Showing posts with label কার্ল মার্কস. Show all posts
Showing posts with label কার্ল মার্কস. Show all posts

সামাজিক বিপ্লব কি? মার্কসের সামাজিক বিপ্লব এর কারণ ও ফলাফল লিখ

সামাজিক বিপ্লব?  মার্কসের সামাজিক বিপ্লব কারণ ও ফলাফল

ভূমিকা : মার্কসের সমাজতাত্ত্বিক আলোচনার অন্যতম আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো বিপ্লব। মার্কসবাদীদের মতে বিপ্লব হলো ইতিহাসের চালিকাশক্তি এবং প্রগতির জন্য সহায়ক। তারা মনে করেন এটি একটি ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া যা সামাজিক পরিবর্তনের পথকে সুপ্রশস্ত করে। মার্কসীয়দের ভাষায় জনগণ যখন শোষণমূলক সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন ও নিজেদের অবস্থার উন্নয়নের জন্য সংগ্রাম করে সফল হয় তখন তাকে বিপ্লব বলে। তারা এটাকে ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার ফল হিসেবে মনে করে। তারা বিপ্লবকে রাজনৈতিক বিপ্লব হিসেবে দেখে না বরং সমাজ বিপ্লবের তত্ত্ব হিসেবে দেখে থাকেন।

সামাজিক বিপ্লব? কারণ ও ফলাফল


সামাজিক বিপ্লব

সামাজিক বিপ্লব হলো ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে সামাজিক পরিবর্তন সংঘটিত হয় এবং শাসক শ্রেণির পরিবর্তনও সংঘটিত হয়। মার্কসীয়দের মতে সামাজিক প্রগতির জন্য বিপ্লব অপরিহার্য। তারা বিপ্লবকে রাজনৈতিক বিপ্লব হিসেবে না দেখে বরং সামাজিক বিপ্লব হিসেবে দেখে থাকে। তারা মনে করেন এই বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজব্যবস্থার সামগ্রিক রূপান্তর ঘটে। বিদ্যমান শাসক শ্রেণির পরিবর্তে প্রগতিশীল শাসক শ্রেণির উদ্ভব ঘটে। তবে একশ্রেণির হাত থেকে অপর শ্রেণির হাতে শাসন ক্ষমতা অর্পণকে সামাজিক বিপ্লব বলে না। তাই সামরিক বিপ্লব বা প্রাসাদ বিপ্লব সামাজিক বিপ্লব নয়। কারণ সামাজিক বিপ্লবে ব্যক্তি, গোষ্ঠীর সাথে সাথে উৎপাদন সম্পর্কের পরিবর্তন ঘটে। অর্থাৎ পুরো উৎপাদন ব্যবস্থার রূপান্তরের হাতিয়ার হলো সামাজিক বিপ্লব। অর্থাৎ যে বিপ্লবের মাধ্যমে সামগ্রিক ব্যবস্থায় পরিবর্তনের পাশাপাশি সামগ্রিক উৎপাদন ব্যবস্থায় পরিবর্তন সূচিত হলে তবেই সেই বিপ্লব সামাজিক বিপ্লব।

উপসংহার: মার্কসীয় আলোচনায় বিপ্লব একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যয়। তারা এটাকে ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার ফসল হিসেবে মনে করে। তবে তারা বিপ্লবকে 'রাজনৈতিক বিপ্লব' হিসেবে মনে করেন না। তারা এটাকে সামাজিক বিপ্লব মনে করেন। কারণ রাজনৈতিক বিপ্লবের মূল লক্ষ্য হলো শাসকের পরিবর্তন আর মার্কসীয় তথা সামাজিক বিপ্লবের লক্ষ্য whole system এর পরিবর্তন।

মার্কস এর মতে সামাজিক বিপ্লবের কারণ ও ফলাফল আলোচনা কর। 

ভূমিকা : মার্কসবাদী চিন্তাধারার অন্যতম একটি প্রত্যয় হলো বিপ্লব যা মার্কসীয়দের ভাষায় সামাজিক। বিপ্লব। মার্কস ও তার অনুসারীরা তাদের বিপ্লব তত্ত্বকে রাজনৈতিক বিপ্লব মনে করেন না, তারা তাদের বিপ্লব ভাবনাকে সামাজিক বিপ্লব হিসেবে মনে করেন। কেননা রাজনৈতিক বিপ্লবের লক্ষ্য হলো শুধুমাত্র সরকার ও ক্ষমতার পরিবর্তন অপরদিকে মার্কস এর সামাজিক বিপ্লব বা বিপ্লবের মূল লক্ষ্য হলো Whole social system কে পরিবর্তিত করা। মার্কসীয়দের ভাষায় বিপ্লব হলো "জনগণ যখন শোষণমূলক সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন ও নিজেদের অবস্থার উন্নয়নের জন্য সংগ্রাম করে সফল হয় তখন তাকে বিপ্লব বলে।" মার্কস ও তার অনুসারীদের মতে বিপ্লব হলো ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার ফল।

সামাজিক বিপ্লবের কারণ

গোটা মার্কসবাদের মূলকথা হলো "যে সমাজব্যবস্থা সৃষ্টি করেছে শোষণ, নিপিড়ন, বিভেদ সেই সমাজব্যবস্থার আমূল রূপান্তর এবং এই অন্যায় অসম সমাজব্যবস্থার প্রধান শিকার বঞ্চিত উৎপিড়িত বিচ্ছিন্ন শ্রমিক শ্রেণিকে মুক্ত করা।" তিনি বিপব সম্পর্কে কতটুকু প্রত্যয়ী ছিলেন তা তার একটি বাক্য থেকেই উপলব্ধী করা যায়। তিনি লিখেন যে, "দার্শনিক জগৎকে ব্যাখ্যা করেছেন ঠিকই কিন্তু আসল কথা হচ্ছে তাকে বদলে দেওয়া।

মার্কস ও তার অনুসারীদের বিপ্লব সম্পর্কে আলোচনা করলে বিপ্লবের কারণ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। নিচে তাঁদের মতে বিপ্লবের কারণগুলো উলেখ করা হলো:

১. বিপব একটি ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া: মার্কস ও তাঁর অনুসারী চিন্তাবিদরা মনে করেন সামাজিক বিপ্লব একটি ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার ফল। তাঁরা বিপ্লবকে ইতিহাসের চালিকাশক্তি হিসেবে গণ্য করেন। এর মাধ্যমে ঘটে সামাজিক, আসে উৎপাদন ব্যবস্থায় পরিবর্তন, মোট কথা বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজের সামগ্রিক ব্যবস্থায় আসে পরিবর্তন।'

২. সামাজিক বিপ্লব: মার্কসীয়দের মতে সামাজিক অগ্রগতির জন্য বিপ্লব অপরিহার্য। তারা বিপ্লবকে রাজনৈতিক বিপ্লব হিসেবে না দেখে সামাজিক বিপ্লব হিসেবে দেখে থাকেন। কেননা বিপ্লব শুধু শাসক শ্রেণির পরিবর্তন এবং ক্ষমতার পরিবর্তনের নাম নয়। মার্কসীয়দের বিপ্লবের কারণে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর পরিবর্তনের সাথে সাথে উৎপাদন সম্পর্কেরও পরিবর্তন ঘটে। তাই সামগ্রিক সামাজিক ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনয়নের জন্য বিপ্লবের প্রয়োজন যাকে মার্কসবাদীরা সামাজিক বিপ্লব বলে অভিহিত করে থাকেন।

৩. উৎপাদন ব্যবস্থার পরিবর্তন : প্রতিটি সামাজিক ব্যবস্থায় রয়েছে নির্দিষ্ট উৎপাদন ব্যবস্থা। তাই মার্কসীয় বিপ্লবের অন্যতম লক্ষ্য বা কারণ হলো উৎপাদন ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটানো। উৎপাদনের উপকরণের পরিবর্তন হলে উৎপাদন শক্তির পরিবর্তন ঘটে। উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের পরিবর্তনের মাধ্যমে পুরো উৎপাদন ব্যবস্থায় তথা সামাজিক পরিবর্তন বা সামাজিক বিপ্লব সংঘটিত হয়। মার্কস বলেন, "উন্নয়নের এক বিশেষ। পর্যায়ে উৎপাদনের বস্তুগত শক্তিগুলো প্রচলিত উৎপাদন সম্পর্কের সাথে তথা সম্পত্তি সম্পর্কের সাথে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে। উৎপাদন শক্তির উন্নয়নের সাথে এ সম্পর্কসমূহ তাদের শৃঙ্খলের দিকে ধাবিত হয়। তখনই সামাজিক বিপ্লবের পর্যায়ে আসে।"

৪. শ্রেণি সংগ্রাম : শোষণমূলক সমাজের অভ্যন্তরে শ্রেণিদ্বয়ের যে বৈপরীত্য বা দ্বন্দ্ব বিরাজমান থাকে তার ফলেই বিপ্লব সূচিত হয় বলে মার্কসবাদীরা মনে করেন। মার্কসের ভাষায় শ্রেণি সংগ্রামের চূড়ান্ত হলো বিপ্লব। মার্কস অভিমত দেন আদিম সাম্যবাদী ব্যবস্থা ছাড়া সমাজ বিকাশের প্রতিটি স্তর বিপ্লবের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে। বর্তমান যে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা আমরা অতিক্রম করছি সেখানে রয়েছে পুঁজিপতি শ্রেণি ও সর্বহারা শ্রেণি। মার্কসবাদীরা মনে করেন এই দুটি শ্রেণির মধ্যে লড়াই অনিবার্য এবং তারা আরো আশা প্রকাশ করেন যে, এই দুটি শ্রেণির লড়াইয়ের মধ্যদিয়ে নতুন উৎপাদন ব্যবস্থা সূচিত হবে এবং লড়াই বা বিপ্লবের চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবে সর্বহারার একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পাবে।

কার্ল মার্কস তার সামাজিক বিপ্লবের কারণ আলোচনা করতে গিয়ে বিপ্লবকে সামাজিক বিপ্লব হিসেবে অভিহিত করেন এবং বলেন বিপ্লব ঐতিহাসিক ক্রিয়ার ফল। সামাজিক প্রগতির জন্য বিপ্লব অনিবার্য। সমাজ বিকাশের প্রতিটি পর্যায়ে উৎপাদন ব্যবস্থার যে পরিবর্তন লক্ষ করা যায় তার মূলে রয়েছে বিপ্লব এবং বিপ্লবের মধ্যদিয়ে সমাজ এক ব্যবস্থা থেকে অন্য ব্যবস্থায় রূপান্ত রিত হয়েছে এবং অপেক্ষাকৃত প্রগতিশীল হয়েছে।

মার্কসীয় সামাজিক বিপ্লবের ফলাফল

কার্ল মার্কস ও এঙ্গেলস মার্কসীয় ফলাফল হিসেবে কিছু দিকের প্রতি ইংঙ্গিত করেন। বস্তুত মার্কসীয় বিপ্লবের ফলাফল হিসেবে এঙ্গেলস যা বলেন সেটাই বিপ্লবের চূড়ান্ত ফলাফল হিসেবে ধরে নেওয়া যায়। এঙ্গেলস বলেন:

* বিপ্লবের মধ্যদিয়ে উৎপাদন ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন সূচিত হবে।

* উৎপাদন ব্যবস্থায় যে নৈরাজ্য বিদ্যমান, সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে তার অবসান ঘটবে গড়ে উঠবে সুসংগঠিত ব্যবস্থা।

* ব্যক্তি সমাজে টিকে থাকার জন্য যে সংগ্রাম করছে প্রতিনিয়ত তার অবসান ঘটবে।

* সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে মানুষ পরিবেশের দাসত্বের পরিবর্তে পরিবেশের নিয়ন্ত্রক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। 

* বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার ফলে মানুষ এখন নিজের কাজের নিয়ম নিজে তৈরি করবে এবং কাজগুলো নিজের কাজ মনে করে সম্পন্ন করবে।

* এই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে মানুষ প্রয়োজনের রাজ্য ছেড়ে স্বাধীন রাজ্যে পৌছে যাবে।

* আর এই সার্বিক মুক্তির কাজকে সফলভাবে সম্পাদন করাই হলো আধুনিক প্রলেতারিয়েত বা সর্বহারাদের ঐতিহাসিক দায়িত্ব। মূলত মার্কস তার বিপ্লব তত্ত্বে সামাজিক বিপ্লবের কারণকে বিস্তৃত পরিসরে তুলে ধরেছেন। মার্কসীয়রা শ্রেণি ও শ্রেণি দ্বন্দ্বের উপর জোর প্রদান করেন এবং বলেন প্রতিটি সমাজব্যবস্থায় বিদ্যমান দুটি শ্রেণি শাসক ও শাসিত এই দুটি শ্রেণি মধ্যকার দ্বন্দ্বের চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবে বিপ্লবের উত্থান এবং এর ফলে সামাজিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের কথা বলেন যা মূলত সার্বিক উৎপাদন ব্যবস্থার পরিবর্তনের কারণে সংগঠিত হবে।

উপসংহার: উপরের আলোচনার সূত্র ধরে বলা যায় যে,  কার্ল মার্কস ও তাঁর সহযোগীরা বিপবের তত্ত্ব দিয়েই তাদের দায়িত্ব পালন করেননি এবং তাঁরা সাংগঠনিকভাবে এই দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নেন এবং আমৃত্যু তা অব্যাহত রাখেন। তিনি নিজেই সংগঠন গড়ে তোলেন এবং শ্রমিক শ্রেণির অধিকার নিয়ে লড়াই করার ঘোষণা দেন। তবে তার সামাজিক বিপব কতটুকু বাস্তবায়নযোগ্য তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েই যায়। মার্কসবাদী ও তত্ত্বের আলোকে লেনিনের রাশিয়ায় সংঘটিত অক্টোবর বিপবকে ধরা হয়। কিন্তু সেখানে তার ভাবনা কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে। তাও প্রশ্ন সাপেক্ষ। অনেকেই প্রশ্ন তোলেন তার তত্ত্বগুলো আসলেই কি বাস্তবায়নযোগ্য নাকি দার্শনিক ব্যাখ্যা হিসেবে শুধু চমৎকার। এত সমালোচনা সত্ত্বেও দার্শনিক এবং সমাজতাত্ত্বিক চিন্তা জগতে মার্কস এর তত্ত্বের গুরুত্ব অনস্বীকার্য এবং বর্তমান চিন্তা জগৎ এ মার্কসের তত্ত্বের গুরুত্ব অনস্বীকার্য এবং বর্তমান পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা ব্যাখ্যা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ।

সমগ্র মানব জাতির ইতিহাস হলো শ্রেণি সংগ্রামের ইতিহাস- কার্ল মার্কস

সমগ্র মানব জাতির ইতিহাস হলো শ্রেণি সংগ্রামের ইতিহাস

ভূমিকাঃ মানবসমাজের ইতিহাসে সমাজব্যবস্থা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রূপ ধারণ করেছে। ভিন্ন ভিন্ন সমাজব্যবস্থায় শ্রেণিসংগ্রামের প্রকৃতিতেও বিভিন্নতা দেখা যায়। আদিম সমাজব্যবস্থা থেকে আধুনিক সমাজব্যবস্থা বিভিন্ন সমাজব্যবস্থায় শ্রেণি সংগ্রামের বিভিন্ন স্বরূপ সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলো।



১. আদিম সাম্যবাদী সমাজে শ্রেণিসংগ্রামের প্রকৃতি: আদিম সাম্যবাদী সমাজে কোনোরকম শ্রেণিভেদ বা শ্রেণিদ্বন্দ্ব ছিল না। আদিম সাম্যবাদী সমাজে সমাজই ছিল সমগ্র উৎপাদনের মালিক। এই উৎপাদন ছিল সামাজিক উৎপাদন। এই উৎপাদনে সকলের অধিকার ছিল এবং এই অধিকার ছিল সমান। এই উৎপাদন ব্যবস্থায় উৎপাদনের উপাদানসমূহের সঙ্গে সকলের এক ও অভিন্ন সম্পর্ক বর্তমান ছিল। এই সময় শোষক শ্রেণি বা শোষিত শ্রেণি বলে কিছু ছিল না। কিন্তু দাস সমাজব্যবস্থা থেকে আরম্ভ করে পরবর্তী প্রত্যেক পর্যায়ে প্রতিটি সমাজই হলো শ্রেণিবিভক্ত সমাজ। এই সমস্ত সমাজব্যবস্থায় শ্রেণিসংগাত অনিবার্যভাবে এবং অবিরত দেখা দিয়েছে। নতুন উৎপাদনশক্তি সৃষ্টি এবং নতুন উৎপাদন সম্পর্কের আবির্ভাবের পরিপ্রেক্ষিতে আদিম সাম্যবাদী সমাজের বিলুপ্তি ঘটে। তখন থেকেই সমাজ পরস্পর বিরোধী দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই দুটি শ্রেণি হলো শোষক শ্রেণি ও শোণিত শ্রেণি।

২. দাস সমাজে শ্রেণিসংগ্রামের প্রকৃতি: দাস সমাজ বিভক্ত ছিল দাসমালিক ও দাস এই দুই শ্রেণিতে। দাসসমাজের সমগ্র ইতিহাস হলো শ্রেণি দুটির মধ্যে বিরামহীন শ্রেণি সংগ্রামের ইতিহাস। এখানে উৎপাদন উপাদানের সঙ্গে দাস মালিকরা ক্রীতদাসদেরও মালিক ছিল। দাস-সমাজ ব্যবস্থায় উৎপাদন। উপাদানের সঙ্গে দাসমালিকদের সম্পর্ক এবং দাসদের সম্পর্ক ছিল পৃথক ও বিপরীত প্রকৃতির। সমাজ উৎপাদনের উপাদাননসূহের উপর দাস মালিকদের ব্যক্তিগত মালিকানা স্বীকৃতি ছিল। তার ফলে এই সময় দাস ও দাসমালিক এই দুটি শ্রেণির মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ছিল বিরোধিতার। দাসদের শ্রম শোষণ করে মুষ্টিমেয় দাস মালিক কালক্রমে সম্পদশালী হয়ে উঠল এবং তখন সমাজের বৃহত্তম অংশ দাসদের অর্থনৈতিক অবস্থা হয়ে উঠল দুর্বিসহ। এভাবে ক্রমশ স্বার্থের সংগাত তীব্রতর হতে লাগল। এক সময় শ্রেণিদ্বন্দ্ব ব্যাপক আকার ধারণ করল। কালক্রমে মালিক শ্রেণির স্বার্থে সমাজের মধ্যে সৃষ্টি হলো রাষ্ট্র শক্তির। বস্তুত দাসদের উপর দাস-মালিকদের শাসন-শোষণ অব্যাহত রাখার হাতিয়ার হিসেবে রাষ্ট্রের আবির্ভাব ঘটে। সুতরাং সমাজবিকাশের এই পর্যায়ে একটি শ্রেণির উপর আর একটি শ্রেণির শাসন শোষণ কায়েম করার উদ্দেশ্যই রাষ্ট্র যন্ত্র সৃষ্টি করা হয়েছে। দাস সমাজব্যবস্থায় দাস-মালিকদের অর্থনৈতিক ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা সংরক্ষণ করাই হলো রাষ্ট্রের কাজ। এই রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হলো প্রচলিত শ্রেণিশোষণকে অব্যাহত রাখা। দাসদের শোষণ-মুক্তির সংগ্রামকে প্রতিহত করার জন্য এই রাষ্ট্রযন্ত্র সক্রিয় হয়েছে। রোমে স্পার্টাকাসের নেতৃত্বে দাস বিদ্রোহ হয়। এই বিদ্রোহকে নির্মমভাবে স্তব্ধ করা হয়েছে। দাস মালিকদের শোষণ পীড়ন এই থেকে মুক্তির জন্য দাসদের মরণপণ সংগ্রামের বহু নজির মানবজাতির ইতিহাসে বর্তমান।

৩. সামন্ত সমাজে শ্রেণিসংগ্রামের প্রকৃতি : সামন্ত সমাজব্যবস্থায় সমাজ দুই শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল সামন্ত প্রভু এবং ভূমিদাস। এই সমাজে সামন্ত প্রভু ছিল শোষক হিসেবে আর শোষিতের ভূমিকাই ছিল ভূমিদাসরা। সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় ভূস্বামী ও ভূমিদাসরাই ছিল দুটি মুখ্য শ্রেণি। তবে এই সময় মধ্যবর্তী অনেক শ্রেণি ছিল। ভূমিদাস শ্রেণি দাসদের জায়গায়। আবির্ভূত হলো। দাস সমাজের মতো সমাজব্যবস্থায়ও উৎপাদন উপাদানের উপর ব্যক্তিগত মালিকানা স্বীকৃতি ছিল। সামন্ত সমাজের উৎপাদন ব্যবস্থায় উৎপাদন উপকরণের মালিক হলো সামন্ত প্রভু। এই সামন্ত প্রভুরাই কৃষকদের শ্রমক্ষমতাকে শোষণ করেছে। সামন্ত প্রভুরা ভূমিদাস ও কৃষকদের শ্রমক্ষমতাকে শোষণ করেছে। সামন্ত প্রভুরা ভূমিদাস ও কৃষকদের শ্রমক্ষমতা শোষণ করেছে এবং নিজেদের সম্পদসামগ্রী ভাণ্ডারকে ক্রমশ সমৃদ্ধ করেছে। তার ফলে, স্বাভাবিকভাবে এখানে এই দুই শ্রেণির মধ্যে শ্রেণিদ্বন্দ্ব অবশ্যম্ভাবী। এই কারণে সামন্ত যুগের ইতিহাস হলো অসংখ্য কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাস, প্রকৃত প্রস্তাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের এই অধ্যায়ের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে কৃষক বিদ্রোহের অসংখ্য উদাহরণ পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে চতুর্দশ শতাব্দীতে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের কৃষক বিদ্রোহ এবং ষোড়শ শতাব্দীর জার্মানির কৃষক বিদ্রোহ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
সামন্ত সমাজে নতুন নতুন যন্ত্রপাতি আবিষ্কৃত হয় কলকারখানার বিকাশও বিস্তার ঘটে। ব্যবসায়বাণিজ্য সম্প্রসারিত হয়। অর্থাৎ উৎপাদনশক্তি বিকশিত ও উন্নত হয়। তখন সামন্ত অ তান্ত্রিক উৎপাদনসম্পর্কের সঙ্গে তার বিরোধ বাঁধে। বুর্জোয়ারা উন্নত উৎপাদনশক্তির বিকাশ সাধন এবং নতুন উৎপাদন সম্পর্ক সৃষ্টির ব্যাপারে উদ্যোগী হয়। তখন কলকারখানার মালিকদের সঙ্গে সামন্ত প্রভুদের সংঘাত অনিবার্য হয়ে পড়ে।

. ধনতান্ত্রিক সমাজে শ্রেণিসংগ্রামের প্রকৃতি : সাম্প্রতিককালের ধনতান্ত্রিক সমাজেও শিল্পপতি শ্রেণি ও শ্রমিকশ্রেণি বা বুর্জোয়া শ্রেণি ও সর্বহারা শ্রেণি এই দুই শ্রেণিতে বিভক্ত। ধনতান্ত্রিক সমাজে উৎপাদন উপাদানের মালিক হলো শিল্পপতি শ্রেণি। এই শ্রেণিই নিজেদের শ্রেণি স্বার্থে শ্রমিক শ্রেণির উপর শোষণ কায়েম করে। ধনতান্ত্রিক সমাজে শোষণের একটি প্রকৃতি আছে তা হলো শ্রমিক শ্রেণির দ্বারা সৃষ্ট উদ্বৃত্ত-মূল্য আত্মত্মসাৎ করা। এই কারণে এই সমাজে পুঁজিপতি শ্রেণি ও সর্বহারা শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে শ্রেণিসংগ্রাম সৃষ্টি হয়। ধনতান্ত্রিক সমাজ বুর্জোয়া শ্রেণি ও মেহনতি শ্রেণি এই দুটি পরস্পর বিরোধী শ্রেণিতে বিভক্ত। বুর্জোয়াদের শোষণ ক্রমশ ব্লগাহীন হতে থাকে। শ্রমিক শ্রেণির শোষণমুক্তির সংগ্রাম ক্রমশ কঠিনতর হতে থাকে। এইভাবে একসময় সংগঠিত সর্বহারা শ্রেণি রাষ্ট্রশক্তি দখল করার জন্য রাজনীতিক সংগ্রামের সামিল হয়ে থাকে। অর্থনৈতিক সংগ্রাম ব্যক্ত হয় মজুরি বৃদ্ধি, কাজের উন্নত পরিবেশ প্রভৃতির জন্য মিছিল, ধর্মঘট ইত্যাদির মাধ্যমে। তবে, লেনিনের মতানুসারে অর্থনৈতিক সংগ্রামকে প্রধান ও একমাত্র সংগ্রাম হিসেবে গণ্য করা ঠিক নয়। মার্কসের মতানুসারে শ্রেণিসংগ্রাম মাত্রই হলো রাজনৈতিক সংগ্রাম। তিনি বলেছেন- "Every class struggle is a political struggle" সর্বহারার সংগ্রামের প্রধান রুপ হলে রাজনৈতিক সংগ্রাম। শ্রমিক শ্রেণি রাজনৈতিক সংগ্রামের পথে বুর্জোয়া শ্রেণির কাছ থেকে ক্ষমতা দখল করতে পারে। আবার মতাদর্শগত সংগ্রামও রাজনৈতিক সংগ্রামের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। কারণ সর্বহারা শ্রেণির কর্তব্য হলো বৈপ্লবিক পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা। এই সর্বহারা শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে শ্রেণিসচেতনতা সৃষ্টি, বুর্জোয়া মতাদর্শের বিরোধিতা, সংকীর্ণতা ও সংশোধনবাদিত্য পরিহার এবং সর্বহারার বিশ্ব-দৃষ্টিবোধ সৃষ্টির জন্য মতাদর্শগত সংগ্রাম অপরিহার্য।
এই সংগ্রামের ফলস্বরূপ পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার অবসান - ঘটে। তাছাড়া সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানা, শ্রেণিশোষণ প্রভৃতিরও অবসান ঘটে এবং এই সময় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের - উদ্ভব হয়। সর্বহারা শ্রেণির একনায়কতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাই হলো - শ্রেণিসংগ্রামের চূড়ান্ত ও স্বার্থক পরিণতি। আগের শোষণমূলক রাষ্ট্রতন্ত্রের ধ্বংস সাধন এবং শ্রমিকশ্রেণির নিজস্ব শ্রেণিহীন, - শোষণহীন, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগঠন অপরিহার্য। শ্রেণিসংগ্রাম অবশ্যই সর্বহারার একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে মার্কস এই সত্যের নির্দেশ দিয়েছেন। লা ভিন্ন এর এর বুর্জোয়া ঐতিহাসিকরাও শ্রেণিসংগ্রামের বিকাশ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। শ্রেণিসংগ্রামের ধারণা মার্কসের আবিষ্কার নয়। মার্কস নিজেই তা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, "Long before me bourgeois historians has described the historical development of class struggle" কিন্তু বর্জোয়া তাত্ত্বিকরা এই সত্য স্বীকার করেননি যে, শ্রেণিসংগ্রাম অবশ্যম্ভাবী রূপে সর্বহারার একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সর্বহারা শ্রেণি একনায়কতন্ত্রে পরিচালিত হতে থাকে ও সমাজতান্ত্রিক গঠন কার্য এই সময় উৎপাদন উপাদানের সঙ্গে এবং মানুষের সম্পর্কের যাবতীয় বৈষম্য বিলুপ্ত হয়। অর্থাৎ, উৎপাদন সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো রকম পরস্পর বিরোধ শ্রেণি স্বার্থ থাকে না বলে মানুষের দ্বারা মানুষের শোষণেরও অবসান ঘটে। এই পথে শ্রেণিভেদ, শ্রেণিশোষণ ও শ্রেণিদ্বন্দ্বের সমাপ্তির মাধ্যমে সাম্যবাদী সমাজের সৃষ্টি হয়।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, শ্রেণিসংগ্রামকে এক সমাজে পরিবর্তনের হাতিয়ারস্বরূপ। বিভিন্ন সমাজব্যবস্থায় এক শ্রেণি দ্বারা আরেক শ্রেণি শাসন-শোষণের শিকার হয়। শোষণের । এক পর্যায়ে সমাজের শোষিত নিম্ন শ্রেণির মধ্যে শ্রেণি সচেতনতার সৃষ্টি হয় এবং তারা শ্রেণি সংগ্রামে লিপ্ত হয়। এই তর শ্রেণি সংগ্রাম শোষণমূলক সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে এক সাম্যবস্থা ফিরিয়ে আনে। প্রত্যেক শ্রেণিবিভক্ত সমাজে এরূপ মি শ্রেণি সংগ্রাম ঘটে এবং সমাজব্যবস্থায় একটা বড় পরিবর্তন নিয়ে ১ আসে। মার্কসবাদীরা মনে করেন, আধুনিক পুঁজিবাদী শ্রেণিবিভক্ত ক/সমাজে শ্রেণিসংগ্রামের মাধ্যমে শোষণের অবসান ঘটবে এবা ত পরিণতিতে সাম্যবাদী সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিকাশ ঘটতে যেখানে কোন শ্রেণি বিভক্তি ও শোষণ থাকবে না। এ ধারণার ক বিপরীতে সমালোচনা রয়েছে তবে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে সামাজিক পরিবর্তন এর ক্ষেত্রে শ্রেণী সংগ্রামের ভূমিকা রয়েছে।

কার্ল মার্কস (Karl Marx) এর সমাজদর্শন বিস্তারিত বিবর‌ণ। মার্কসবাদের মূলনীতিসমূহ লিখ

কার্ল মার্কসের সমাজদর্শন বিস্তারিত বিবরণ দাও।

অথবা, মার্কসবাদের মূলনীতিসমূহ বর্ণনা কর।

ভূমিকাঃসমাজ বিকাশ ও উৎপাদন ব্যবস্থার উপর ভিত্তি করে  কার্ল মার্কস যে তত্ত্ব প্রদান করেছেন তাই মার্কসীয় তত্ত্ব । অন্যভাবে বলা যায় যে, সমাজ বিবর্তনের সাথে উৎপাদন ব্যবস্থায় দুটি শ্রেণী বিদ্যমান একটি হলো শ্রমিক শ্রেণী অন্যটি মালিক শ্রেণী ।

কার্ল মার্কস (Karl Marx) এর সমাজদর্শন বিস্তারিত বিবরণ দাও


 শ্রমিক শ্রেণী উৎপাদন ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেও তারা নায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত । ফলে শ্রমিকের সাথে মালিকের দ্বন্দ্ব দেখা যায়। আর এ ধরনের দ্বন্দ্ব থেকে রুপ নেয় সংগ্রামের। এ মূল বক্তব্যের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কার্ল মার্কস (Karl Marx) এর মার্কসীয় তত্ত্ব। কোন সমাজের উৎপাদন ব্যবস্থা কোনো একটি শ্রেণীর অনুকূলে কাজ করে।

কার্ল মার্কসের সমাজদর্শন বা মার্কসবাদের মূলনীতিঃ

সমাজ দর্শনে কার্ল মার্কস (Karl Marx) এর সবচেয়ে বড় অবদান হলো সমাজতন্ত্রকে বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করা। কার্ল মার্কসের সমাজদর্শন ইউরোপিয়ান সমাজতন্ত্রের অবাস্তব ও কাল্পনিক গন্ডি থেকে সমাজকে মুক্ত করেন। কার্ল মার্কসের তত্ত্ব কতকগুলো মূলনীতির উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। নিম্নে কার্ল মার্কসের মূলনীতিসমূহ আলোচনা করা হলো-

১। শ্রেণিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠাঃ কার্ল মার্কস (Karl Marx) এর তত্ত্বের অন্যতম একটি মূলনীতি হলো শ্রেণিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। অর্থাৎ সমাজতন্ত্রে মূল লক্ষ্যেই হলো শ্রেণিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। শ্রেণিহীন সমাজ ব্যবস্থায় দরিদ্রের অবসান ঘটে এবং শাসক ও শোষণ ব্যবস্থার অবসান ঘটে।

২। রাষ্ট্রে বিলোপ সাধনঃ কার্ল মার্কস (Karl Marx) এর তত্ত্বের অন্য আরেকটি মূলনীতি হলো রাষ্ট্রের বিলোপ সাধন। সর্বহারা শ্রেণিদের দ্বারা যখন একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে তখন কোনো মানুষের মাঝে আর কোন ভেদাভেদ থাকবে না। অর্থাৎ সবধরনের শ্রেণি বৈষম্য অবসান হবে। শ্রেণি বৈষম্যর পরিপূর্ণ বিলোপসাধনের মধ্যদিয়ে শ্রেণিহীন সমাজের প্রতিষ্ঠা হয়। আর এক সময়ে রাষ্ট্রের প্রয়োজন শেষ হয় বলে রাষ্ট্রের বিলোপ ঘটে।

৩। শ্রমিকশ্রেণীর একনায়কতন্ত্রঃ শ্রেণি বা শ্রেণিদের একনায়কতন্ত্রকে কার্ল মার্কসের সমাজ দর্শন বা মাকর্সবাদের মূলনীতি হিসেবে চিহিৃত করা হয়। ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলোপ সাধনের ফলে সমাজে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়। আর ব্যক্তিগত সম্পত্তির তখনই বিলোপ ঘটে যখন কোনো সংগ্রামের ফলে পুঁজিবাদী তাদের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে এবং ক্ষমতা চলে যাবে শ্রমিক সর্বহারাদের হাতে।

৪। ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যাঃ বস্তুই হলো চরম সত্য একথাটাই মার্কসবাদের মূল কথা। কেননা কোনো বস্তু থেকেই প্রাণ, মন, চেতনার সৃষ্টি। এছাড়া বস্তুই সামাজিক ও মানসিক সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করে।অপরপক্ষে উৎপাদন ব্যবস্থার দ্বারাই ইতিহাসের সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। কেননা উৎপাদন ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটলে সামাজিক পরিবর্তন হয়।

৫। শ্রেণিসংগ্রাম তত্ত্ব মতবাদঃ  কার্ল মার্কস (Karl Marx) এর তত্ত্বের মতে সমাজে যে উৎপাদন পদ্ধতির সৃষ্টি হয়েছে তার উপর ভিত্তি করেই মুলত দুটি শ্রেণির উদ্ভব হয়।যার মধ্যে একটি হলো শাসক শ্রেণি অন্যটি শোষিত শ্রেণি। এ দুটি শ্রেণির স্বার্থ বিপরীত হওয়ায়  তাদের মধ্য দ্বন্দ্ব সংঘাত সবসময় লেগে থাকে। যার ফলে শ্রেণি সংগ্রাম সমাজের রুপান্তর ঘটায়। আর তাদের হারজিতের মাধ্যমে উৎপাদন ব্যবস্থার দ্বারা নতুন সমাজের গোড়াপত্তন ঘটে।

 ৬। সমাজবিপ্লবঃ সমাজ বিপ্লবকে কার্ল মার্কস তত্ত্বের অন্যতম একটি মূলনীতি হিসেবে চিহিৃত করা হয়। সমাজ বিপ্লব বলতে পণ্যের মূল্য পুঁজিপতিদের হাতে থাকার কারণে যখন মধ্যবিত্ত ও শ্রমিক ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং ক্রয় শক্তির অতিরিক্ত পণ্য উৎপাদিত হবে। অপ্রত্যাশিত চাহিদা কমে যাওয়া ও বেকারত্ব বৃদ্ধি পাওয়াকে বোঝায়।

৭। উদ্ধৃত্ত মূল্য মতবাদঃ কার্ল মার্কস (Karl Marx) তত্ত্বের অন্য আরেকটি মূলনীতি হলো  উদ্ধৃত্ত মূল্য মতবাদ। শ্রমিকরা উৎপাদন বৃদ্ধি করার জন্য শ্রম দেয় তবে শ্রমের উপযুক্ত মূল্য শ্রমিকরা পায়না বা তাদের দেওয়া হয়না। উদ্ধৃত্ত মূল্য মতবাদ বলতে  দ্রব্যের বিক্রয়মূল্য এবং দ্রব্য উৎপাদনের জন্য শ্রমিকরা যে মজুরি পায় তার পার্থক্যকে উদ্ধৃত্ত মূল্য তত্ত্ব।

উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, কার্ল মার্কসের তত্ত্বের মূলনীতিসমূহ থেকে কার্ল মার্কস (Karl Marx) তত্ত্বের ধারণা পাওয়া যায়। কেননা কার্ল মার্কস (Karl Marx) তত্ত্বটি একটি বাস্তবভিত্ত্বিক জ্ঞান দান করে ।কার্ল মার্কস (Karl Marx) তত্ত্বের মূল যে বিষয়টি সেটা হলো শাসক শ্রেণি ও শোষিত শ্রেণি এর মধ্যে দ্বন্দ্ব বা সংঘাত। কারণ, এ অবস্থা থেকে সমাজে শ্রেণি সংগ্রামের সূচনা হয়।

Karl Marx কার্ল মার্কসের উদ্বৃত্ত মূল্য তত্ত্ব কী?

মার্কসের উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্ব বলতে কী বুঝায়?

ভূমিকা: মার্কসের অর্থনৈতিক মতবাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্ব বা Surplus value Theory. উদ্বৃত্ত মূল্য তত্ত্বের এই মার্কসীয় সিদ্ধান্ত পুঁজিপতি শোষণের রহস্য উদঘাটন করেছে। এ কারণে পুঁজিতন্ত্রের ধ্বংসের জন্য, নতুন সাম্যবাদী সমাজ সৃষ্টির জন্য সংগ্রামরত শ্রমিকদের হাতে এই শিক্ষা এক অমূল্য অস্ত্র। মার্কসের এই উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্ব তাঁর অর্থনৈতিক তত্ত্বের মূলকথা।
কার্ল মার্কসের উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্ব


উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্ব (Surplus value Theory):

সাধারণ অর্থে উদ্বৃত্ত মূল্য বলতে বুঝায় সেই মূল্যকে যা পুঁজিবাদী সমাজে মালিকশ্রেণি শ্রমিক শোষণ বা তাদের মজুরি কম প্রদান করে মুনাফা হিসেবে যে অতিরিক্ত অংশ লাভ করে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় উৎপাদনের উপকরণের মালিকানা থাকে কয়েকজন ব্যক্তির হাতে। এরা হলেন পুঁজিপতি। অপরদিকে থাকে বিপুল সংখ্যক জনগণ যাদের জীবিকা অর্জনের জন্য পুঁজিপতির কাছে শ্রম বিক্রয় করতে হয়। পুঁজিপতিরা মজুরির বিনিময়ে শ্রমিকের কাছ থেকে শ্রম বিক্রয় করে। কিন্তু শ্রমিকেরা শ্রম দিয়ে যে দ্রব্য উৎপাদন করে তার সমপরিমাণ মজুরি তারা পায় না। অর্থাৎ উৎপন্ন সামগ্রীর বিনিময় মূল্য থেকে যে পরিমাণ মূল্য শ্রমিককে দেওয়া হবে না, তাই হলো উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্ব।


মার্কসের মতে, শ্রমই যেহেতু উৎপাদনের প্রধান উপায় সেহেতু উৎপাদিত মূল্যের প্রদান অংশ শ্রমিকেরই প্রাপ্য। কিন্তু শ্রমিক যা - উৎপাদন করে তার যথার্থ মূল্য সে পায় না। শ্রমিকের উৎপাদিত দ্রব্যমূল্যের বিরাট অংশ মালিক আত্মসাৎ করে মালিকের এই আত্মসাৎ ও মূল্যই হলো উদ্বৃত্ত মূল্য বা Surplus Value, মার্কস বিশ্বাস করতেন নর যে অন্যান্য পণ্যের ন্যায় মানুষের শ্রমশক্তিও পণ্য। এই পণ্যের দুইটি এত মূল্য রয়েছে। যথা: বিনিময় মূল্য ও ব্যবহারিক মূল্য। মার্কস বলেছেন, শ্রমের বিনিময় মূল্য ও ব্যবহারিক মূল্যের মধ্যে পার্থক্য না রয়েছে। কেননা একজন শ্রমিক সারাদিন কাজ করার পর তাকে জীবনধারণের জন্য ন্যূনতম মজুরি দেওয়া হয়। অর্থাৎ যে পরিমাণ শ্রম এম একজন শ্রমিক বিক্রি করে সেই পরিমাণ মজুরি তারা পায় না। প্রং অন্যদিকে পুঁজিবাদী সমাজে পুঁজিপতিরা ইচ্ছাকৃতভাবে শ্রমিকদের ছাঁটাই করে প্রচুর পরিমাণ ভাসমান প্রতিযোগী তৈরি করে যাতে ত্ব শ্রমিকদের দিয়ে স্বল্প মজুরিতে অধিক পরিমাণ মুনাফা অর্জন করা এত যায়। এদিকে শ্রম বিক্রি না করলে শ্রমিকদের যেহেতু বেঁচে থাকার এর উপায় নেই; সেহেতু তারা বাধ্য হয়েই শ্রম বিক্রি করতে রাজী হয়। এর মার্কস বলেছেন, উদ্বৃত্ত মূল্য শ্রমিকদের দ্বারা তৈরি অথচ শ্রমিকরা এর ও প্রাপ্য নয়। তাই মার্কস এই উদ্বৃত্ত মূল্যকে চৌর্যবৃত্তির মাধ্যমে অর্জিত

মূল্য বলে গণনা করেছেন। উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টিকে মার্কসীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নিম্নোক্তভাবে প্রকাশ করা যায়: M-C-M অর্থাৎ পুঁজিপতির টাকা (M-Money) নিয়ে বাজার হতে যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল ও শ্রমশক্তি ক্রয় করে এবং তাদের সমন্বয়ে পণ্য (C-Commodity) উৎপাদন করে তা বাজারে গিয়ে অধিক মূল্যে (M-more money) বিক্রি করে। টাকাই উৎপাদনের শুরু এবং শেষ। পুঁজিপতিদের উৎপাদনের। উদ্দেশ্য মুনাফা অর্জন। অতএব প্রথম M এবং দ্বিতীয় M এর মধ্যে পার্থক্য থাকে। এই প্রথম M এবং দ্বিতীয় M এর মধ্যকার পার্থক্যকেই (M-M) মার্কস উদ্বৃত্ত মূল্য বলেছেন। বিষয়টি একটি সহজ উদাহরণের মাধ্যমে উপস্থাপন করা যায়। যেমন: একজন কাপড় ব্যবসায়ী তার কারখানা থেকে এক বছরে মোট দশ লক্ষ টাকার কাপড় বিক্রি করল। এই কাপড় উৎপাদন করতে তার (কারখানার বাড়ি ভাড়া + যন্ত্রপাতি কাঁচামাল শ্রমিকদের বেতন, বোনাস ও অন্যান্য খরচ বাবদ) মোট ৬ লক্ষ টাকা ব্যয় হয়েছে। তাহলে এক বছরে ঐ ব্যবসায়ীর ১০ লক্ষ ৬ লক্ষ টাকা) = ৪ লক্ষ টাকা মুনাফা হিসাবে পেল। এই ৪ লক্ষ টাকাই = উদ্বৃত্ত মূল্য। এই উদ্বৃত্ত মূল্য দুইভাবে বাড়ানো যায়। যেমন: ১. শ্রম দিনের দৈর্ঘ্য বাড়িয়ে, ২. প্রয়োজনীয় শ্রম-সময় কমিয়ে। মার্কসের মতে শ্রমই পারে উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টি করতে। সুতরাং = শ্রমিককে শোষণ করেই মুনাফা অর্জিত হতে থাকে। মালিকের ন মুনাফা যত বাড়তে থাকে শ্রমিক তত বেশি শোষিত হয়। মালিক 'চায় মজুরি কমাতে এবং কাজের ঘণ্টা বাড়াতে যাতে উদ্বৃত্ত মূল্য বাড়ে। অপরদিকে শ্রমিকরা চায় মজুরি বাড়াতে। এর ফলে শ্রমিক শ্রেণি ও পুঁজিপতিদের মধ্যে শ্রেণিসংগ্রাম অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠে।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, উৎপন্ন সামগ্রীর বিনিময় মূল্য থেকে যে পরিমাণ মূল্য শ্রমিককে না দিয়ে মালিকশ্রেণি তা অতিরিক্ত মুনাফা হিসাবে রেখে দেয় তাই হলো এ উদ্বৃত্ত মূল্য। এর সৃষ্টি হয় মূলত শ্রমিক শোষণের মাধ্যমে এবং পুঁজিপতিরা ইচ্ছাকৃতভাবে উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টি করে। তবে মার্কসীয় দৃষ্টিকোণ থেকে উদ্বৃত্ত মূল্য চৌর্যবৃত্তির সমান। আর এই উদ্বৃত্ত মূল্য নিয়ে মার্কসসহ অন্যান্য তাত্ত্বিক ও দার্শনিক যে তাত্ত্বিক কাঠামো প্রণয়ন করেছে তা উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্ব বা Surplus Value Theory নামে পরিচিত।

মার্কসবাদের বৈশিষ্ট্য লিখ

প্রশ্নঃ মার্কসবাদের বৈশিষ্ট্য লিখ

ভূমিকাঃ- বৈপ্লবিক সমাজচিন্তার ধারক জার্মান দার্শনিক কার্ল হাইনরিশ মার্ক্স । বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের সাথে জড়িত সর্বাধিক জনপ্রিয় নাম হলো কার্ল মার্কস।তিনি তারঁ চিন্তাধারা মননশীলতা এর মাধ্যমে এতই প্রভাবিত হন যে কার্ল মার্ক্সকে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের জনক হিসেবে অভিহিত করা হয়।

মার্কসবাদের বৈশিষ্ট্য লিখ

মার্কবাদের বৈশিষ্ট্যঃ নিম্নে মার্ক্সবাদের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা হলো।

১. শ্রেণি সংগ্রাম তত্ত্ব (Theory of Class Struggle)

মার্কসবাদের একটি মূল বৈশিষ্ট্য হলো শ্রেণি সংগ্রাম তত্ত্ব। এই তত্ত্বের মাধ্যমে কার্ল মার্কস সামাজিক পরিবর্তন এবং ইতিহাসের বিশ্লেষণ করেছেন। তার মতে, সমাজের বিকাশ একটি দীর্ঘ শ্রেণি সংগ্রামের ফলস্বরূপ। প্রতিটি সমাজে দুইটি প্রধান শ্রেণী থাকে — শোষক শ্রেণী এবং শোষিত শ্রেণী। শোষক শ্রেণী তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার মাধ্যমে শোষিত শ্রেণীর উপর প্রভাব বিস্তার করে। এই বৈষম্য এবং শ্রেণিগত দ্বন্দ্বই সমাজের পরিবর্তন ও উন্নতির মূল চালিকা শক্তি।

২. দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ (Dialectical Materialism)

মার্কসের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ হলো তার দর্শনের অপরিহার্য একটি অংশ। তিনি হেগেলের ভাববাদ থেকে প্রভাবিত হলেও, তার দর্শনে কিছু মৌলিক পরিবর্তন আনেন। মার্কসের মতে, হেগেল যেভাবে ভাবকে মূল শক্তি হিসেবে দেখতেন, তিনি তার সেই ধারণার বিরোধিতা করেছেন। মার্কস বলেন, “বস্তুই হলো চরম সত্তা, ভাব নয়।” তার এই দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দর্শন অনুযায়ী, সমাজ এবং ইতিহাসের পরিবর্তন মূলত বস্তুগত বাস্তবতাশ্রেণিগত সম্পর্কের পরিবর্তনের উপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ, মানুষ ও সমাজের পরিবর্তন প্রকৃতির অবস্থা এবং অর্থনৈতিক কাঠামোর মাধ্যমে ঘটে।

৩. ঐতিহাসিক বস্তুবাদ (Historical Materialism)

মার্কসবাদের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ঐতিহাসিক বস্তুবাদ। মার্কস এই তত্ত্বের মাধ্যমে ইতিহাসের বিকাশের পেছনে অর্থনৈতিক সম্পর্ক এবং বস্তুগত অবস্থা কীভাবে কাজ করে তা ব্যাখ্যা করেছেন। তার মতে, সমাজের ইতিহাসের প্রধান চালিকা শক্তি হচ্ছে বস্তুগত উপাদান এবং সেই উপাদানগুলোর উৎপাদন ও পুনর্বন্টনের জন্য গড়ে ওঠা শ্রেণী সম্পর্ক। অর্থাৎ, মানব সমাজের বিকাশ কেবলমাত্র মানসিক বা ভাবগত পরিবর্তনের মাধ্যমে নয়, বরং বস্তুর উৎপাদন ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মাধ্যমে ঘটে।

৪. রাষ্ট্র তত্ত্ব (Theory of State)

মার্কস রাষ্ট্রের ধারণাকে একটি অলৌকিক বা সর্বজনীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখতে অস্বীকার করেছেন। তার মতে, রাষ্ট্র কোনো নিরপেক্ষ বা মানবকল্যাণের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত কোনো সংস্থা নয়, বরং এটি প্রভাবশালী শ্রেণী বা অর্থনৈতিক ক্ষমতার প্রতিনিধিদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত একটি সরকারি সংগঠন, যা শোষিত শ্রেণীকে শোষণ এবং শাসন করার জন্য কাজ করে। রাষ্ট্র আসলে শ্রেণী শোষণের একটি কার্যকরী যন্ত্র হিসেবে কাজ করে, যার মূল উদ্দেশ্য সমাজের শোষিত শ্রেণীর উপর শোষক শ্রেণীর আধিপত্য নিশ্চিত করা।

৫. বিপ্লব তত্ত্ব (Theory of Revolution)

মার্কসের বিপ্লব তত্ত্ব হলো তার সমাজ পরিবর্তন এবং শ্রেণী সংগ্রামের তত্ত্বের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। তার মতে, বিপ্লব একটি অভ্যন্তরীণ সামাজিক প্রক্রিয়া, যা সমাজের পুরানো ধ্যান-ধারণা, কাঠামো এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভেঙে নতুন কিছু সৃষ্টি করার জন্য কাজ করে। মার্কস বিশ্বাস করেন, পুঁজিবাদী সমাজে যে শোষণ চলছে, তাকে পাল্টাতে হবে একটি গণবাহিনীর নেতৃত্বে বিপ্লবের মাধ্যমে, যা শ্রেণী সংগ্রামকে এক নতুন দিক থেকে নতুন সমাজে নিয়ে যাবে।

৬. উদ্বৃত্ত্ব মূল্য তত্ত্ব (Theory of Surplus Value)

উদ্বৃত্ত্ব মূল্য তত্ত্ব হলো মার্কসবাদের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই তত্ত্বের মাধ্যমে মার্কস বুঝিয়েছেন যে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শ্রমিকরা তাদের কাজের মাধ্যমে যে মূল্য তৈরি করে, তার কিছু অংশ শ্রমিকদের কাছে পৌঁছায় না, বরং সেই মূল্য পুঁজির মালিকরা নিয়ে নেয়। সহজভাবে বললে, শ্রমিকরা যে সময় ও শ্রম দেয়, তার বিনিময়ে তারা যা পায়, তা আসলে উৎপাদিত মূল্য থেকে কম, এবং এই অবশিষ্ট মূল্যই হল উদ্বৃত্ত মূল্য, যা পুঁজিপতিরা শোষণ হিসেবে গ্রহণ করেন।

মার্কস বলেছেন, "দ্রব্যের মূল্য নির্ধারণের একমাত্র কারণ হলো, সেই দ্রব্য উৎপাদনের জন্য যে পরিমাণ শ্রম ব্যয় হয়।" অর্থাৎ, উদ্বৃত্ত মূল্য সেই পরিমাণ শোষণ যা শ্রমিকদের উৎপাদিত মূল্য থেকে নিয়ে নেয়া হয়।

উপসংহার:

কার্ল মার্কসের মার্কসবাদের তত্ত্ব আজও আমাদের সমাজ ও অর্থনৈতিক কাঠামো বুঝতে সাহায্য করে। তার তত্ত্বগুলি সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনশ্রেণী সংগ্রামের জন্য প্রেরণা প্রদান করে, এবং তাকে সাম্যবাদী চিন্তার অমর দিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তবে, পুঁজিবাদীদের কাছে তিনি ছিলেন একটি বিপ্লবী অনিষ্টকারী, যার চিন্তা ও তত্ত্ব তাদের প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার জন্য চ্যালেঞ্জ ছিল।

উৎপাদন হতে শ্রমিকের বিচ্ছিন্নতা কার্ল মার্ক্সের মতবাদ

শ্রমিকের বিচ্ছিন্নতা: কার্ল মার্কসের তত্ত্ব ও এর প্রভাব

ভূমিকাঃ শ্রমিকের বিচ্ছিন্নতা বা Alienation একটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব যা কার্ল মার্কস তার The Economic and Philosophical Manuscripts of 1844 গ্রন্থে ব্যাখ্যা করেছেন। মার্কসের মতে, পুঁজিবাদী সমাজে শ্রমিকরা তাদের উৎপাদিত বস্তু এবং কাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, যা তাদের মানবিক বিকাশ এবং পূর্ণতা অর্জনে বাধা সৃষ্টি করে

উৎপাদন হতে শ্রমিকের বিচ্ছিন্নতা কার্ল  মার্কসের মতবাদ



১. উৎপাদিত বস্তু থেকে বিচ্ছিন্নতা:

মার্কসের তত্ত্বের প্রথম অংশ হলো উৎপাদিত বস্তু থেকে শ্রমিকের বিচ্ছিন্নতা। শ্রমিকরা মজুরি বিনিময়ে কাজ করে, কিন্তু তারা যা উৎপাদন করে তা তাদের নিজের হয় না। পুঁজিপতিরা এই উৎপাদন থেকে লাভ অর্জন করে এবং শ্রমিকের শ্রমের পুরস্কার শুধুমাত্র একটি নগণ্য মজুরি। ফলে, শ্রমিকরা তাদের উৎপাদিত বস্তু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং তা তাদের জন্য একটি অপরিচিত বস্তু হয়ে ওঠে। যেহেতু তারা এই বস্তুটির সাথে কোনো সম্পর্ক অনুভব করে না, এটি তাদের কাছে বাইরের এবং অচেনা হয়ে দাঁড়ায়।

২. উৎপাদন কার্য থেকে বিচ্ছিন্নতা:

শ্রমিক যখন তার উৎপাদিত বস্তু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়, তখন সে উৎপাদন কার্য থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। মার্কস বলেছিলেন যে, কাজ যখন একজন শ্রমিকের প্রকৃতির অংশ হয়ে ওঠে না, তখন এটি তার জন্য চাপের মতো মনে হয়। কাজ আর তার আত্মপরিচয়ের অংশ থাকে না, বরং এটি হয়ে ওঠে এক ধরনের বাহ্যিক প্রক্রিয়া যা তাকে মানসিক এবং শারীরিকভাবে ক্লান্ত করে তোলে। শ্রমিক তার কাজকে তার নিজের কাজ মনে করতে পারে না, বরং এটি অন্যের কাজ হিসেবে অনুভব করে, যা আত্মবিনাশের এবং আত্মত্যাগের শামিল হয়ে দাঁড়ায়।

৩. শারীরিক ও মানসিক ক্ষয়:

পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শ্রমিকরা যখন নিজেদের শ্রমের প্রকৃত মূল্য পায় না, তখন তাদের মধ্যে শারীরিক ও মানসিক ক্ষয় শুরু হয়। শ্রমিকরা তাদের কাজ থেকে কোনো আনন্দ বা পূর্ণতা অনুভব করে না এবং এতে তাদের সৃজনশীলতা এবং কর্মক্ষমতা ব্যাহত হয়। এই পরিস্থিতি শ্রমিকদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা ও অস্বস্তি সৃষ্টি করে, যা তাদের জীবনে অমঙ্গল এবং অস্থিরতা নিয়ে আসে।

৪. পুঁজিবাদী শোষণ এবং বিচ্ছিন্নতা:

মার্কসের বিচ্ছিন্নতা তত্ত্ব পুঁজিবাদী শোষণের একটি স্পষ্ট চিত্র। শ্রমিকদের শ্রমের মাধ্যমে যে সম্পদ উৎপাদিত হয়, তা পুঁজিপতিরা নিয়ন্ত্রণ করে এবং শ্রমিকরা তাদের শ্রমের প্রকৃত মূল্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এই পুঁজিবাদী শোষণ শ্রমিকদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবোধ সৃষ্টি করে, যা তাদের মানবিক পূর্ণতা থেকে দূরে রাখে।
উপসংহার: সর্বশেষ বলা যায় যে কার্ল মার্কসের বিচ্ছিন্নতা তত্ত্ব পুঁজিবাদী সমাজের গভীর শোষণ এবং শ্রমিকদের মানবিক বিকাশে বাধা সৃষ্টির ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করেছে। এই তত্ত্ব আজও আধুনিক সমাজে প্রাসঙ্গিক, যেখানে শ্রমিকরা তাদের শ্রমের প্রকৃত মূল্য পায় না এবং সেই কারণে তারা তাদের কাজে এবং উৎপাদনে পূর্ণ মনোযোগ দিতে পারে না। মার্কসের এই তত্ত্ব সমাজবিজ্ঞানে এবং অর্থনীতিতে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠা করেছে যা আজও আমাদের ভাবনায় প্রভাব ফেলছে।

কার্ল মার্কস (Karl Marx) কে ছিলেন? কার্ল মার্ক্সের শ্রেণী সংগ্রাম তত্ত্ব

 📚 কার্ল মার্কসের পরিচয় দাও।

(প্রিলিমিনারী টু মাস্টার্স> সমাজবিজ্ঞান)

ভূমিকাঃ- কার্ল মার্কস (Karl Marx) একজন প্রখ্যাত বিপ্লবী, সমাজ বিজ্ঞানী, এবং অর্থনীতিবিদ হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত। তাঁর তত্ত্বগুলি সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের মূল আধার, যা "মার্কবাদ" নামে পরিচিত। 

কার্ল মার্কস (Karl Marx) কে ছিলেন? কার্ল মার্ক্সের শ্রেণী সংগ্রাম তত্ত্ব

তিনি হেগেলের দান্তিকবাদকে ইতিহাসের বস্তবাদী বিশ্লেষণ (Historical Materialism) হিসেবে রূপান্তরিত করেন, যেখানে ইতিহাসের পরিবর্তনগুলির কারণ হিসেবে অর্থনৈতিক শ্রেণী সম্পর্ক এবং শ্রেণী সংগ্রামকে প্রধান ভূমিকা দেওয়া হয়েছে। তার পদ্ধতিতে মানবিক ও সামাজিক উত্তরণের প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক বিষয়কে একমাত্র কারণ বলে চিহিৃত করা হয়। আন্যদিকে, অর্থনৈতিক উপাদানগুলির মধ্য শ্রেণী সংগ্রাম সর্বাধিক গুরুত্ব পায়।

কার্ল মার্কসের জীবন ও শিক্ষাগত যোগ্যতা

কার্ল মার্কসঃ ঐতিহাসিক দার্শনিক ও সমাজবিজ্ঞানী কার্ল মার্কস ছিলেন জাতিগতভাবে একজন জার্মান ইহুদি। 
জম্মস্থানঃ কার্ল মার্কস প্রশিয়ার রাইনল্যান্ড প্রদেশের ট্রিউস শহরে ১৮১৮ সালে জম্মগ্রহণ করেন।
পিতামাতাঃ কার্ল মার্কসের পিতা  হাইনরিখ মার্কস । তিনি পেশায় একজন আইনজীবী ছিলেন। কার্ল মার্কসের মাতা ছিলেন হল্যান্ডের নাগরিক। পরবর্তীকালে তার মাতা-পিতা খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করলেও তার কোন ধর্মমত ছিলো না।
শিক্ষাঃ কার্ল মার্কস মেধাবী ছাত্র ছিলেন তিনি ট্রিভস এর স্থানীয় স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। অতঃপর প্রথমে বন বিশ্ববিদ্যালয় ও পরবর্তীতে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন শাস্ত্র অধ্যায়ন করেন। কার্ল মার্কস আইন শাস্ত্র অধ্যয়ন করলেও তার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর মধ্য ইতিহাস ও দর্শন ছিলো উল্লেখযোগ্য।
১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে কার্ল মার্কস ইপিজিউরাসের দর্শন এর উপর জেনা বিশ্ববিদ্যালয় হতে পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে ক্রিয়ুস নামক শহরে জেনি ভন ভেস্টফালেনের সাথে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন।
কার্ল মার্কস (Karl Marx) সমাজের বৈষম্য দূরীকরণে যে মূল্যবান অবদান রেখেছেন তার জন্য তিনি ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। কার্ল মার্কস ছিলেন আধুনিক ইতিহাস চর্চা জগৎ এর এক আলোড়িত ব্যক্তিত্ব।

কার্ল মার্কসের (Karl Marx) শ্রেণী সংগ্রাম তত্ত্ব

দূরদর্শী সমাজতাত্ত্বিক কার্ল মার্কস মানব (Karl Marx) সভ্যতার ইতিহাসকে  শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস বলে অভিহিত করেন । এ প্রসঙ্গে তিনি অত্যন্ত যৌক্তিকভাবে ব্যাখ্যা করেন যে, সভ্যতার সূচনা পর্ব থেকে সবল ও ক্ষমতাধর ব্যক্তি বা প্রশাসন অপেক্ষাকৃত দুর্বলব্যক্তি ও রাজ্যের উপর স্বীয় প্রভাব বিস্তার করতে সদা সচেষ্ট থাকে । মার্কসের মতে, শ্রেণী সংগ্রাম একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, যা শেষ পর্যন্ত শোষিত শ্রেণীর বিপ্লব (Revolution) দ্বারা পরিবর্তিত হয়। এই তত্ত্বটি শুধু ইতিহাস বা রাজনীতি নয়, বরং আমাদের সমাজের প্রতিদিনের জীবনেও প্রযোজ্য।কার্ল মার্কসের শ্রেণী সংগ্রাম তত্ত্বের অন্যতম আলোচ্য বিষয় হচ্ছে নির্দিষ্ট উৎপাদন ব্যবস্থায় সমাজের মধ্যকার শ্রেণি সম্পর্ক তুলে ধরা আধুনিক শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রভাবে উদ্ধুদ্ধ হয়ে বঞ্চিত ও শোষিত শ্রেণী তাদের অধিকার আদায়ের জন্য ক্রমশ ট্রেড ইউনিয়ন গঠন সহ নানাবিধ কর্মসূচি গ্রহণ করতে থাকে।
শ্রেণী সংগ্রাম তত্ত্বঃ  কার্ল মার্কস যে সকল তত্ত্ব প্রদান করেছেন তার মধ্য অন্যতম হলো 'শ্রেণী সংগ্রাম তত্ত্ব' (Class Struggle theory)। সময় ও অবস্থার পেক্ষাপটে ঐতিহাসিক নিয়মেই ক্ষমতা, অর্থ ও উৎপাদন ব্যবস্থায় ক্রমশ পরিবর্তন সূচিত হয়। কারণ, অবহেলিত,শোষিত ও বঞ্চিত শ্রেণীর অসন্তষ্টি, ক্ষোভ ও ঘৃণা এক পর্যায়ে আন্দোলন ও বিদ্রোহের আকারে প্রকাশ পায় এবং এভাবে ঐতিহাসিক নিয়মে এগিয়ে চলে ইতিহাস। অতি সুক্ষভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে কার্ল মার্কসের শ্রেণী সংগ্রাম তত্ত্ব (Class struggle theory) প্রতিটি পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও আন্তজার্তিক বিধিব্যবস্থার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। রাষ্ট্রের কর্মকর্তা কর্মচারী ও সাধারণ জনগণও সরকারের কাছ থেকে পর্যাপ্ত বেতন সুযোগ সুবিধা আদায় করতে সদা তৎপর। পক্ষান্তরে সরকার কর্মকর্তা ও কর্মচারীদেরকে অপেক্ষাকৃত কম বেতন ও কম সুযোগ-সুবিধা দিয়ে জনগণের কাছ থেকে পর্যাপ্ত কর আদায় করতে বদ্ধ পরিকর। এবাবে শাসক ও জনগণের মধ্য চলতে থাকে শ্রেণী সংগ্রাম (Class struggle).

উপসংহার
কার্ল মার্কসের তত্ত্বগুলি শুধুমাত্র অতীতের নয়, বরং বর্তমান এবং ভবিষ্যতেও গুরুত্বপূর্ণ। তার শ্রেণী সংগ্রাম তত্ত্ব বিশ্বব্যাপী সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনকে প্রভাবিত করেছে এবং এটি আধুনিক ইতিহাসের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে।

কার্ল মার্কসের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ কি?

কার্ল মার্কসের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ  

দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ

ভূমিকাঃKarl Marx এর দার্শনিক ভিত্তি  এবং তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ বহুত্ববাদী চিন্তাধারার ফলশ্রুতি বস্তুবাদKarl Marx তার সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে যে পদ্ধতিগত কৌশল অবলম্বন করেছেন তাই মূলত বস্তুবাদ (Metrialism) নামে পরিচিত। তার বাস্তবাদের মূলকথা হলো বস্তুই মৌল এবং মন ও সচেতনতা গৌণ, সচেতনতার ভিত্তি হচ্ছে বস্তু। যদি বস্তু জগৎ এ দ্বন্দ না থাকতো তাহলে পৃথিবী আজকের এই আধুনিক অবস্থায় উপনীত হতো না ।
কার্ল মার্কসের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ কি?

দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদঃ  দ্বান্দ্বিক শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো dialectic'. যা  গ্রিক শব্দ `dialego' থেকে উৎপত্তি । যার অর্থ বিতর্ক বা আলোচনার মধ্য দিয়ে সঠিক সিদ্ধান্তেে উপনীত হওয়া। দ্বান্দ্বিকতার প্রকৃত অর্থ হলো পরস্পর বিরোধী দুটি শক্তি সংঘাত জনিত প্রক্রিয়া। কার্ল মার্ক্সের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের বিকাশ ঘটেছিল ১৮৪০ দশকে, যখন মানব সমাজে একটা বৈপ্লবিক শ্রমিক আন্দোলনের বিকাশ ঘটে। তাই দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের বিকাশের কারনে কার্ল মার্কস কে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের জনক বলা হয়।
কার্ল মার্কসের মতে, দ্বন্দ্বের অন্যতম কারণ হলো বস্তুজগৎ। কার্ল মার্কস দ্বন্দ্ববাদকে  ভাববাদ এর প্রভাব থেকে মুক্ত করে করেন ও বস্তুবাদী জগৎ এর পরিবর্তন, রুপান্তর ও বিকাশের মাধ্যমে দ্বন্দ্ববাদের প্রয়োগ ঘটান। তাই মার্কসীয় দ্বন্দ্বমূলক পদ্ধতিকে দ্বন্দ্বিক বস্তুবাদ বলে।
তবে দান্দ্বিক প্রক্রিয়ার কথা প্রথম আলোচনা করেন জার্মান দার্শনিক হেগেল।হেগেলের মতে সৃষ্টিতত্ত্বের পিছনে রয়েছে দ্বন্দ্ব ।কারণ, পৃথিবীতে সবকিছুই পরিবর্তনশীল আর এ সকল পরির্বতন ঘটে থাকে দ্বন্দ্ব থেকে।হেগেল মনে করেন দ্বন্দ্বের কারণ ভাব বা চেতনার ধারণা। বস্তু জগৎ যেখানে  ভাবজগৎ এর উপর নির্ভরশীল , তাই হেগেলের ভাষায় দ্বান্দ্বিক তত্ত্বই হলো ভাববাদ।
Dialectical materialism এর মূল বক্তব্য হলো মানবসমাজের প্রতিটি phenomenon দ্বন্দ্বের মাধ্যম বিকশিত হয়। তাই সমাজ পরিবর্তনের মূল কারণ দ্বন্দ্ব। একটি বিদ্যমান অবস্থার সাথে তার বিপরীত আবস্থার দ্বন্দ্বের ফলে আর একটি নতুন অবস্থার সৃষ্টি হয়। এ অবস্থা আবার তার বিপরীত অবস্থার সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয় এবং তখন নতুন আবার এক অবস্থার সৃষ্টি হয় এভাবেই দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সমাজ বিকশিত হয়।
কার্ল মার্কস এর দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ এবং ঐতিহাসিক বস্তুবাদ সমাজবিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় বিপ্লবস্বরুপ। প্রকৃতপক্ষে, দ্বন্দ্ববাদ সামাজিক স্থিতি, পরিবর্তন, পরির্বতনের প্রকৃতি, মাত্রা ইত্যাদি ব্যাখ্যার মাধ্যমে সমাজবিজ্ঞানের অভূতপূর্ব অগ্রগতিকে সম্ভব করেছে। পরবর্তীতে কার্ল মার্কসবাদী দার্শনিকগণ বস্তুবাদকে প্রকৃত বৈজ্ঞানিক সমাজতত্ত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন।যা, সামাজিক প্রপঞ্চসমূহকে নিরীক্ষামূলক এবং পদ্ধতিতাত্ত্বিক ভিত্তি প্রদান করেন। তাই পদ্ধতিগত কৌশল হিসেবে কার্ল মার্কসের বস্তবাদ সমাজবিজ্ঞানকে সমৃদ্ধ করেছে ।

ঐতিহাসিক বস্তুবাদ 

ঐতিহাসিক বস্তুবাদঃ (Historical materialism):  মার্কসবাদের দ্বিতীয় মৌলনীতি হলো ঐতিহাসিক বস্তুবাদ। একে ইতিহাসের বস্তুবাদী ধারণা ও বলা হয়। 

Stalin এর ভাষায় “ সামাজিক জীবন পাঠে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের প্রয়োগই হলো ঐতিহাসিক বস্তুবাদ”

Hunt এর মতে “ মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের প্রয়োগকে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ বলে।”
মূলত সমাজবিজ্ঞানের সাধারণ নিয়মগুলির অনুশীলনই ঐতিহাসিক বস্তুবাদের কাজ। সমাজকে সম্যকভাবে উপলব্ধিতে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ সাহায্য করে। মূলত মার্কসের ঐতিহাসিক বস্তুবাদ মানব ইতিহাস বিবর্তনের বৈজ্ঞানিক সূত্র। মার্কবাদীরা মনে করেন, বৈষয়িক জীবনের মধ্যেই সামাজিক পরিবর্তনের কারণ নিহিত। 
মূলত সমবেত মানুষের প্রয়াসই ইতিহাস রচনা ও সমাজ পরিবর্তন করে। মার্কসবাদীদের মতে, ইতিহাস মূলত অর্থনৈতিক অবস্থার দ্বারা পরিবর্তিত হয় এবং মানবসমাজের প্রায় সমগ্র দিকগুলো অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। মার্কসের ঐতিহাসিক বস্তুবাদ অনুসারে শ্রম হলো সমাজের অস্তিত্ব ও বিকাশের মূল শক্তি।
মার্কসের মতে শ্রম হলো সম্পদের জনক। মানুষ তার প্রয়োজন মেটাতে শ্রম, প্রাকৃতিক উপাদান, যন্ত্রপাতির মাধ্যমে উৎপাদন করে যাকে বলা হয় উৎপাদন শক্তি। উৎপাদন প্রক্রিয়ায় জড়িত বিভিন্ন মানুষের মধ্যকার সম্পর্ককে বলা হয়েছে (production relations) উৎপাদন সম্পর্ক । উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্ক এ দুই মিলে (mode of production) সমাজবিজ্ঞানের নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। মার্ক বলেছেন সমাজের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ পরিবর্তনের সাথে এর উপরিকাঠামো দ্রুত পরিবর্তন ঘটে।
যাইহোক ঐতিহাসিক বস্তুবাদের মূল কথা হলো সমাজে বিদ্যমান কোন ঘটনাই বিচ্ছিন্নভাবে ঘটে না, প্রত্যেকটি ঘটনা এব অপরের সাথে সম্পর্কিত। তাই সমাজের ঘটনাগুলি বিচ্ছিন্নভাবে বিচার না করে স্থান কাল অবস্থার পটভূমিতে দেখতে হবে। ঐতিহাসিক বস্তুবাদের অর্থ হলো ইতিহাসের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা। কারণ, মার্কস মনে করেন অর্থনৈতিক অবস্থা দ্বারাই ইতিহাস নির্ধারিত হয়।তিনি বলেন উৎপাদন পদ্ধতি পরিবর্তন হলে সমাজ কাঠামোর পরিবর্তন হয় এবং উৎপাদন সম্পর্কের পরিবর্তন হয় তথা ইতিহাসে পরির্বতনের সূচনা হয়।
উপসংহারঃ  সর্ববশেষ লা যায় যে কার্ল মার্কসের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ সমাজবিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার একটি বিশেষ উদাহরণ।