছে যারা কোন কাজ করে না, কাজের প্রশিক্ষণও নেয় না সম্পূর্ণ বেকার।  কিন্তু এরা সবাই কর্মক্ষম। এই কর্মক্ষম সকলেই দেশের প্রবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতে সক্ষম যদি তাদের সকলকে কাজের মধ্যে আনা সম্ভব হয়। তার জন্য প্রয়োজন সকলের যার যার দক্ষতা ও মেধা অনুযায়ী কর্মক্ষেত্রের সুব্যবস্থা।আতা অতি দ্রুতার সাথে করতে হবে সরকারকে।

৫। সময় উপযোগী শিক্ষানীতি প্রণয়নঃ জনসংখ্যা কে কাজে লাগাতে হলে খুবই প্রগতিশীল ও সময় উপযোগী শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতে হবে, যেখানে শ্রম সংশ্লিষ্ট কাজের কথা বলা থাকবে, নৈতিকতার শিক্ষার উপর জোর দেওয়া হবে, উচ্চশিক্ষার কথা বলা থাকবে।  উচ্চ মাধ্যমিক থেকে কারিগরি শিক্ষার নিম্ন ব্যবস্থা করতে হবে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত যদি কেউ লেখাপড়া না করে সেও বেশ দক্ষতা অনুযায়ী একটি কর্ম বেছে নিতে পারে। আর যারা পড়বে লেখাপড়া শেষ করে বেকার জীবনে না পড়ে থাকে তার জন্য তাদের মেধা কে কাজে লাগানোর জন্য প্রয়োজনীয় কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। কর্মক্ষম, শিক্ষিত বা অশিক্ষিত একজন মানুষের একটি শ্রম ও যেন অপচয় না হয় সেদিকে লক্ষ্য রেখে কাজের পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্য রেখে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়ন  করতে হবে।

৬। বাজেট বৃদ্ধিঃ শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও যুব উন্নয়ন খাতে বাজেট বাড়াতে হবে এবং কেবল বরাদ্দ করে বসে থাকলে হবে না শতকরা হার যথাযথভাবে ব্যয় হচ্ছে কিনা তার পরিকল্পনা ও নজরদারিতা বাড়াতে হবে। আমাদের লেভার ইনসেন্টিভ মার্কেট (শ্রম বাজার) থেকে ক্যাপিটাল ইনসেন্টিভ মার্কেটের (পুঁজিপ্রবণ বাজার) দিকে যেতে হবে৷ যার ফলে আমরা পরিকল্পিতভাবে শিল্পায়নের দিকে যেতে পারবো। একই সঙ্গে দক্ষ জনশক্তি ও তৈরি হবে এবং তার ফলে প্রচুর পরিমাণ দক্ষ শ্রমিক ইউরোপ আমেরিকার বাজারে পাঠাতে পারবো। 

৭। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠাঃ বাংলাদেশে এখন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড এর গোল্ডেন পিরিয়ড চলছে। ২০০৭ সাল থেকে বাংলাদেশের তরুন ও কর্মক্ষম লোকের সংখ্যা বাড়ছে। এটি ২০৪০ আজ পর্যন্ত থাকবে। এই সময়ে মোট জনসংখ্যার বেশিরভাগ হবে তরুণ ও কর্মক্ষম মানুষ। তাই এই ৩৩ বছরই নির্ধারণ করবে ভবিষ্যৎ আমাদের দেশের অবস্থা কেমন হবে।কিন্তু এর পথে যদি রাজনৈতিক অস্থিরতা বাধা হয়ে দাঁড়াই, বিশৃঙ্খলতা কেড়ে নেয় আমাদের স্বর্ণ সময়ের তেত্রিশ বছর তবে এই দেশ পিছিয়ে যাবে উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা থেকে হাজারগুণ বেশি গতিতে। কাজে আমাদের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনয়ন অত্যন্ত জরুরী। 

৮। কৃষির আধুনিকায়ন ও উন্নয়নঃ বাংলাদেশ কৃষি নির্ভর দেশ। এদেশের মোট জনসংখ্যার সিংহভাগ এখনো কৃষিতে নিয়োজিত। যদি দেশের কৃষিকে আধুনিকায়নের মধ্যে আনা সম্ভব হয় তবে অধিকসংখ্যক কর্মক্ষম মানুষ যথাযথভাবে তাদের শ্রম বিনিয়োগ করতে পারবে। কৃষিতে সেজন্য ইতিবাচকভাবে দেখার সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশ শ্রম ভিত্তিক শিল্পের বিকাশ লাভ করছে। যেমন- গার্মেন্টস শিল্প। আমাদের কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক উন্নয়ন করতে গেলে কৃষিতে শ্রমের বিনিয়োগের ব্যবস্থা করে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে হবে। শিল্পের উন্নয়নে আরো গতিশীলতা আনয়ন করে সকল কর্মক্ষম জনগণকে শ্রমের বিনিয়োগ করার পটভূমি প্রস্তুত করতে হবে।

উপসংহারঃ তরুণরাই রাষ্ট্রের প্রাণশক্তি । তাদের যত বেশি কাজে লাগানো যাবে তত বেশি দেশ অগ্রসর হবে। পৃথিবীর বহু দেশ এই তরুণদের কাজে লাগিয়েই উন্নত রাষ্ট্রের কাতারে পৌঁছে গেছে । বর্তমানে বাংলাদেশের চলছে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্টের স্বর্ণ সময়।এটা কোন জাতির মধ্য দীর্ঘ প্রতীক্ষার, দীর্ঘ সময়ের পরে আসে। বাংলাদেশের ২০৪০ সাল পর্যন্ত এই সুযোগের সময় কর্মক্ষম ব্যক্তির আধিক্য সময় চলবে। তাই এই সময়কে যেভাবেই হোক যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে জাতিকে অর্থনৈতিক পরাশক্তিতে পরিণত করতে হবে

শ্রমবিভাজন ও জেন্ডার বৈষম্যকরণের সম্পর্ক আলোচনা

শ্রম বিভাজন ও জেন্ডার বৈষম্যকরণের সম্পর্ক

ভূমিকাঃ- মানবজাতি দুটি ভাগে বিভক্ত। তার এক অংশ হচ্ছে পুরুষ ও অপর অংশ হচ্ছে নারী।জেন্ডার ভূমিকাঃ নারী-পুরুষের প্রতি সামাজিক প্রত্যাশার প্রতিফলন। যেটা সাপেক্ষ, যেটা যথোপযুক্ত ভাবে নারী পুরুষের আচরণ কার্যাবলী কে তুলে ধরে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ আমরা কঠোরতা বলতে ম্যাসকুলিন বা পুরুষকে বুঝি আবার কোমলতা বলতে নারীর ভূমিকা কি বুঝি। অর্থাৎ জেন্ডার ভুমিকা হল নারীত্ব ও পুরুষত্বের সামাজিক প্রকাশ।

শ্রমবিভাজন ও জেন্ডার বৈষম্যকরণের সম্পর্ক


শ্রমবিভাজন ও জেন্ডার বৈষম্যকরণ- নিম্ন শ্রম বিভাজনের সাথে জেন্ডার বৈষম্যকরণের কিছু উল্লেখযোগ্য সম্পর্ক তুলে ধরা হলো। 

১। শ্রম ও কর্মকর্তাঃ আধুনিককালে বিভিন্ন দেশের নারীগণ বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে শ্রমিক ও কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করে। এর মধ্যে গার্মেন্টস শিল্পে নারীদের একাধিপত্য রয়েছে। এ শিল্পে তারা শ্রমিক হিসেবে ব্যাপকভাবে কাজ করে। কিন্তু অন্যান্য দেশের তুলনায় তারা অনেক কম বেতন পায় এমনকি অনেক সময় পুরুষ সহকর্মীকে পদন্নোতি দেওয়া হয় এটা জেন্ডার বৈষম্যর ফল।

 ২। বিমানের পাইলটঃ আধুনিক কলেজ জেন্ডার বৈষম্য বাঁধা থাকলেও অনেক নারী বিমানের পাইলট হিসেবে কাজ করে।  তবে সেখানে তাদের উপস্থিতি অত্যন্ত সীমিত। অপরদিকে  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তাদের এ সংখ্যা বেশি সংখ্যক দেখা যায়। অনেক দেশে এ পেশায় নারীর উপস্থিতি সরব নয়। এটা জেন্ডারের বাধা অতিক্রমণের দৃষ্টান্ত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নারীদের সংখ্যা ২০০৩ সালে ছিল ৫% এবং তাদের সম্মানও কম ছিল। 

৩। আর্কিটেক্টঃ আধুনিক রাষ্ট্রে অনেক নারী এখন আর্কিটেক্ট পেশা গ্রহণ করছে। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এদের সংখ্যা বেশি। ইউরোপেও অনেকে এ পেশা গ্রহণ করছে। তবে তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহে তাদের সংখ্যা কম এবং তাদের সুনামও কম। এর কারণ দেশের জনগণ সনাতন বিশ্বাস ও পুরাতন ধ্যান-ধারণা আকড়ে আছে। ফলে নারী এসব দেশে জেন্ডার বৈষম্যর শিকার হচ্ছে। 

৪। ডেনটিস্টঃ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নারী ডেন্টিস্ট বা দাঁতের ডাক্তারের সংখ্যা কম নয়। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের সংখ্যা গড়ে ২৪ জন। তবে বাংলাদেশের বেসরকারি ডেন্টাল কলেজ স্থাপনের জন্য ডেন্টিষ্ট এর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু তাদের বেতন, প্রসার, সুনাম যথেষ্ট নয়। নারীর dentist হওয়ায় বাধা ক্রমান্বয়ে কমে আসছে। দিন দিন তাদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়বে বলে আশা করা যায়।

৫। আইনজীবীঃ আইনজীবী পেশা অনেক নারীকে আকৃষ্ট করছে।  ফলে তারা বিভিন্ন দেশে আইনজীবী, অ্যার্টনি বা ব্যরিস্টার হিসেবে কাজ করছে।  এ পেশাকে এখন আর কেবল পুরুষের পেশ হিসেবে গণ্য করা হয় না। নারীরা ব্যপকহারে নিজেদের এ পেশায় যুক্ত করছে। তবে বাংলাদেশে এখনও পেশা কিছুটা পুরুষের দখলে।

৬। চিকিৎসকঃ আধুনিক বিশ্বে নারীগণের অনেকেই চিকিৎসা বিদ্যা অধ্যয়ন করে চিকিৎসাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করছে। পৃথিবীর সব দেশের নারী চিকিৎসক রয়েছে এর মাধ্যমে তারা জেন্ডারের বাধা অতিক্রম করে সনাতন সমাজ হতে আধুনিক সমাজে প্রবেশ করছে। ফলে নারীবাদ বা নারীমুক্তি ত্বরান্বিত হচ্ছে অবসান ঘটছে পুরুষতন্ত্রের।

৭। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকঃ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী অধ্যাপকদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।  মেধাবী নারীদের অনেকে এ পেশায় যোগদান করছেন। এ পেশায় নারীদের অংশগ্রহণ ক্রমবর্ধমান কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ অনেক দেশে পুরুষদের থেকে নারীর বেতন অপেক্ষাকৃত অনেক কম জেন্ডার বৈষম্য রয়ে গেছে।

৮। বেসরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের চাকরিঃ অনেক নারী বেসরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন পেশা গ্রহণ করে। তবে জেন্ডার বৈষম্যের কারণে অনেক নারী লেখাপড়া জানা সত্ত্বেও উচ্চতার পেশায় ঢুকতে পারে না । তারা জেন্ডার সমস্যার শিকার হয়। আমাদের দেশের পরিবার নারীদের চাকরি করাকে ভালো চোখে দেখে না এবং এসকল প্রতিষ্ঠানে নারীরা পুরুষ সহকর্মী থেকে জেন্ডার বৈষম্যের কারনে অনেক সময় প্রমোশন কম পায়। 

উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে বর্তমানে পুরুষের পাশাপাশি নারীরা বিভিন্ন কর্মে অবাধে প্রবেশ করলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারীরা তাদের পুরুষ সহকর্মীর তুলনায় প্রোমোশন কম পায়।  

১৯৭৪ বুখারেস্ট আন্তর্জাতিক জনসংখ্যা সম্মেলন ধারা

বুখারেস্ট আন্তর্জাতিক জনসংখ্যা সম্মেলন ১৯৭৪: কর্মপরিকল্পনার ১২টি মূল ধারা বিশ্লেষণ

ভূমিকা:- ১৯৭৪ সালে রুমানিয়ার রাজধানী বুখারেস্টে জাতিসংঘের উদ্যোগে একটি ঐতিহাসিক আন্তর্জাতিক জনসংখ্যা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, যা “বুখারেস্ট আন্তর্জাতিক জনসংখ্যা সম্মেলন” নামে পরিচিত। এই সম্মেলনে বিশ্বের ১৬৩টি দেশের প্রতিনিধি এবং অসংখ্য বেসরকারি সংস্থা, NGO অংশগ্রহণ করে। মূল উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জনসংখ্যা সমস্যা, উন্নয়ন এবং পরিকল্পনা নিয়ে একটি সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করা।

বুখারেস্ট আন্তর্জাতিক জনসংখ্যা সম্মেলন ১৯৭৪


বিশেষ করে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রেক্ষাপটে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সামাজিক অগ্রগতির পারস্পরিক সম্পর্ক তুলে ধরা হয় এই সম্মেলনে। এতে গৃহীত কর্মপরিকল্পনার ধারাগুলো আজও জনসংখ্যা নীতির ক্ষেত্রে দিকনির্দেশনা হিসেবে বিবেচিত হয়।


নিচে বুখারেস্ট সম্মেলনের ১২টি গুরুত্বপূর্ণ কর্মপরিকল্পনা ধারা বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:

১. জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের মধ্যে ভারসাম্য: সম্মেলনে বলা হয় যে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার নিয়ন্ত্রণ না করলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যাহত হয়। তাই পরিকল্পিত পরিবার গঠন, সচেতনতা এবং উন্নয়ন কার্যক্রমের মধ্যে একটি সুসমন্বয় জরুরী।

২. পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি প্রসার: এ সম্মেলনে পরিবার পরিকল্পনার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে জন্মহার কমানোর জন্য জনগণকে সচেতন করা, সুলভ ও নিরাপদ জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সরবরাহের কথা বলা হয়।

৩. নারী শিক্ষা ও ক্ষমতায়ন: নারীদের শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি এবং নারীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন এই সম্মেলনের অন্যতম বিষয় ছিল। নারী শিক্ষিত হলে তারা সচেতনভাবে পরিবার গঠন করতে পারেন।

৪. স্বাস্থ্যসেবা ও মাতৃস্বাস্থ্য উন্নয়ন: সম্মেলনে জোর দেওয়া হয় মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্যের উন্নয়নে। গর্ভাবস্থা, প্রসব এবং প্রসব পরবর্তী সেবা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রকে স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগের আহ্বান জানানো হয়।

৫. শ্রমশক্তি উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান: জনসংখ্যাকে বোঝা না ভেবে সম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। তাই শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি ছিল সম্মেলনের একটি মূল দিক।

৬. দারিদ্র্য দূরীকরণে জনসংখ্যা নীতি: দারিদ্র্য ও অতিরিক্ত জনসংখ্যা একে অপরের সাথে সম্পর্কযুক্ত। সম্মেলনে উল্লেখ করা হয় যে, দারিদ্র্য হ্রাসের জন্য সুনির্দিষ্ট জনসংখ্যা নীতি গ্রহণ জরুরি।

৭. শিশুদের জন্য শিক্ষা ও সুরক্ষা: শিশুদের শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি, নির্যাতন ও শোষণ থেকে সুরক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রের দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়।

৮. গ্রামীণ উন্নয়ন ও নগরায়ণ নিয়ন্ত্রণ: অসংগঠিত নগরায়ণ জনসংখ্যা বিস্ফোরণ ঘটায়। সম্মেলনে বলা হয়, গ্রামীণ উন্নয়নের মাধ্যমে শহরমুখী জনসংখ্যার চাপ কমানো সম্ভব।

৯. পরিবেশ সংরক্ষণ ও টেকসই উন্নয়ন: অতিরিক্ত জনসংখ্যা পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাই পরিবেশ রক্ষা ও **টেকসই উন্নয়নের সাথে জনসংখ্যা নীতির সামঞ্জস্য** প্রয়োজন।

১০. আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও প্রযুক্তি স্থানান্তর: বুখারেস্ট সম্মেলনে বলা হয়, উন্নত দেশগুলোকে প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক সহায়তা দিয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সহায়তা করতে হবে।

১১. জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও গবেষণা: জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে জনগণের ভূমিকা অপরিহার্য। তাই মিডিয়া, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং এনজিও-র মাধ্যমে জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও গবেষণাভিত্তিক নীতি প্রণয়ন ছিল সম্মেলনের অন্যতম ধারা।

১২. জনসংখ্যা নীতি প্রণয়নে রাষ্ট্রের দায়িত্ব: প্রতিটি দেশের নিজস্ব সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট অনুযায়ী জনসংখ্যা নীতি তৈরি ও বাস্তবায়নের জন্য রাষ্ট্রকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে।

 উপসংহার: বুখারেস্ট আন্তর্জাতিক জনসংখ্যা সম্মেলন ১৯৭৪ ছিল বিশ্ব ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক, যেখানে জনসংখ্যা, উন্নয়ন ও সামাজিক অগ্রগতির মধ্যে একটি সুসমন্বয় গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়। এর ১২টি কর্মপরিকল্পনা ধারা আজও উন্নয়নশীল দেশের জন্য পথনির্দেশক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

এই সম্মেলন প্রমাণ করে যে, জনসংখ্যা সমস্যা শুধু একটি দেশীয় ইস্যু নয়, বরং এটি একটি বৈশ্বিক উন্নয়ন ইস্যু, যার সমাধানে প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগ।

বেইজিং সম্মেলনের কারণ ও ফলাফল

বেইজিং নারী সম্মেলন ১৯৯৫ কারণ, ফলাফল ও বৈশ্বিক গুরুত্ব

ভূমিকা: ১৯৯৫ সালের ৪-১৫ সেপ্টেম্বর চীনের বেইজিং শহরে অনুষ্ঠিত হয়েছিল এক ঐতিহাসিক বৈশ্বিক আয়োজন চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলন, যা “বেইজিং নারী সম্মেলন ১৯৯৫” নামে পরিচিত। জাতিসংঘ আয়োজিত এই সম্মেলনে ১৮৯টি দেশের প্রতিনিধি এবং প্রায় ১৭,০০০ প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন, যা ছিল নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী মাইলফলক।

বেইজিং সম্মেলন


এই সম্মেলনের মূল লক্ষ্য ছিল বৈশ্বিকভাবে নারীর অবস্থান পর্যালোচনা, বৈষম্য হ্রাস, মানবাধিকার রক্ষা এবং নারীর উন্নয়নে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ। বেইজিং ঘোষণা ও প্ল্যাটফর্ম ফর অ্যাকশন (Beijing Declaration and Platform for Action) ছিল এ সম্মেলনের প্রধান দলিল, যা আজও নারীর ক্ষমতায়নের দিকনির্দেশনা হিসেবে বিবেচিত হয়।


বেইজিং নারী সম্মেলনের প্রধান কারণসমূহ

১। নারী ও দারিদ্র্য:

বিশ্বের গরিব জনগোষ্ঠীর বিশাল একটি অংশ নারী। দারিদ্র্য নারীদের জীবনে একাধিক প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, পুষ্টি ও কর্মসংস্থান থেকে তারা বঞ্চিত থাকে। নারী-পুরুষের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে এ বেইজিং সম্মেলন হয় ।

২। নারী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ:

শিক্ষা নারীর ক্ষমতায়নের মূল চাবিকাঠি। কিন্তু তখনও অনেক দেশে মেয়েরা বিদ্যালয়ে যেতে পারত না, উচ্চশিক্ষা ও কারিগরি প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করত খুব কম। নারীর জন্য মানসম্মত শিক্ষা ও নারী শিক্ষার হার বাড়ানোর জন্য এ সম্মেলন হয়।

৩। নারী ও স্বাস্থ্য:

নারীদের স্বাস্থ্যসেবা, প্রজনন স্বাস্থ্য এবং মাতৃত্বকালীন সুরক্ষায় বৈষম্য বিদ্যমান ছিল। নারীর স্বাস্থ্য অধিকারসহ বাল্যবিবাহ, পুষ্টিহীনতাসহ অন্যান্য সমস্যা সমাধান নিশ্চিত করার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য এ সম্মেলন হয়।

৪। নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা:

পারিবারিক সহিংসতা, ধর্ষণ, যৌন নির্যাতন ও মানব পাচারের মতো ভয়াবহ অপরাধ নারীদের জীবনে নিত্যকার হুমকি।  নারী-নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক নীতিমালা প্রণয়ন ও আইনি পদক্ষেপ প্রণয়নের জন্য বেইজিং সম্মেলন হয় ।

৫। নারী ও সশস্ত্র সংঘাত:

সশস্ত্র সংঘাত নারীর ওপর বিশেষভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ১৯৪৯ সালের জেনেভা কনভেনশন এবং ১৯৭৭ সালের অতিরিক্ত কূটনৈতিক বিধিতে নারীর সুরক্ষার কথা থাকলেও বাস্তবায়ন দুর্বল ছিল। এ বিষয়ে আরো কার্যকর পদক্ষেপের আহ্বান জানানোর জন্য এ সম্মেলন হয় ।

৬। নারী ও অর্থনীতি:

নারীদের শ্রমবাজারে প্রবেশ, সমান মজুরি ও সম্পদের মালিকানা নিশ্চিত না হওয়ায় অর্থনৈতিক দাসত্ব অব্যাহত ছিল। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারীরা বঞ্চিত তাই এ সম্মেলনে নারীর অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধির ওপর জোর দেওয়া হয়।

৭। ক্ষমতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারী:

জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণা অনুযায়ী নারী-পুরুষ উভয়ই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের অধিকারী। কিন্তু,  রাজনীতি, প্রশাসন ও কর্পোরেট খাতে নারীর অংশগ্রহণ ছিল সীমিত। নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য বেইজিং সম্মেলন সংঘটিত হয়  ।

৮। নারীর অগ্রগতির জন্য প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতি:

নারী উন্নয়নের জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিষ্ঠান গঠন ও শক্তিশালীকরণের প্রয়োজনীয়তা সম্মেলনে গুরুত্ব পায়।

৯। নারীর মানবাধিকার:

মানবাধিকার মানুষের জম্মগত অধিকার তবে মানবাধিকার শুধুমাত্র পুরুষদের নয়; নারীরাও তার পূর্ণভাগীদার। কিন্তু সারাদেশে মানবাধিকার লংঘিত হচ্ছে তাই বেইজিং প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে এই নীতি সুনির্দিষ্টভাবে ঘোষণা করার জন্য এ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। 

১০। নারী ও প্রচারমাধ্যম:

প্রচার মাধ্যম আধুনিক যুগে অনেক উন্নত। গণমাধ্যমে নারীর বিকৃত উপস্থাপনা এবং নেতিবাচক প্রচারণা ছিল এক বড় সমস্যা। যা নারীর জন্য অবমাননাকর।তাই নারীর ইতিবাচক, সম্মানজনক ও শক্তিশালী উপস্থাপনার গুরুত্ব তুলে ধরার প্রয়োজন ।

১১। নারী ও পরিবেশ:

প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার ও সুরক্ষায় নারীর অবদান থাকলেও নীতি প্রণয়নে তাদের ভূমিকা ছিল অনুপস্থিত। ফলে পরিবেশ সংরক্ষণে নারী ভূমিকা রাখতে পারতো না।


বেইজিং নারী সম্মেলনের ফলাফল ও গুরুত্ব

১। নারীর অবস্থা ও সম্মান প্রতিষ্ঠা:

বেইজিং সম্মেলনের মাধ্যমে নারীর মর্যাদা, অবস্থা ও সম্মান নিয়ে বৈশ্বিকভাবে আলোচনা শুরু হয়। নারীর অধিকারকে মানবাধিকার হিসেবে বিবেচনা করার একটি ঐতিহাসিক ঘোষণা হয়।

২। বৈষম্য ও সহিংসতা দূরীকরণে পদক্ষেপ:

নারীর প্রতি বৈষম্য, যৌন হয়রানি ও সহিংসতা বন্ধে জাতীয় আইন ও নীতিমালা প্রণয়নের ক্ষেত্রে এই সম্মেলন অনুপ্রেরণা জোগায়।

৩। নাইরোবি কর্মকৌশলের বাস্তবায়ন:

১৯৮৫ সালের নাইরোবি নারী সম্মেলনে গৃহীত পরিকল্পনার পূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য নতুন করে অঙ্গীকার করা হয়।

৪। নারী উন্নয়নে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা:

বেইজিং প্ল্যাটফর্ম বিভিন্ন দেশকে নারী উন্নয়নমূলক প্রকল্পে বিনিয়োগ ও সহযোগিতার আহ্বান জানায়।

৫। শান্তি অর্জনে নারীর ভূমিকা:

স্থানীয় থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায় পর্যন্ত শান্তি প্রতিষ্ঠায় নারীর অংশগ্রহণকে গুরুত্ব দেওয়া হয়।

৬। বাস্তবভিত্তিক কর্মকৌশল গ্রহণ:

নারী উন্নয়ন, ক্ষমতায়ন ও সহিংসতা প্রতিরোধে ১২টি বিষয়ভিত্তিক (critical areas of concern) কর্মপরিকল্পনা গৃহীত হয়।

৭। দারিদ্র্য দূরীকরণে নারীর ভূমিকা:

নারী ও শিশু দারিদ্র্য স্বীকার করে সমাজে তাদের অবস্থান উন্নয়নের জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়।

৮। আইন প্রণয়নের মাধ্যমে অধিকার রক্ষা:

নারীর অধিকার রক্ষায় সদস্য দেশগুলোকে আইন প্রণয়ন, সংস্কার এবং প্রয়োগে অগ্রাধিকার দেওয়ার অনুরোধ করা হয়।

৯। নারীর শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থান:

নারীর সমান সুযোগ যেমন- শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও কর্মসংস্থানে নারীর প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার আহ্বান জানানো হয়।

১০। প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো উন্নয়ন:

নারীর উন্নয়নের জন্য প্রশাসনিক ও সাংগঠনিক কাঠামো তৈরির প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়।

উপসংহার: বেইজিং নারী সম্মেলন ১৯৯৫ ছিল নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা, ক্ষমতায়ন ও বৈষম্য দূর করার ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। সম্মেলনের ফলস্বরূপ নারীর মর্যাদা, সামাজিক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক অধিকার নিয়ে বৈশ্বিক সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। আজও বেইজিং প্ল্যাটফর্ম ফর অ্যাকশন নারী উন্নয়ন ও সমতার জন্য অন্যতম মূল দিকনির্দেশনা হিসেবে বিবেচিত হয়।

যতদিন পর্যন্ত নারীর বিরুদ্ধে বৈষম্য, সহিংসতা ও বঞ্চনা চলবে, ততদিন বেইজিং সম্মেলনের আদর্শ ও নির্দেশনা আমাদের নীতি-নির্ধারণে পথ দেখাবে। 

CEDAW কী? সিডও সনদে নারী-পুরুষ সমতাসম্পর্কিত ধারণা

CEDAW কী? সিডও সনদে আলোচিত নারী-পুরুষের সমতাসম্পর্কিত ধারণা

ভূমিকা:- বর্তমান বিশ্বে নারীর অধিকার রক্ষা ও বৈষম্য দূর করা একটি গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকার ইস্যু। লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য রোধে এবং নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত হয় CEDAW সনদ, যা নারীর রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক অধিকার নিশ্চিত করতে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে।
CEDAW কী


CEDAW কী?

CEDAW (Convention on the Elimination of All Forms of Discrimination Against Women) বা “নারীদের প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলুপ্তি সনদ” হলো একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি, যা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ১৮ ডিসেম্বর ১৯৭৯ সালে গৃহীত হয় এবং ৩ সেপ্টেম্বর ১৯৮১ থেকে কার্যকর হয়।

বাংলাদেশ এই সনদে ১৯৮৪ সালে স্বাক্ষর করে

CEDAW সনদের ধারাসমূহ:

CEDAW সনদে মোট ৩০টি ধারা রয়েছে।এই ধারা গুলিকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়।

ক) ১-১৬ নং ধারা নারী পুরুষ সমতা সম্পর্কিত

খ) ১৭-২২ নং ধারা CEDAW কর্মপন্থা ও দায়িত্ব বিষয়ক

গ) ২৩-৩০ নং ধারা CEDAW প্রশাসন সম্পর্কিত

CEDAW সনদে নারী পুরুষ সম্পর্কিত ধারণাসমূহ-

১। নারীর মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ

 ‍সিডও সনদ অনুযায়ী রাষ্ট্রসমূহকে ক্ষমতারর ভিত্তিতে নারীর মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। নারী যেন পুরুষের মতোই শিক্ষা, কাজ, স্বাস্থ্য, সম্পত্তি, ভোটাধিকারসহ সকল ক্ষেত্রে সমান অধিকার পায়।

২। নারী পাচার রোধে ব্যবস্থা গ্রহণ

নারী পাচার, পতিতাবৃত্তি ও যৌন শোষণ প্রতিরোধে কঠোর আইন প্রণয়ন এবং তা কার্যকর করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

৩। কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষ সমান অধিকার

CEDAW সনদ অনুযায়ী শিক্ষাক্ষেরে ন্যয় কর্মক্ষেত্রে সকল প্রকার  চাকরি, বেতন, ছুটি ও মাতৃত্বকালীন সুবিধায় নারী ও পুরুষের সমতা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।

৪। নারীর স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা ও পুষ্টির অধিকার

পরিবার পরিকল্পনার ব্যাপারে নারীর মতামতের গুরুত্ব নিশ্চিতের পাশাপাশি নারী যেন প্রজনন স্বাস্থ্য, গর্ভাবস্থায় যত্ন ও পুষ্টি সেবা পায় — সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে সিডও সনদে।

৫। নারী ও তার সন্তানের জাতীয়তা

সিডও সনদ রাষ্ট্রসমূহের জাতীয়তা অর্জন, পরিবর্তন বজায় রাখার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের অধিকার নিশ্চিতকরণ একটি প্রতিফলন। নারী যেন তার জাতীয়তা বজায় রাখতে পারে এবং তার সন্তানকে জাতীয়তা দিতে পারে — এ অধিকার সুরক্ষিত করা হয়েছে।

৬। রাষ্ট্রসমূহের সংবিধান ও আইনসমূহে সমতার নীতি

যেসব রাষ্ট্র এই সনদে স্বাক্ষর করবে, তাদের সংবিধান ও আইন সমতার ভিত্তিতে সংস্কার করতে হবে। নারীর প্রতি সকল ধরনের বৈষম্য দূর করার পামাপাশি নারী পুরুষের সমতা অনুসরণে বদ্ধপরিকর থাকবে।

৭। সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে নারীর অংশগ্রহণ ব্যবস্থা

রাষ্ট্রের সব ধরনের নির্বাচনে নারী যেন নির্বাচন করতে ও ভোট দিতে পারে, সরকারি পদে নিয়োগ পায় — তা নিশ্চিত করতে হবে।

৮। নারীর নাগরিক ও আইনগত অধিকার

CEDAW সনদ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে রাষ্ট্রসমূহ আইনের দৃষ্টিতে নারী-পুরুষের অধিকারের পাশাপাশি নারীর চলাফেরা, বসবাস, সম্পত্তি, মামলা পরিচালনার অধিকারসহ আইনগত অধিকার সুরক্ষিত করা হয়েছে।

৯। বিবাহ অথবা মাতৃজনিত নারীর প্রতি বৈষম্য দূর

বিবাহ বা মাতৃত্ব কারণে নারীর প্রতি হওয়া বৈষম্য দূর করা সহ বৈবাহিক কারণে চাকরী হতে বরখাস্ত বিয়ে, সন্তান গ্রহণ, বিবাহ বিচ্ছেদসহ পারিবারিক বিষয়ে নারী-পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করার আহ্বান জানানো হয়েছে।

১০। সাংস্কৃতিক ও সামাজিক প্রথার ইতিবাচক পরিবর্তন

সিডও সনদ অনুসারে লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যমূলক কুসংস্কার, লিঙ্গভিত্তিক শ্রবিভাজন প্রথা ও সামাজিক রীতিনীতি পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে।

১১। শিক্ষাক্ষেত্রে নারী-পুরুষ সমান অধিকার

রাষ্ট্রসমূহ গ্রাম হতে শহর সর্বত্র শিক্ষায় প্রবেশ, পাঠ্যক্রম, পরীক্ষায় অংশগ্রহণ, বৃত্তি প্রাপ্তি — সব ক্ষেত্রে নারীর সমান সুযোগ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।

CEDAW সনদ অনুযায়ী, নারী ও পুরুষের মধ্যে সমতা মানে কেবল সমান সুযোগ নয়, বরং সমান মর্যাদা, দায়িত্ব ও সুবিধা নিশ্চিত করা।
এটি নিশ্চিত করে যে, নারী কোনোভাবেই সামাজিক, রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে না পড়ে।
সমতা অর্জনের জন্য রাষ্ট্রকে প্রয়োজনীয় আইন সংস্কার, নীতি গ্রহণ, এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে বলা হয়েছে।

উপসংহার:

CEDAW সনদ নারীর সার্বিক অধিকার নিশ্চিত করতে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। নারী-পুরুষের সমান অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য এটি বৈশ্বিকভাবে একটি শক্তিশালী দলিল। এ সনদ বাস্তবায়নের মাধ্যমে সমাজে ন্যায়ভিত্তিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন সম্ভব।এখন সময়, রাষ্ট্র ও সমাজ সবাই মিলে CEDAW-এর আদর্শ বাস্তবে কার্যকর করার।

১. CEDAW কী?
CEDAW (Convention on the Elimination of All Forms of Discrimination Against Women) হলো জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত একটি আন্তর্জাতিক সনদ যা নারীর বিরুদ্ধে সকল ধরনের বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে তৈরি হয়েছে।
২. CEDAW কবে গৃহীত হয়?
CEDAW সনদটি জাতিসংঘে গৃহীত হয় ১৮ ডিসেম্বর ১৯৭৯ সালে এবং কার্যকর হয় ৩ সেপ্টেম্বর ১৯৮১ সালে।
৩. বাংলাদেশ কবে CEDAW স্বাক্ষর করে?
বাংলাদেশ ৬ নভেম্বর ১৯৮৪ সালে CEDAW সনদে স্বাক্ষর করে এবং এটি কার্যকর করে।
৪. CEDAW সনদের মূল উদ্দেশ্য কী?
নারী-পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করা, নারীর বিরুদ্ধে বৈষম্য দূর করা, এবং নারীর রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা।
৫. CEDAW-এর কতটি ধারা রয়েছে?
CEDAW সনদে মোট ৩০টি ধারা রয়েছে, যা নারীর বিভিন্ন অধিকার ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব সম্পর্কে নির্দেশনা প্রদান করে।
৬. CEDAW-এর কোন ধারায় বাংলাদেশ সংরক্ষণ রেখেছে?
বাংলাদেশ ধারা ২ (আইনগত সংস্কার) ও ধারা ১৬ (পারিবারিক অধিকার) আংশিকভাবে সংরক্ষণ করেছে।
৭. CEDAW নারীর কোন অধিকার নিশ্চিত করে?
CEDAW সনদ নারীর শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, পরিবার, সম্পত্তি, এবং নাগরিক অধিকারসহ সবক্ষেত্রে সমতা নিশ্চিত করে।
৮. CEDAW বাস্তবায়নে রাষ্ট্রের দায়িত্ব কী?
রাষ্ট্রকে আইন সংস্কার, নীতি প্রণয়ন, বৈষম্য রোধে পদক্ষেপ গ্রহণ এবং চার বছর অন্তর জাতিসংঘে রিপোর্ট জমা দিতে হয়।

মেক্সিকো সম্মেলন গৃহীত ৫টি সুপারিশ

মেক্সিকো সম্মেলন গৃহীত ৫টি সুপারিশ – নারীর অধিকার ও বৈশ্বিক সমতার নতুন দিগন্ত

ভূমিকা:- ১৯৭৫ সালকে জাতিসংঘ ঘোষণা করেছিল আন্তর্জাতিক নারী বর্ষ হিসেবে। এই উপলক্ষে ১৯৭৫ সালের ১৯-৩০ জুন পর্যন্ত মেক্সিকো সিটিতে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন, যা ইতিহাসে “মেক্সিকো সম্মেলন” নামে পরিচিত। এই সম্মেলনে বিশ্বের ১৩৩টি দেশের প্রায় ৬,০০০ প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করে। সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল নারীর অধিকার, উন্নয়ন ও শান্তির বিষয়গুলোতে একটি বৈশ্বিক কাঠামো তৈরি করা।

মেক্সিকো সম্মেলন


সম্মেলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্জন ছিল “বিশ্ব কর্মপরিকল্পনা ১৯৭৫–১৯৮৫” (World Plan of Action)। এই পরিকল্পনার আলোকে গৃহীত হয় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ, যা বিশ্বের নারীর ক্ষমতায়ন ও বৈষম্যহীন সমাজ গঠনে পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করে।


এখানে আমরা মেক্সিকো সম্মেলনে গৃহীত ৫টি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ বিস্তারিতভাবে তুলে ধরবো।

✅ মেক্সিকো সম্মেলন গৃহীত ৫টি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশসমূহ-

১. নারীর প্রতি সবধরনের বৈষম্য বিলোপ করা:

সম্মেলনের প্রথম ও প্রধান সুপারিশ ছিল—নারীর প্রতি সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে চলমান সব ধরনের বৈষম্য বিলোপের উদ্যোগ গ্রহণ করা। এতে বলা হয়, প্রতিটি দেশ যেন নারীদের জন্য **সমান অধিকার ও সুযোগ** নিশ্চিত করে, বিশেষ করে আইন, উত্তরাধিকার, সম্পত্তির মালিকানা ও নাগরিক অধিকারের ক্ষেত্রে।


২. নারীর শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি ও সমতা প্রতিষ্ঠা:

সম্মেলনে শিক্ষা খাতকে নারীর ক্ষমতায়নের মূল হাতিয়ার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বলা হয়, নারী ও কন্যাশিশুর জন্য সমান শিক্ষার সুযোগ, বিদ্যালয়ে অংশগ্রহণ, কারিগরি ও উচ্চশিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

উল্লেখযোগ্য দিক:

* স্কুলে মেয়েদের ঝরে পড়ার হার কমানো

* মাতৃভাষায় শিক্ষা নিশ্চিত করা

* নারীশিক্ষায় বিশেষ স্কলারশিপ চালু


৩. অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন ও কর্মসংস্থানে সমান সুযোগ

সম্মেলনে নারীকে অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর করার ওপর জোর দেওয়া হয়। সুপারিশ করা হয়—

* নারীদের জন্য সমান মজুরি ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ

* ক্ষুদ্রঋণ, উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ ও ব্যবসায়িক সহায়তা

* অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করা নারীদের স্বীকৃতি ও সুরক্ষা


৪. নারীর স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা নিশ্চিত করা:

সম্মেলনে নারী-স্বাস্থ্যকে একটি মানবিক অধিকার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বলা হয়—

* প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা, মাতৃসেবা ও শিশুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে হবে

* পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কে নারীদের সচেতনতা বাড়াতে হবে

* প্রত্যন্ত অঞ্চল ও দরিদ্র নারীদের জন্য বিশেষ স্বাস্থ্য সুবিধা দিতে হবে


৫. নারীর রাজনৈতিক ও সামাজিক অংশগ্রহণ বাড়ানো:

নারীদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গায় উপস্থিতি বাড়াতে রাষ্ট্রকে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানানো হয়। সুপারিশগুলো হলো—

* স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে নারী প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধি

* রাজনৈতিক সংগঠন ও নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় নারীর সম্পৃক্ততা বাড়ানো

* নারীর নেতৃত্বগুণ বিকাশে প্রশিক্ষণ ও সহায়তা


🔍 অতিরিক্ত সুপারিশ ও বিবেচনাবিষয়ক দিক

মেক্সিকো সম্মেলনে শুধুমাত্র পাঁচটি নয়, আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও আলোচনায় উঠে আসে, যেমন:

* নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা বন্ধে আইনি ও সামাজিক পদক্ষেপ

* নারীশ্রমিকদের নিরাপত্তা ও মাতৃত্বকালীন সুবিধা নিশ্চিতকরণ

* গ্রামীণ নারী, আদিবাসী নারী ও প্রতিবন্ধী নারীদের অধিকার সংরক্ষণ


উপসংহার: মেক্সিকো সম্মেলন ছিল নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটি বৈশ্বিক মাইলফলক। গৃহীত সুপারিশগুলো পরবর্তীতে কোপেনহেগেন (১৯৮০), নাইরোবি (১৯৮৫) এবং বেইজিং (১৯৯৫) সম্মেলনে আরো গভীরভাবে অনুসরণ ও পর্যালোচনা করা হয়।

আজ, যখন আমরা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDGs)-এর বাস্তবায়নের পথে হাঁটছি, তখন এই ঐতিহাসিক সুপারিশগুলো আমাদের জন্য এখনো সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। একবিংশ শতকে নারীর অধিকার ও উন্নয়নের অগ্রগতিতে মেক্সিকো সম্মেলনের অবদান আমরা ভুলে যেতে পারি না।


১. মেক্সিকো সম্মেলন কবে ও কোথায় অনুষ্ঠিত হয়?
মেক্সিকো সম্মেলন ১৯৭৫ সালের ১৯ থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত মেক্সিকো সিটিতে অনুষ্ঠিত হয়। এটি জাতিসংঘের উদ্যোগে আয়োজিত প্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন।
২. মেক্সিকো সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য কী ছিল?
সম্মেলনের মূল লক্ষ্য ছিল নারীর অধিকার, উন্নয়ন এবং শান্তির বিষয়ে একটি বৈশ্বিক কর্মপরিকল্পনা গঠন এবং বিভিন্ন দেশের মধ্যে সমন্বয় সাধন।
৩. সম্মেলনে গৃহীত প্রধান ৫টি সুপারিশ কী কী?
সম্মেলনে গৃহীত ৫টি প্রধান সুপারিশ হলো:
১. নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ
২. নারীর শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি
৩. নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন
৪. স্বাস্থ্যসেবা ও প্রজনন স্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণ
৫. রাজনৈতিক ও সামাজিক অংশগ্রহণে নারীর সক্রিয়তা বৃদ্ধি
৪. মেক্সিকো সম্মেলনের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব কী ছিল?
এই সম্মেলন পরবর্তী নারী সম্মেলনগুলোর ভিত্তি স্থাপন করে (যেমন: কোপেনহেগেন ১৯৮০, নাইরোবি ১৯৮৫, বেইজিং ১৯৯৫)। এটি নারীর অধিকার নিয়ে বিশ্বব্যাপী নীতিমালায় গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে।
৫. এই সুপারিশগুলো কি আজকের সমাজে এখনো প্রাসঙ্গিক?
হ্যাঁ, আজও বিশ্বের অনেক দেশে নারী বৈষম্য, শিক্ষায় পিছিয়ে থাকা, কর্মসংস্থানে সুযোগের ঘাটতি রয়েছে। তাই এই সুপারিশগুলো এখনো বাস্তবায়নের প্রেক্ষিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশে প্রজনন স্বাস্থ্যসেবার গুরুত্ব

বাংলাদেশে প্রজনন স্বাস্থ্যসেবার গুরুত্ব: সুস্থ জাতি গঠনে অপরিহার্য এক ধাপ

ভূমিকা:- বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে স্বাস্থ্যখাতের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা। এটি শুধু নারীর মা হওয়া নয়, বরং সন্তান জন্ম দেওয়ার পূর্ব ও পরবর্তী সময়কাল, নারীর মানসিক ও শারীরিক সুস্থতা এবং পরিবার পরিকল্পনার মতো বিষয়গুলোর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একটি জাতির টেকসই উন্নয়ন ও সুস্থ ভবিষ্যৎ গঠনে প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি।

বাংলাদেশে প্রজনন স্বাস্থ্যসেবার গুরুত্ব


১. জন্মহার নিয়ন্ত্রণ: অতিরিক্ত জনসংখ্যা বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সমস্যা। সঠিক প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা এবং পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতির মাধ্যমে জন্মহার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব, যা দেশের অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষায় সহায়ক।

২. নিরাপদ মাতৃত্বের সেবা: প্রসবকালীন জটিলতা রোধ ও মায়ের মৃত্যু হার কমাতে নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করা জরুরি। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, প্রশিক্ষিত ধাত্রী ও আধুনিক হাসপাতালের সহজলভ্যতা মায়ের জীবন বাঁচাতে পারে।

৩. পুষ্টি ও সচেতনতা: গর্ভবতী মা ও নবজাতকের পুষ্টি নিশ্চিত করা প্রজনন স্বাস্থ্যের গুরুত্বপূর্ণ দিক। আয়রন, ক্যালসিয়াম, ফোলিক অ্যাসিডের মতো প্রয়োজনীয় উপাদান গ্রহণে সচেতনতা বাড়ালে শিশু বিকলাঙ্গতা বা অপুষ্টি রোধ করা সম্ভব।

৪. নবজাতকের পরিচর্যা: জন্মের পর শিশুর প্রথম ২৮ দিন অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এই সময়ে পর্যাপ্ত পরিচর্যা, টিকাদান ও সঠিক পুষ্টি শিশুর সুস্থ বিকাশে মুখ্য ভূমিকা রাখে।

৫. ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভপাত: অবৈধ ও অনিরাপদ গর্ভপাত বহু নারীর মৃত্যুর কারণ। সচেতনতা, গর্ভনিরোধক ব্যবহারের জ্ঞান ও সামাজিক সহানুভূতি থাকলে এই সমস্যা হ্রাস পাবে।

৬. বন্ধ্যাত্ব দূরীকরণ: অনেক দম্পতি সন্তানহীনতার মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করেন। আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির মাধ্যমে বন্ধ্যাত্ব নিরাময় সম্ভব, তবে এর জন্য প্রয়োজন সচেতনতা ও উপযুক্ত স্বাস্থ্যসেবা।

৭. মানবাধিকার ও নৈতিকতাবোধ: প্রজনন স্বাস্থ্য একটি মৌলিক মানবাধিকার। প্রত্যেক নারী-পুরুষের উচিত এই বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণ করা এবং অন্যের সম্মান বজায় রাখা। জোরপূর্বক বিয়ে, কম বয়সে গর্ভধারণ কিংবা গোপনীয়তা লঙ্ঘন প্রজনন অধিকারের লঙ্ঘন।

৮. পুরুষদের স্বাস্থ্য গ্রহণ: প্রজনন স্বাস্থ্য মানে শুধু নারীর বিষয় নয়। পুরুষদেরও স্বাস্থ্য সচেতন হতে হবে—যেমন যৌনরোগ প্রতিরোধ, সন্তান জন্মের সময় সহায়তা করা, এবং যৌন স্বাস্থ্য সম্পর্কে জানা।

৯. বয়ঃসন্ধিকালে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ: বয়ঃসন্ধিকাল হচ্ছে জীবনের সবচেয়ে স্পর্শকাতর সময়। এই বয়সে ছেলে-মেয়েদের সঠিক দিকনির্দেশনা, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও মানসিক সহায়তা না পেলে তারা ভুল পথে চলে যেতে পারে।

১০. সংক্রমণ রোগ ও এইডস প্রতিরোধ: যৌনবাহিত সংক্রমণ এবং এইডস একবিংশ শতাব্দীর একটি বড় স্বাস্থ্য হুমকি। নিরাপদ যৌন অভ্যাস, পরীক্ষার গুরুত্ব, কনডম ব্যবহারের সচেতনতা এসব রোগ প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।

উপসংহার: প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা কোনো বিলাসিতা নয়—এটি একটি মৌলিক প্রয়োজন। সুস্থ মা মানেই সুস্থ জাতি। একজন সচেতন নাগরিক, অভিভাবক ও তরুণ সমাজ হিসেবে আমাদের উচিত এই বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা, শিক্ষা এবং সেবার সুযোগ তৈরি করা। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং মিডিয়াকেও এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে দায়িত্ব নিতে হবে। একটি সচেতন জাতিই পারে ভবিষ্যতের জন্য একটি সুস্থ ও উন্নত প্রজন্ম উপহার দিতে।

বাংলাদেশে মরণশীলতার কারণসমূহ

বাংলাদেশে মরণশীলতার কারণ: একটি বাস্তবচিত্র

ভূমিকা:- বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সামনে এগিয়ে চলেছে। তবে দেশের সামগ্রিক অগ্রগতির পেছনে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতাগুলোর একটি হলো মরণশীলতার উচ্চহার। মরণশীলতা শুধু জনসংখ্যার স্বাস্থ্য ও স্থিতিশীলতায় প্রভাব ফেলে না, বরং এটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়নকেও ব্যাহত করে। এ লেখায় আমরা বাংলাদেশের মরণশীলতার প্রধান কারণগুলো তুলে ধরবো।

বাংলাদেশে মরণশীলতার কারণ


১। দারিদ্র্য: বাংলাদেশের বহু মানুষ এখনও দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। অর্থনৈতিক দুর্বলতার কারণে অনেকেই প্রয়োজনীয় চিকিৎসা, পুষ্টি ও স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করতে পারে না। অপুষ্টি, অনাহার, ও অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাত্রার কারণে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, যার ফলে মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যায়।


২। উপযুক্ত চিকিৎসার অভাব: গ্রামাঞ্চলে চিকিৎসা সুবিধার ভয়াবহ ঘাটতি রয়েছে। সেখানে আধুনিক হাসপাতাল বা প্রশিক্ষিত ডাক্তার খুবই কম। অনেক সময় রোগীকে সময়মতো চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয় না, যার ফলে সাধারণ অসুস্থতাও প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে। এমনকি শহরাঞ্চলেও ব্যয়বহুল চিকিৎসার কারণে দরিদ্র শ্রেণি সেবা থেকে বঞ্চিত হয়।

৩। স্বাস্থ্যকর পরিবেশের অভাব: অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ যেমন অপরিষ্কার পানি, নোংরা ড্রেনেজ ব্যবস্থা, এবং বায়ুদূষণ বিভিন্ন রোগের জন্ম দেয়। ডায়রিয়া, টাইফয়েড, ডেঙ্গু, ও অন্যান্য পানিবাহিত রোগ বাংলাদেশের শিশু মৃত্যু হার বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। তাছাড়া শিল্পাঞ্চলের বায়ুদূষণও শ্বাসকষ্ট ও হৃদরোগের প্রবণতা বাড়ায়।

৪। সমাজকল্যাণমূলক ব্যবস্থার অভাব: অনেক সময় সরকার কর্তৃক পরিচালিত সমাজকল্যাণমূলক কর্মসূচি বাস্তবায়নে দুর্বলতা দেখা যায়। বিশেষ করে প্রতিবন্ধী, বৃদ্ধ ও একক মায়েদের জন্য পর্যাপ্ত সেবা বা সহায়তা নেই। ফলে এসব গোষ্ঠী উপযুক্ত চিকিৎসা বা সেবা না পেয়ে মৃত্যুর মুখে পড়ে।

৫। পুষ্টিকর খাদ্যের অভাব: অসংখ্য মানুষ এখনো তিনবেলা পুষ্টিকর খাবার পায় না। বিশেষ করে শিশু ও মা’দের ক্ষেত্রে অপুষ্টি মারাত্মকভাবে প্রভাব ফেলে। এটি শুধু রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমায় না, বরং দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটায়, যার ফলে মৃত্যুর হার বাড়ে।

৬। নারী মৃত্যুর উচ্চহার: বাংলাদেশে গর্ভকালীন ও প্রসবকালীন মৃত্যুহার এখনও আশঙ্কাজনক। অনেক নারী গর্ভাবস্থায় সঠিক চিকিৎসা ও পুষ্টি না পাওয়ার কারণে জীবন হারান। তাছাড়া সমাজে নারী স্বাস্থ্যকে কম গুরুত্ব দেওয়ার কারণে নারীদের মরণশীলতার হার তুলনামূলকভাবে বেশি।

৭। যানবাহনের দুর্ঘটনা: বাংলাদেশে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছে। বেপরোয়া চালনা, ট্রাফিক আইন না মানা এবং রাস্তাঘাটের দুরবস্থা এসব দুর্ঘটনার মূল কারণ। অনেক সময় দুর্ঘটনার পর জরুরি চিকিৎসা না পাওয়ায় প্রাণহানি ঘটে।

৮। বাল্যবিবাহ: বাল্যবিবাহ এখনও বাংলাদেশের এক বড় সামাজিক সমস্যা। অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েরা গর্ভধারণে যেমন ঝুঁকিপূর্ণ, তেমনি মা ও শিশুর উভয়ের মৃত্যুর আশঙ্কাও বেশি থাকে। শিক্ষার অভাব ও সামাজিক চাপে মেয়েরা অল্প বয়সে গৃহবধূ হয়ে পড়ে, যার পরিণতিতে তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ে।

উপসংহার: বাংলাদেশে মরণশীলতার পেছনে যে বহুমুখী কারণ রয়েছে, তা স্পষ্ট। তবে সুখবর হলো, সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন এনজিও ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রচেষ্টায় অনেক ক্ষেত্রেই ইতিবাচক পরিবর্তন আসছে। প্রয়োজন শুধু কার্যকর নীতি, পরিকল্পিত কর্মসূচি ও জনসচেতনতা। তাহলেই আমরা একটি সুস্থ, সবল ও উন্নত জাতি গড়তে পারবো।

ইউরোপে পুঁজিবাদ বিকাশের কারণসমূহ

ইউরোপে পুঁজিবাদের বিকাশ: ইতিহাস ও প্রধান কারণসমূহ

ভূমিকা:-  বর্তমান আধুনিক বিশ্বের অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পুঁজিবাদ । তবে এর শিকড় বহু শতাব্দী পুরোনো। মধ্যযুগের শেষ ভাগ থেকে শুরু করে আধুনিক যুগ পর্যন্ত নানা সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের মাধ্যমে পুঁজিবাদ ধীরে ধীরে বিকাশ লাভ করে। এই ব্লগে আমরা ইউরোপে পুঁজিবাদের বিকাশের ১০টি গুরুত্বপূর্ণ কারণ আলোচনা করব, যা ইতিহাসপ্রেমী ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের জন্য বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক।

ইউরোপে পুঁজিবাদের বিকাশ


১। সামন্ততন্ত্রের পতন: মধ্যযুগে ইউরোপে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা ছিল অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের প্রধান মাধ্যম। কৃষিভিত্তিক উৎপাদন ও জমিদার শ্রেণির কর্তৃত্ব ধীরে ধীরে অচল হয়ে পড়ে। কৃষকেরা জমির উপর অধিকার চায় এবং নগরের দিকে সরে যায়, যার ফলে এই পুরনো ব্যবস্থার পতন ঘটে। এই পরিবর্তন পুঁজিবাদী উৎপাদনের দরজা খুলে দেয়।

২। বণিক শ্রেণির উত্থান: বণিক শ্রেণি বা বুর্জোয়া শ্রেণি ইউরোপে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারের মাধ্যমে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তাঁরা বাণিজ্যিক পুঁজি, ব্যাংক ব্যবস্থা, এবং আন্তর্জাতিক লেনদেনে নেতৃত্ব দেয়। এই শ্রেণির চাহিদা ছিল ব্যক্তিমালিকানাভিত্তিক অর্থনীতি, যা পুঁজিবাদের মূল ভিত্তি।

৩। রেনেসাঁর প্রভাব: রেনেসাঁ যুগে যুক্তিবাদ, মানবতাবাদ এবং ব্যক্তি স্বাধীনতার ধারণা শক্তিশালী হয়। ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তে মানুষের চিন্তাধারায় বৈজ্ঞানিক ও বাস্তববাদী মানসিকতা প্রবেশ করে। অর্থ উপার্জন এবং সম্পদ অর্জনকে ইতিবাচক হিসেবে দেখা শুরু হয়, যা পুঁজিবাদী মূল্যবোধকে জোরদার করে।

৪। উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্য বিস্তার: উপনিবেশ স্থাপন ইউরোপের দেশগুলোর হাতে বিপুল সম্পদ এনে দেয়। কাঁচামাল, সস্তা শ্রম এবং নতুন বাজার ইউরোপীয় বণিকদের মুনাফা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। এই উপনিবেশিক শোষণই ইউরোপে পুঁজিবাদের ভিত্তি আরও মজবুত করে।

৫। শিল্প বিপ্লব: ১৮শ শতকে শিল্প বিপ্লব পুঁজিবাদে নতুন গতি আনে। যন্ত্রের ব্যবহার, কারখানা ভিত্তিক উৎপাদন এবং শ্রমবাজারের সৃষ্টি পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থাকে ব্যাপক আকারে প্রসারিত করে। মুনাফা অর্জন হয় একমাত্র লক্ষ্য।

৬। শহর ও নগরের পত্তন: শহর ও নগরায়ণ পুঁজিবাদের গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি। বাণিজ্য ও কারখানাকেন্দ্রিক নগরের বিকাশ শ্রমজীবী মানুষের জন্ম দেয় এবং পণ্য উৎপাদন ও বিপণনে নতুন গতিশীলতা আনে।

৭। যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়ন: রেলপথ, জাহাজ ও সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে পণ্য পরিবহন, কাঁচামালের সংগ্রহ ও বণ্টন সহজ হয়। এর ফলে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্রসারিত হয়, যা পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে আরো গতিশীল করে।

৮। মুদ্রা অর্থনীতির প্রবর্তন: মুদ্রাভিত্তিক অর্থনীতি বার্টার পদ্ধতির জায়গা নেয়। মজুরি ভিত্তিক শ্রম ও ব্যাংক ব্যবস্থার বিকাশ পুঁজিবাদের জন্য শক্তিশালী আর্থিক কাঠামো গড়ে তোলে।

৯। ব্যক্তি সম্পত্তির ধারণা: পুঁজিবাদের একটি প্রধান নীতি হলো ব্যক্তিগত মালিকানা। ইউরোপে এই ধারণা আইনি ও সামাজিক স্বীকৃতি পায়। ব্যক্তি তার উৎপাদনের ফল ভোগ করতে পারে—এই বিশ্বাস পুঁজিবাদের বিস্তারে মৌলিক ভূমিকা রাখে।

১০। পুঁজিবাদী মানসিকতা: ইউরোপীয়দের মধ্যে পুঁজিবাদী মানসিকতা গড়ে ওঠে—যেখানে লাভ, প্রতিযোগিতা, উদ্ভাবন ও স্বার্থের কথা চিন্তা করা হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি সমাজের প্রতিটি স্তরে ঢুকে পড়ে এবং পুঁজিবাদকে শুধু অর্থনৈতিক নয়, একটি সামাজিক আদর্শে পরিণত করে।

উপসংহার: পুঁজিবাদের বিকাশ ছিল বহু শতাব্দীজুড়ে চলা এক ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের পতন থেকে শুরু করে শিল্প বিপ্লব ও উপনিবেশবাদের উত্থান পর্যন্ত প্রতিটি ধাপ পুঁজিবাদকে শক্তিশালী করে তোলে। আজকের বিশ্ব অর্থনীতির কাঠামো বুঝতে হলে ইউরোপে পুঁজিবাদের এই ইতিহাস জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

রেনেসাঁর কারণ ও ফলাফল

রেনেসাঁ: কারণ ও ফলাফল | মানব সভ্যতার জাগরণের সূচনা

ভূমিকা:- রেনেসাঁ  ইতিহাসে এক চিরস্মরণীয় যুগান্তকারী পরিবর্তনের নাম। এটি শুধু ইউরোপীয় সমাজ নয়, সমগ্র মানব সভ্যতার গতিপথ পরিবর্তন করেছে। রেনেসাঁ শব্দের অর্থ "পুনর্জাগরণ", যার মাধ্যমে মধ্যযুগের ধর্মান্ধতা ও গোঁড়ামি থেকে মানুষ মুক্ত হয়ে যুক্তিবাদ, বিজ্ঞানের চর্চা ও মানবতাবাদের দিকে ধাবিত হয়।

রেনেসাঁর কারণ ও ফলাফল


এই ব্লগে আমরা আলোচনা করবো রেনেসাঁর কারণ ও ফলাফল, যা আধুনিক সভ্যতার ভিত্তি স্থাপন করেছে।

রেনেসাঁর কারণসমূহ: এই জাগরণ কেন ও কীভাবে ঘটেছিল?

রেনেসাঁর পেছনে কোনো একক কারণ ছিল না। এটি ছিল বহু সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের সম্মিলিত ফল। নিচে রেনেসাঁ বিস্তারের প্রধান কারণগুলো আলোচনা করা হলো:

১. ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার: মধ্যযুগের শেষে ইউরোপে বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড ব্যাপকভাবে বাড়ে। ইতালির ফ্লোরেন্স, ভেনিস, জেনোয়া শহরগুলো আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের কেন্দ্র হয়ে ওঠে। এই ব্যবসা-বাণিজ্যের ফলে মানুষ নতুন চিন্তা, সংস্কৃতি ও তথ্যের সংস্পর্শে আসে।

২. মুসলিম বিশ্বের অবদান: মুসলিম পণ্ডিতেরা প্রাচীন গ্রিক ও রোমান জ্ঞানকে সংরক্ষণ ও উন্নত করেন। চিকিৎসা, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, দর্শনসহ নানা ক্ষেত্রে মুসলমানদের অবদান ইউরোপের রেনেসাঁর বীজ বপন করে।

৩. ধর্মযুদ্ধ (ক্রুসেড): ধর্মযুদ্ধ ইউরোপীয়দের মুসলিম বিশ্বের সংস্কৃতি, জ্ঞান ও উন্নত জীবনযাত্রার সঙ্গে পরিচিত করে তোলে। এটি ইউরোপে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও অভিজ্ঞতা নিয়ে আসে।

৪. মানুষ ও প্রকৃতির প্রতি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি: রেনেসাঁর যুগে মানুষ নিজেকে এবং প্রকৃতিকে জানতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। ধর্মকেন্দ্রিক জীবনের বাইরে এসে মানুষ নিজেকে চিনতে শেখে, যা রেনেসাঁর অন্যতম ভিত্তি।

৫. শিক্ষার প্রসার: মধ্যযুগের পর নতুন করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে থাকে। মানুষ সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন, বিজ্ঞান নিয়ে চর্চা শুরু করে। এতে জ্ঞানচর্চা নতুন গতি পায়।

৬. মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কার: ১৪৫০ সালে জার্মানির *গুটেনবার্গ* মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কার করেন। ফলে বই উৎপাদন সহজ ও সস্তা হয়, এবং সাধারণ মানুষের মধ্যেও জ্ঞান ছড়িয়ে পড়ে।

৭. কনস্টান্টিনোপলের পতন (১৪৫৩): কনস্টান্টিনোপল ছিল গ্রিক জ্ঞান ও সংস্কৃতির এক বিরাট ভান্ডার। এর পতনের পর অনেক গ্রিক পণ্ডিত ইতালিতে চলে আসেন এবং প্রাচীন গ্রিক সাহিত্য ও দর্শনের পুনর্জাগরণ ঘটান।

 ৮. শিল্পকলার প্রভাব: মাইকেল অ্যাঞ্জেলো, লিওনার্দো দা ভিঞ্চি প্রমুখ শিল্পীরা শিল্পকলার মধ্য দিয়ে মানুষের অনুভূতি, যুক্তি ও বাস্তবতাকে প্রকাশ করেন। এই শিল্পকলার মাধ্যমেই রেনেসাঁর চেতনা ছড়িয়ে পড়ে।

৯. বাগদাদ, কর্ডোভা ও কায়রোর শিক্ষালয়ের অবদান: বাগদাদের "বাইতুল হিকমা", কর্ডোভা ও কায়রোর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছিল প্রাচীন জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দর্শনের কেন্দ্র। মুসলিম অনুবাদক ও গবেষকরা গ্রীক-রোমান সাহিত্য ও বিজ্ঞান সংরক্ষণ ও অনুবাদ করে ইউরোপে পাঠান। এই শিক্ষালয়গুলোর মাধ্যমে ইউরোপীয় সমাজ প্রাচীন জ্ঞানের সাথে পুনরায় সংযুক্ত হয়, যা রেনেসাঁর ভিত্তি শক্তিশালী করে।


রেনেসাঁর প্রভাব ও ফলাফল:

রেনেসাঁ শুধু একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন নয়, বরং এটি ছিল এক চিন্তাগত বিপ্লব। এর প্রভাব আজও মানব সভ্যতায় বিদ্যমান।

১. আধুনিক মানসিকতার সৃষ্টি: রেনেসাঁ যুগে যুক্তিবাদ, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি ও মুক্তচিন্তার প্রসার ঘটে। এটি আধুনিকতার বুনিয়াদ গড়ে তোলে।

২. চিন্তাজগতের পরিবর্তন: এই যুগে মানুষ নিজেকে জানার, প্রশ্ন করার ও বিশ্লেষণের অভ্যাস গড়ে তোলে। “আমি কে?”—এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই শুরু হয় দর্শনের নতুন অধ্যায়।

৩. রাজনৈতিক পরিবর্তন: রেনেসাঁর ফলে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে জনগণের অধিকার ও গণতন্ত্রের ধারা গড়ে ওঠে। জাতীয়তাবাদ ও স্বাধীন রাষ্ট্রচিন্তার জন্ম হয়।

৪. ধর্মীয় উদারতা: রেনেসাঁ ধর্মকে যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করার পথ খুলে দেয়। ধর্মীয় সংস্কার (Reformation) আন্দোলনের পেছনেও এর বড় ভূমিকা ছিল।

৫. ঐক্যের বোধ: ধর্ম, ভাষা বা জাতির ভেদাভেদ না করে সকল মানুষকে সমান মর্যাদা দেওয়ার চিন্তাধারা জন্ম নেয়।

৬. বিশ্বভ্রাতৃত্বের অনুভব: রেনেসাঁ মানুষকে শেখায়, পৃথিবীর সকল মানুষ একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত। এই চিন্তা থেকেই মানবতাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদ গড়ে ওঠে।

৭. শিক্ষার নবজাগরণ: শিক্ষাক্ষেত্রে অভাবনীয় পরিবর্তন আসে। সাহিত্য, বিজ্ঞান, ইতিহাস, দর্শন সব বিষয়ে নতুন গবেষণা শুরু হয় এবং শিক্ষাকে সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে আনা হয়।

৮. মানবতাবাদের বিকাশ: রেনেসাঁর সবচেয়ে বড় উপহার মানবতাবাদ (Humanism)। এটি মানুষকে জীবন ও জগতের কেন্দ্রস্থানে নিয়ে আসে এবং মানুষের যোগ্যতা, স্বাধীনতা ও নৈতিকতাকে গুরুত্ব দেয়।

উপসংহার: রেনেসাঁ এক নতুন যুগের সূচনা। রেনেসাঁ শুধু ইউরোপের নয়, গোটা মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। এটি মানুষকে চিন্তা করতে শেখায়, প্রশ্ন করতে উৎসাহ দেয় এবং জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেয়। বিজ্ঞান, সাহিত্য, শিল্প, রাজনীতি ও সমাজের সব স্তরে রেনেসাঁর প্রভাব আজও স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়। রেনেসাঁ তাই শুধুই অতীত নয় এটি বর্তমান ও ভবিষ্যতের পথপ্রদর্শক।

পরিবেশের উপর নব প্রযুক্তির প্রভাব

পরিবেশের উপর নব প্রযুক্তির প্রভাব: সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ

ভূমিকা:- বর্তমান বিশ্বের অগ্রগতির পেছনে অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হলো নব্য প্রযুক্তি (Modern Technology)। প্রযুক্তির অগ্রগতি যেমন মানবজীবনকে সহজতর করেছে, তেমনি পরিবেশের ওপর এর রয়েছে গভীর প্রভাব। এই প্রভাব কখনো ইতিবাচক, কখনো নেতিবাচক। আমাদের পরিবেশকে টিকিয়ে রাখতে হলে প্রযুক্তির সঠিক ও ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবহার অত্যন্ত জরুরি।

পরিবেশের উপর নব প্রযুক্তির প্রভাব


 নব প্রযুক্তির ইতিবাচক প্রভাব

১. কৃষির আধুনিকীকরণের ক্ষেত্রে: নব প্রযুক্তি কৃষি খাতে বিপ্লব ঘটিয়েছে। আধুনিক যন্ত্রপাতি, ড্রোন, স্মার্ট সেন্সর, এবং স্বয়ংক্রিয় সেচ ব্যবস্থার মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন অনেক গুণ বেড়েছে। এতে কীটনাশক ও পানি ব্যবহারে দক্ষতা এসেছে, যা পরিবেশদূষণ হ্রাসে ভূমিকা রাখে। অপরদিকে স্যাটেলাইট চিত্র ও আবহাওয়ার তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে কৃষকরা ফসলের জন্য সঠিক সময় নির্ধারণ করতে পারছেন।


২. চিকিৎসা ব্যবস্থার আধুনিকীকরণের ক্ষেত্রে: নব প্রযুক্তির ব্যবহারে টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে দূরবর্তী অঞ্চলের মানুষও চিকিৎসা পাচ্ছেন, ফলে যাতায়াত কমে পরিবেশে কার্বন নিঃসরণ কম হচ্ছে। নব্য প্রযুক্তির ফলে বায়োডিগ্রেডেবল ও পরিবেশবান্ধব চিকিৎসা সামগ্রীর ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে।

৩. যন্ত্রের প্রসার: নব প্রযুক্তির মাধ্যমে উৎপাদনমুখী যন্ত্রের প্রসার ঘটেছে, যা মানবশ্রম কমিয়ে পরিবেশের ওপর নির্ভরতা কমিয়েছে। ফলে অটোমেশিন প্রযুক্তির মাধ্যমে শিল্প-কারখানায় বর্জ্য উৎপাদন কমানো সম্ভব হচ্ছে। পরিবেশবান্ধব কারখানা ও স্মার্ট ফ্যাক্টরি তৈরি হচ্ছে, যেগুলো শক্তি ও জল ব্যবহারে অনেক বেশি দক্ষ।


৪. ক্ষতিকর জীবাণু ধ্বংসের ক্ষেত্রে: বায়ু, পানি ও মাটির ক্ষতিকর জীবাণু ধ্বংসে আধুনিক প্রযুক্তি কার্যকর ভূমিকা রাখছে। UV লাইট, ওজোন জেনারেটর, এবং প্লাজমা টেকনোলজির মাধ্যমে বিভিন্ন ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করা সম্ভব হচ্ছে। এতে করে জনস্বাস্থ্য রক্ষা ছাড়াও পরিবেশের ভারসাম্য বজায় থাকে।


 ৫. যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রসারের ক্ষেত্রে: ডিজিটাল যোগাযোগ ব্যবস্থার উদ্ভব যেমন: ইন্টারনেট, মোবাইল প্রযুক্তি, ক্লাউড কম্পিউটিং – এগুলোর প্রসারে কাজের জন্য বারবার যাতায়াতের প্রয়োজনীয়তা কমেছে। এটি জ্বালানি সাশ্রয় করে পরিবেশ দূষণ কমায়। ফলে ভার্চুয়াল মিটিং, রিমোট কাজ ও অনলাইন শিক্ষা পরিবেশবান্ধব জীবনধারাকে উৎসাহিত করছে।

 

নব প্রযুক্তির কিছু নেতিবাচক প্রভাব

যদিও নব প্রযুক্তি উন্নয়ন আশার আলো জাগায়, তবে এর কিছু নেতিবাচক দিকও রয়েছে সেগুলো নিচে তুলে ধরা হলো।

১. ই-ওয়েস্ট সমস্যা: ব্যবহার শেষে ফেলে দেওয়া ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশ (যেমন মোবাইল, ল্যাপটপ, টিভি) থেকে সৃষ্ট ই-ওয়েস্ট এখন বড় পরিবেশগত হুমকি। এতে বিষাক্ত ধাতু ও রাসায়নিক পদার্থ মাটি ও পানিতে মিশে যাচ্ছে।

২. জীববৈচিত্র্যের ওপর প্রভাব: অতিরিক্ত যন্ত্রনির্ভরতা এবং প্রাকৃতিক সম্পদের অতিরিক্ত ব্যবহার অনেক প্রজাতির জীববৈচিত্র্য নষ্ট করছে।

৩. কার্বন নির্গমন ও জলবায়ু পরিবর্তন: যদিও নব প্রযুক্তির অনেকগুলো দিক পরিবেশবান্ধব, তবে কিছু প্রযুক্তি এখনো উচ্চ মাত্রায় বিদ্যুৎ বা জ্বালানি ব্যবহার করে, যা কার্বন নির্গমন বাড়িয়ে বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ায়।

✅ উপসংহার: নব প্রযুক্তি মানবজীবনের গতি বাড়ানোর পাশাপাশি পরিবেশ সংরক্ষণেও বিশাল অবদান রাখছে। তবে এর নেতিবাচক দিকগুলোকেও উপেক্ষা করা চলে না। প্রযুক্তিকে পরিবেশবান্ধব করতে হলে আমাদের সচেতন হতে হবে এবং টেকসই প্রযুক্তির দিকে অগ্রসর হতে হবে। প্রযুক্তি ও পরিবেশের মধ্যে ভারসাম্যই ভবিষ্যৎ পৃথিবীকে নিরাপদ ও বাসযোগ্য রাখতে পারে।

আন্তর্জাতিক স্থানান্তর গমনের কারণ ও ফলাফল

আন্তর্জাতিক স্থানান্তর: গমনের কারণ ও ফলাফল

ভূমিকা:- বর্তমান বৈশ্বিকায়নের যুগে আন্তর্জাতিক স্থানান্তর একটি সাধারণ ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হয়ে উঠেছে। মানুষ বিভিন্ন কারণে নিজ দেশ ছেড়ে অন্য দেশে বসবাস, কাজ বা শিক্ষা গ্রহণের জন্য স্থানান্তর হচ্ছে। এই প্রবণতাকে অভিবাসন বা আন্তর্জাতিক স্থানান্তর বলা হয়ে থাকে।

আন্তর্জাতিক স্থানান্তর গমনের কারণ ও ফলাফল


আন্তর্জাতিক স্থানান্তরের কারণসমূহ

আন্তর্জাতিক স্থানান্তরের পেছনে রয়েছে একাধিক সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং পারিবারিক কারণ। নিচে এই গমনের প্রধান কারণগুলো তুলে ধরা হলো:

১. উন্নত চাকরির সুযোগ- বহু মানুষ উন্নত দেশের বেশি বেতনের চাকরি, চাকরির নিরাপত্তা এবং কর্ম-পরিবেশের জন্য দেশ ত্যাগ করে।

২. বাহ্যিক আয় (রেমিট্যান্স)- বিদেশে কাজ করে উপার্জিত অর্থ দেশে পাঠানো হয়, যা পারিবারিক আর্থিক উন্নয়নের পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

৩. উচ্চ শিক্ষা: অনেক শিক্ষার্থী উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য বা অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে গমন করে।

৪. উন্নত প্রশিক্ষণ: বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা অর্জনের জন্যও আন্তর্জাতিকভাবে অনেক মানুষ স্থানান্তর হয়।

৫. জাতীয় সম্পদের ঘাটতি: নিজ দেশের শিক্ষা, চিকিৎসা বা কর্মসংস্থানের সীমাবদ্ধতার কারণে অনেক সময় মানুষ বিদেশে স্থানান্তরিত হতে বাধ্য হয়।

৬. পিতামাতার স্থানান্তর: অনেক শিশু বা কিশোর বাবা-মায়ের সঙ্গে বাধ্যতামূলকভাবে আন্তর্জাতিকভাবে স্থানান্তরিত হয়।

৭. বাধ্যতামূলক স্থানান্তর: রাজনৈতিক অস্থিরতা, যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা নিপীড়নের কারণে মানুষ বাধ্য হয়ে দেশত্যাগ করে।

৮. ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ: আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্প্রসারণের লক্ষ্যে অনেক উদ্যোক্তা ভিন্ন দেশে ব্যবসায়িকভাবে স্থানান্তর হয়।

৯. উন্নত চিকিৎসা: অনেকেই জটিল রোগের উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে গমন করে।

১০. বিবাহ: আন্তর্জাতিক বিবাহের ফলে স্বামী বা স্ত্রীর সঙ্গে নতুন দেশে বসবাস শুরু হয়।


আন্তর্জাতিক স্থানান্তরের ফলাফলসমূহ

স্থানান্তরের ফলে ব্যক্তিগত, সামাজিক ও জাতীয় পর্যায়ে নানা ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে:

১. অর্থনৈতিক ফলাফল: বিদেশে কর্মরত মানুষ দেশে টাকা পাঠালে তা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সহায়তা করে। তবে স্থানীয় শ্রমবাজারে দক্ষ কর্মীর ঘাটতিও দেখা যায়।

২. উন্নত প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা: বিদেশে প্রশিক্ষণ বা কাজের মাধ্যমে অনেকেই নতুন দক্ষতা অর্জন করে, যা ভবিষ্যতে দেশের জন্য উপকারে আসতে পারে।

৩. মেধা পাচার (Brain Drain): দেশের মেধাবী ও দক্ষ ব্যক্তিরা বিদেশে চলে গেলে দেশে সেই যোগ্যতার অভাব দেখা যায়, যা উন্নয়নের অন্তরায়।

৪. জাতিগত ও সাংস্কৃতিক সমস্যা: বহু দেশ থেকে মানুষ একত্রিত হওয়ায় জাতিগত বৈচিত্র্য তৈরি হয়। তবে এতে সাংস্কৃতিক সংঘাত ও জাতিগত বিরোধও দেখা দিতে পারে।

৫. ধর্মীয় সংমিশ্রণ: বিভিন্ন ধর্মের মানুষের একসঙ্গে বসবাস ধর্মীয় সহনশীলতা বাড়ালেও কিছু ক্ষেত্রে মতবিরোধ সৃষ্টি হতে পারে।

৬. জনসংখ্যার পুনর্বন্টন: কোনো দেশে অভিবাসনের ফলে জনসংখ্যা বেড়ে যেতে পারে, যা আবাসন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থায় চাপ সৃষ্টি করে।

৭. সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সমস্যা: স্থানান্তরিত মানুষ নতুন সমাজে মানিয়ে নিতে সমস্যা অনুভব করে, বিশেষ করে ভাষা, সংস্কৃতি ও সামাজিক আচরণগত পার্থক্যের কারণে।

উপসংহার: আন্তর্জাতিক স্থানান্তর একদিকে যেমন ব্যক্তি ও দেশের জন্য নতুন সম্ভাবনা ও উন্নয়নের দ্বার উন্মোচন করে, অন্যদিকে কিছু চ্যালেঞ্জ ও সমস্যা সৃষ্টি করে। তাই অভিবাসনের সুযোগগুলো কাজে লাগানোর পাশাপাশি এর নেতিবাচক দিকগুলো কমিয়ে আনার জন্য সঠিক পরিকল্পনা ও নীতিমালা গ্রহণ করা জরুরি।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণের প্রতিবন্ধকতা

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণের প্রতিবন্ধকতা

ভূমিকা:- বাংলাদেশের রাজনীতি নারীদের উপস্থিতির অভাবে এখনও পুরুষতান্ত্রিক ধাঁচে পরিচালিত হচ্ছে। যদিও সংবিধান নারী-পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করেছে এবং সংরক্ষিত আসনের মাধ্যমে নারীদের রাজনীতিতে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে, তবুও কার্যকর অংশগ্রহণ এখনো স্বপ্নের মতো। রাজনৈতিক অঙ্গনে নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা এখনো দৃশ্যমান।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণের প্রতিবন্ধকতা


১। রাজনৈতিক সচেতনতার অভাব: নারীদের অনেকেই রাজনৈতিক অধিকার এবং সুযোগ সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন নন। গ্রামীণ ও প্রান্তিক এলাকার নারীদের মধ্যে এই সচেতনতার ঘাটতি বেশি। ফলে রাজনীতি সম্পর্কে আগ্রহ ও অংশগ্রহণের অভাব পরিলক্ষিত হয়।

২। সামাজিক কারণ: বাংলাদেশে এখনো নারীদের মূল ভূমিকা হিসেবে দেখা হয় গৃহস্থালির কাজ এবং সন্তান পালন। সমাজ নারীদের রাজনীতি বা নেতৃত্বের দায়িত্ব নিতে মানসিকভাবে প্রস্তুত নয়। নারী যদি রাজনীতিতে সক্রিয় হতে চায়, তাকে নানা সামাজিক বাধার সম্মুখীন হতে হয়।

৩। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা: আমাদের সমাজ এখনও পুরুষতান্ত্রিক ধ্যানধারণায় পরিচালিত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দল, স্থানীয় প্রশাসন বা নেতৃত্বে পুরুষরাই আধিপত্য বিস্তার করে থাকে। এই কাঠামোর মধ্যে নারীরা অবহেলিত ও উপেক্ষিত থাকে।

৪। পারিবারিক কারণ: অনেক পরিবারই চায় না তাদের মেয়েরা রাজনীতিতে যুক্ত হোক। রাত-বিরাতে বৈঠক, দূরে ভ্রমণ, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব বা সহিংসতা নিয়ে পরিবারের আশঙ্কা থাকে। এসব কারণে পরিবার থেকেই নারীদের নিরুৎসাহিত করা হয়।

৫। ধর্মীয় কারণ: ধর্মের অপব্যাখ্যা করে অনেক সময় নারীদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণকে “অবৈধ” বলে আখ্যা দেওয়া হয়। কিছু ধর্মীয় নেতা ও দল নারীদের ঘরে রাখাকে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সমর্থন করে, যার ফলে নারীরা রাজনীতিতে আসতে দ্বিধাবোধ করেন।

৬। পুরুষ কর্তৃক নিরুৎসাহ প্রদান: রাজনীতিতে অনেক সময় পুরুষ নেতৃত্বের পক্ষ থেকে নারীদের অবমূল্যায়ন করা হয়। তারা নারীদের কণ্ঠকে গুরুত্ব না দিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকেন। এতে নারী সদস্যরা হতাশ হয়ে পড়েন এবং ধীরে ধীরে সরে যান।

৭। শিক্ষাক্ষেত্রে অনগ্রসরতা: রাজনীতি সম্পর্কে সচেতন হতে হলে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু অনেক নারী এখনো শিক্ষাক্ষেত্রে পিছিয়ে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে নারীদের শিক্ষার হার এখনও আশানুরূপ নয়, যা তাদের রাজনৈতিকভাবে সচেতন ও সক্রিয় হওয়ায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।

৮। রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ড: অনেক রাজনৈতিক দল নারীদের শুধুমাত্র প্রতীকীভাবে ব্যবহার করে। নেতৃত্ব বা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নারীদের গুরুত্ব দেওয়া হয় না। তাদের শুধু সংরক্ষিত আসনে সীমাবদ্ধ রেখে কার্যকর অংশগ্রহণ থেকে বঞ্চিত করা হয়।

৯। অভিজ্ঞতার অভাব: রাজনীতিতে টিকে থাকতে হলে অভিজ্ঞতা জরুরি। কিন্তু যেহেতু নারীদের সুযোগ কম, তারা প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারেন না। ফলে নেতৃত্বে আসার সম্ভাবনা হ্রাস পায়।

১০। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অবক্ষয়: রাজনৈতিক সহিষ্ণুতা, বাকস্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ইত্যাদি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অভাব নারীদের জন্য আরো ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরি করে। রাজনীতির সহিংস পরিবেশ নারীদের নিরুৎসাহিত করে।

১১। নারী সমাজের অনীহা: নারীদের একাংশ নিজেরাও রাজনীতি নিয়ে আগ্রহী নন। তারা মনে করেন রাজনীতি কেবল পুরুষদের জন্য। নিজেদের অক্ষম বা অনুপযুক্ত মনে করে রাজনীতি থেকে দূরে থাকেন।

১২। প্রচার মাধ্যমের কার্যক্রম: মিডিয়া অনেক সময় নারীদের নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করে, বিশেষ করে যখন কোনো নারী রাজনৈতিক ব্যর্থতা দেখান। আবার নারী রাজনীতিকদের ব্যক্তিজীবন নিয়েও অহেতুক সংবাদ পরিবেশন করা হয়, যা তাদের মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে।

১৩। ফতোয়াবাজদের দৌরাত্ম্য: কিছু মৌলবাদী গোষ্ঠী ও ফতোয়াবাজরা নারীদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণকে ইসলামবিরোধী বলে চিহ্নিত করে। এই ধরনের প্রচার নারীদের মানসিকভাবে ভয় পাইয়ে দেয় ও রাজনীতি থেকে সরিয়ে রাখে।


উপসংহার: বাংলাদেশে নারীদের রাজনীতিতে কার্যকর অংশগ্রহণের জন্য প্রয়োজন সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা, শিক্ষার প্রসার এবং নিরাপদ রাজনৈতিক পরিবেশ। নারীরা যেন কেবল একটি আসনের জন্য নয়, বরং নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হতে পারেন, সেই প্রচেষ্টা এখন সময়ের দাবি। উন্নত, সমতাভিত্তিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণ অপরিহার্য।

বাংলাদেশের নারী উন্নয়ন নীতিমালা পর্যালোচনা কর

বাংলাদেশের নারী উন্নয়ন নীতিমালা: একটি পর্যালোচনা

ভূমিকা: নারীর ক্ষমতায়নের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত হলো একটি সুসংগঠিত নারী উন্নয়ন নীতিমালা। সমাজে বিদ্যমান জেন্ডার বৈষম্য দূর করে নারীকে সমান অধিকার, সুযোগ ও মর্যাদা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন সময়ে যে নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করেছে, তা-ই নারী উন্নয়ন নীতিমালা নামে পরিচিত। ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৫ সালকে জাতিসংঘ “নারী দশক” হিসেবে ঘোষণা করার পর বাংলাদেশে নারী উন্নয়নে গতি আসে। পরবর্তীতে ১৯৯৭, ২০০৮ ও ২০১১ সালে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ নারী উন্নয়ন নীতিমালা গৃহীত হয়।

বাংলাদেশের নারী উন্নয়ন নীতিমালা পর্যালোচনা কর


১৯৯৭ সালের জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা:

১৯৯৭ সালের নীতিমালা ছিল বাংলাদেশের নারীর ক্ষমতায়নের পথচলার প্রথম দিকের একটি মাইলফলক। এতে নারীর জীবনমান উন্নয়নে নিচের দিকগুলোতে জোর দেওয়া হয়েছিল:

* নারী ও পুরুষের মধ্যে সমতা প্রতিষ্ঠা করা

* নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য দূরীকরণ

* নারীর মানবাধিকার সংরক্ষণ ও বাস্তবায়ন

* নারীকে দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তর

* সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারীর ভূমিকার স্বীকৃতি

* প্রশাসন, শিক্ষা, রাজনীতি, ক্রীড়া সহ সব ক্ষেত্রে সমান সুযোগ সৃষ্টি

* নারীর দারিদ্র্য হ্রাস

* নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা

* নারীর স্বাস্থ্য, প্রযুক্তি, আবাসন ও আশ্রয় নিশ্চিতকরণ

* দুস্থ ও পিছিয়ে পড়া নারীর জন্য বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ

* গণমাধ্যম এ নারীর ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি


২০০৮ সালের জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা:

২০০৮ সালের নীতিমালায় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদ ও নারীর মৌলিক স্বাধীনতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এই নীতিমালার মূল দিকগুলো ছিল:

* নারীর মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতার স্বীকৃতি

* সিডও সনদের বাস্তবায়ন ও প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন

* ধর্মের ব্যাখ্যার নামে নারী-বিরোধী কোনো কাজ রোধ

* মেয়ে শিশুর প্রতি বৈষম্য দূরীকরণ

* নির্যাতন প্রতিরোধ এবং নারী-নিরাপত্তা জোরদার

* শিক্ষা, ক্রীড়া ও সংস্কৃতিতে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি

* অর্থনীতিতে নারীর সমান অংশগ্রহণ ও সুযোগ

* সম-মজুরি, বৈষম্যদূর, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও মাতৃত্বকালীন ছুটি (৫ মাস) নিশ্চিতকরণ


২০১১ সালের জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা:

২০১১ সালের নারী উন্নয়ন নীতিমালা ছিল আগের নীতিমালাগুলোর একটি পরিপূর্ণ সংস্করণ, যেখানে ২২টি স্পষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। এর মধ্যে কিছু প্রধান লক্ষ্য হলো:


* নারীর অধিকার সংরক্ষণ ও দারিদ্র্য বিমোচন

* সকল প্রকার বৈষম্য ও সহিংসতা দূরীকরণ

* অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ

* বাজার-উপযোগী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের সুযোগ সৃষ্টি

* কর্মজীবী নারীদের জন্য ডে-কেয়ার, হোস্টেল, নিরাপদ আবাসন নিশ্চিতকরণ

* পাচার বা সহিংসতার শিকার নারীদের পুনর্বাসন

* রাজনৈতিক ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি

* স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ

* নারী উন্নয়ন মনিটরিং ও মূল্যায়নে প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধি

* জেন্ডার সংবেদনশীলতা ও পরিবেশগত সুরক্ষা

* আবহাওয়া ও পরিবেশের ক্ষতিকর প্রভাব হতে রক্ষার পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত নারীর পূর্ণবাসন।


উপসংহার: বাংলাদেশ সরকারের নারী উন্নয়ন নীতিমালাগুলো সময়ের প্রেক্ষিতে ক্রমাগত উন্নত ও আধুনিক হয়েছে। বিশেষত ২০১১ সালের নীতিমালায় ২২টি লক্ষ্য নির্ধারণ করে নারীর সামগ্রিক ক্ষমতায়নের রূপরেখা তৈরি করা হয়েছে। ১৯৯৭ সালের ভিত্তি ও ২০০৮ সালের আন্তর্জাতিক কাঠামোর সঙ্গে মিল রেখে তৈরি এই নীতিমালাগুলো নারীর অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে।