মেক্সিকো সম্মেলন গৃহীত ৫টি সুপারিশ

মেক্সিকো সম্মেলন গৃহীত ৫টি সুপারিশ

মেক্সিকো সম্মেলন গৃহীত ৫টি সুপারিশ – নারীর অধিকার ও বৈশ্বিক সমতার নতুন দিগন্ত

ভূমিকা: ১৯৭৫ সালকে জাতিসংঘ ঘোষণা করেছিল আন্তর্জাতিক নারী বর্ষ হিসেবে। এই উপলক্ষে ১৯৭৫ সালের ১৯-৩০ জুন পর্যন্ত মেক্সিকো সিটিতে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন, যা ইতিহাসে “মেক্সিকো সম্মেলন” নামে পরিচিত। এই সম্মেলনে বিশ্বের ১৩৩টি দেশের প্রায় ৬,০০০ প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করে। সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল নারীর অধিকার, উন্নয়ন ও শান্তির বিষয়গুলোতে একটি বৈশ্বিক কাঠামো তৈরি করা।


সম্মেলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্জন ছিল “বিশ্ব কর্মপরিকল্পনা ১৯৭৫–১৯৮৫” (World Plan of Action)। এই পরিকল্পনার আলোকে গৃহীত হয় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ, যা বিশ্বের নারীর ক্ষমতায়ন ও বৈষম্যহীন সমাজ গঠনে পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করে।


এখানে আমরা মেক্সিকো সম্মেলনে গৃহীত ৫টি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ বিস্তারিতভাবে তুলে ধরবো।

✅ মেক্সিকো সম্মেলন গৃহীত ৫টি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশসমূহ-

১. নারীর প্রতি সবধরনের বৈষম্য বিলোপ করা:

সম্মেলনের প্রথম ও প্রধান সুপারিশ ছিল—নারীর প্রতি সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে চলমান সব ধরনের বৈষম্য বিলোপের উদ্যোগ গ্রহণ করা। এতে বলা হয়, প্রতিটি দেশ যেন নারীদের জন্য **সমান অধিকার ও সুযোগ** নিশ্চিত করে, বিশেষ করে আইন, উত্তরাধিকার, সম্পত্তির মালিকানা ও নাগরিক অধিকারের ক্ষেত্রে।


২. নারীর শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি ও সমতা প্রতিষ্ঠা:

সম্মেলনে শিক্ষা খাতকে নারীর ক্ষমতায়নের মূল হাতিয়ার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বলা হয়, নারী ও কন্যাশিশুর জন্য সমান শিক্ষার সুযোগ, বিদ্যালয়ে অংশগ্রহণ, কারিগরি ও উচ্চশিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

উল্লেখযোগ্য দিক:

* স্কুলে মেয়েদের ঝরে পড়ার হার কমানো

* মাতৃভাষায় শিক্ষা নিশ্চিত করা

* নারীশিক্ষায় বিশেষ স্কলারশিপ চালু


৩. অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন ও কর্মসংস্থানে সমান সুযোগ

সম্মেলনে নারীকে অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর করার ওপর জোর দেওয়া হয়। সুপারিশ করা হয়—

* নারীদের জন্য সমান মজুরি ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ

* ক্ষুদ্রঋণ, উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ ও ব্যবসায়িক সহায়তা

* অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করা নারীদের স্বীকৃতি ও সুরক্ষা


৪. নারীর স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা নিশ্চিত করা:

সম্মেলনে নারী-স্বাস্থ্যকে একটি মানবিক অধিকার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বলা হয়—

* প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা, মাতৃসেবা ও শিশুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে হবে

* পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কে নারীদের সচেতনতা বাড়াতে হবে

* প্রত্যন্ত অঞ্চল ও দরিদ্র নারীদের জন্য বিশেষ স্বাস্থ্য সুবিধা দিতে হবে


৫. নারীর রাজনৈতিক ও সামাজিক অংশগ্রহণ বাড়ানো:

নারীদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গায় উপস্থিতি বাড়াতে রাষ্ট্রকে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানানো হয়। সুপারিশগুলো হলো—

* স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে নারী প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধি

* রাজনৈতিক সংগঠন ও নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় নারীর সম্পৃক্ততা বাড়ানো

* নারীর নেতৃত্বগুণ বিকাশে প্রশিক্ষণ ও সহায়তা


🔍 অতিরিক্ত সুপারিশ ও বিবেচনাবিষয়ক দিক

মেক্সিকো সম্মেলনে শুধুমাত্র পাঁচটি নয়, আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও আলোচনায় উঠে আসে, যেমন:

* নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা বন্ধে আইনি ও সামাজিক পদক্ষেপ

* নারীশ্রমিকদের নিরাপত্তা ও মাতৃত্বকালীন সুবিধা নিশ্চিতকরণ

* গ্রামীণ নারী, আদিবাসী নারী ও প্রতিবন্ধী নারীদের অধিকার সংরক্ষণ


উপসংহার: মেক্সিকো সম্মেলন ছিল নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটি বৈশ্বিক মাইলফলক। গৃহীত সুপারিশগুলো পরবর্তীতে কোপেনহেগেন (১৯৮০), নাইরোবি (১৯৮৫) এবং বেইজিং (১৯৯৫) সম্মেলনে আরো গভীরভাবে অনুসরণ ও পর্যালোচনা করা হয়।


আজ, যখন আমরা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDGs)-এর বাস্তবায়নের পথে হাঁটছি, তখন এই ঐতিহাসিক সুপারিশগুলো আমাদের জন্য এখনো সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। একবিংশ শতকে নারীর অধিকার ও উন্নয়নের অগ্রগতিতে মেক্সিকো সম্মেলনের অবদান আমরা ভুলে যেতে পারি না।


১. মেক্সিকো সম্মেলন কবে ও কোথায় অনুষ্ঠিত হয়?
মেক্সিকো সম্মেলন ১৯৭৫ সালের ১৯ থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত মেক্সিকো সিটিতে অনুষ্ঠিত হয়। এটি জাতিসংঘের উদ্যোগে আয়োজিত প্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন।
২. মেক্সিকো সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য কী ছিল?
সম্মেলনের মূল লক্ষ্য ছিল নারীর অধিকার, উন্নয়ন এবং শান্তির বিষয়ে একটি বৈশ্বিক কর্মপরিকল্পনা গঠন এবং বিভিন্ন দেশের মধ্যে সমন্বয় সাধন।
৩. সম্মেলনে গৃহীত প্রধান ৫টি সুপারিশ কী কী?
সম্মেলনে গৃহীত ৫টি প্রধান সুপারিশ হলো:
১. নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ
২. নারীর শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি
৩. নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন
৪. স্বাস্থ্যসেবা ও প্রজনন স্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণ
৫. রাজনৈতিক ও সামাজিক অংশগ্রহণে নারীর সক্রিয়তা বৃদ্ধি
৪. মেক্সিকো সম্মেলনের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব কী ছিল?
এই সম্মেলন পরবর্তী নারী সম্মেলনগুলোর ভিত্তি স্থাপন করে (যেমন: কোপেনহেগেন ১৯৮০, নাইরোবি ১৯৮৫, বেইজিং ১৯৯৫)। এটি নারীর অধিকার নিয়ে বিশ্বব্যাপী নীতিমালায় গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে।
৫. এই সুপারিশগুলো কি আজকের সমাজে এখনো প্রাসঙ্গিক?
হ্যাঁ, আজও বিশ্বের অনেক দেশে নারী বৈষম্য, শিক্ষায় পিছিয়ে থাকা, কর্মসংস্থানে সুযোগের ঘাটতি রয়েছে। তাই এই সুপারিশগুলো এখনো বাস্তবায়নের প্রেক্ষিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post