কার্ল মার্কসের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ
দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ
ভূমিকাঃ- Karl Marx এর দার্শনিক ভিত্তি এবং তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ বহুত্ববাদী চিন্তাধারার ফলশ্রুতি বস্তুবাদ। Karl Marx তার সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে যে পদ্ধতিগত কৌশল অবলম্বন করেছেন তাই মূলত বস্তুবাদ (Metrialism) নামে পরিচিত। তার বাস্তবাদের মূলকথা হলো বস্তুই মৌল এবং মন ও সচেতনতা গৌণ, সচেতনতার ভিত্তি হচ্ছে বস্তু। যদি বস্তু জগৎ এ দ্বন্দ না থাকতো তাহলে পৃথিবী আজকের এই আধুনিক অবস্থায় উপনীত হতো না ।
দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদঃ দ্বান্দ্বিক শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো dialectic'. যা গ্রিক শব্দ `dialego' থেকে উৎপত্তি । যার অর্থ বিতর্ক বা আলোচনার মধ্য দিয়ে সঠিক সিদ্ধান্তেে উপনীত হওয়া। দ্বান্দ্বিকতার প্রকৃত অর্থ হলো পরস্পর বিরোধী দুটি শক্তি সংঘাত জনিত প্রক্রিয়া। কার্ল মার্ক্সের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের বিকাশ ঘটেছিল ১৮৪০ দশকে, যখন মানব সমাজে একটা বৈপ্লবিক শ্রমিক আন্দোলনের বিকাশ ঘটে। তাই দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের বিকাশের কারনে কার্ল মার্কস কে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের জনক বলা হয়।
কার্ল মার্কসের মতে, দ্বন্দ্বের অন্যতম কারণ হলো বস্তুজগৎ। কার্ল মার্কস দ্বন্দ্ববাদকে ভাববাদ এর প্রভাব থেকে মুক্ত করে করেন ও বস্তুবাদী জগৎ এর পরিবর্তন, রুপান্তর ও বিকাশের মাধ্যমে দ্বন্দ্ববাদের প্রয়োগ ঘটান। তাই মার্কসীয় দ্বন্দ্বমূলক পদ্ধতিকে দ্বন্দ্বিক বস্তুবাদ বলে।
তবে দান্দ্বিক প্রক্রিয়ার কথা প্রথম আলোচনা করেন জার্মান দার্শনিক হেগেল।হেগেলের মতে সৃষ্টিতত্ত্বের পিছনে রয়েছে দ্বন্দ্ব ।কারণ, পৃথিবীতে সবকিছুই পরিবর্তনশীল আর এ সকল পরির্বতন ঘটে থাকে দ্বন্দ্ব থেকে।হেগেল মনে করেন দ্বন্দ্বের কারণ ভাব বা চেতনার ধারণা। বস্তু জগৎ যেখানে ভাবজগৎ এর উপর নির্ভরশীল , তাই হেগেলের ভাষায় দ্বান্দ্বিক তত্ত্বই হলো ভাববাদ।
Dialectical materialism এর মূল বক্তব্য হলো মানবসমাজের প্রতিটি phenomenon দ্বন্দ্বের মাধ্যম বিকশিত হয়। তাই সমাজ পরিবর্তনের মূল কারণ দ্বন্দ্ব। একটি বিদ্যমান অবস্থার সাথে তার বিপরীত আবস্থার দ্বন্দ্বের ফলে আর একটি নতুন অবস্থার সৃষ্টি হয়। এ অবস্থা আবার তার বিপরীত অবস্থার সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয় এবং তখন নতুন আবার এক অবস্থার সৃষ্টি হয় এভাবেই দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সমাজ বিকশিত হয়।
কার্ল মার্কস এর দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ এবং ঐতিহাসিক বস্তুবাদ সমাজবিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় বিপ্লবস্বরুপ। প্রকৃতপক্ষে, দ্বন্দ্ববাদ সামাজিক স্থিতি, পরিবর্তন, পরির্বতনের প্রকৃতি, মাত্রা ইত্যাদি ব্যাখ্যার মাধ্যমে সমাজবিজ্ঞানের অভূতপূর্ব অগ্রগতিকে সম্ভব করেছে। পরবর্তীতে কার্ল মার্কসবাদী দার্শনিকগণ বস্তুবাদকে প্রকৃত বৈজ্ঞানিক সমাজতত্ত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন।যা, সামাজিক প্রপঞ্চসমূহকে নিরীক্ষামূলক এবং পদ্ধতিতাত্ত্বিক ভিত্তি প্রদান করেন। তাই পদ্ধতিগত কৌশল হিসেবে কার্ল মার্কসের বস্তবাদ সমাজবিজ্ঞানকে সমৃদ্ধ করেছে ।
ঐতিহাসিক বস্তুবাদ
ঐতিহাসিক বস্তুবাদঃ (Historical materialism): মার্কসবাদের দ্বিতীয় মৌলনীতি হলো ঐতিহাসিক বস্তুবাদ। একে ইতিহাসের বস্তুবাদী ধারণা ও বলা হয়।
Stalin এর ভাষায় “ সামাজিক জীবন পাঠে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের প্রয়োগই হলো ঐতিহাসিক বস্তুবাদ”
Hunt এর মতে “ মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের প্রয়োগকে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ বলে।”
মূলত সমাজবিজ্ঞানের সাধারণ নিয়মগুলির অনুশীলনই ঐতিহাসিক বস্তুবাদের কাজ। সমাজকে সম্যকভাবে উপলব্ধিতে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ সাহায্য করে। মূলত মার্কসের ঐতিহাসিক বস্তুবাদ মানব ইতিহাস বিবর্তনের বৈজ্ঞানিক সূত্র। মার্কবাদীরা মনে করেন, বৈষয়িক জীবনের মধ্যেই সামাজিক পরিবর্তনের কারণ নিহিত।
মূলত সমাজবিজ্ঞানের সাধারণ নিয়মগুলির অনুশীলনই ঐতিহাসিক বস্তুবাদের কাজ। সমাজকে সম্যকভাবে উপলব্ধিতে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ সাহায্য করে। মূলত মার্কসের ঐতিহাসিক বস্তুবাদ মানব ইতিহাস বিবর্তনের বৈজ্ঞানিক সূত্র। মার্কবাদীরা মনে করেন, বৈষয়িক জীবনের মধ্যেই সামাজিক পরিবর্তনের কারণ নিহিত।
মূলত সমবেত মানুষের প্রয়াসই ইতিহাস রচনা ও সমাজ পরিবর্তন করে। মার্কসবাদীদের মতে, ইতিহাস মূলত অর্থনৈতিক অবস্থার দ্বারা পরিবর্তিত হয় এবং মানবসমাজের প্রায় সমগ্র দিকগুলো অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। মার্কসের ঐতিহাসিক বস্তুবাদ অনুসারে শ্রম হলো সমাজের অস্তিত্ব ও বিকাশের মূল শক্তি।
মার্কসের মতে শ্রম হলো সম্পদের জনক। মানুষ তার প্রয়োজন মেটাতে শ্রম, প্রাকৃতিক উপাদান, যন্ত্রপাতির মাধ্যমে উৎপাদন করে যাকে বলা হয় উৎপাদন শক্তি। উৎপাদন প্রক্রিয়ায় জড়িত বিভিন্ন মানুষের মধ্যকার সম্পর্ককে বলা হয়েছে (production relations) উৎপাদন সম্পর্ক । উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্ক এ দুই মিলে (mode of production) সমাজবিজ্ঞানের নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। মার্ক বলেছেন সমাজের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ পরিবর্তনের সাথে এর উপরিকাঠামো দ্রুত পরিবর্তন ঘটে।
যাইহোক ঐতিহাসিক বস্তুবাদের মূল কথা হলো সমাজে বিদ্যমান কোন ঘটনাই বিচ্ছিন্নভাবে ঘটে না, প্রত্যেকটি ঘটনা এব অপরের সাথে সম্পর্কিত। তাই সমাজের ঘটনাগুলি বিচ্ছিন্নভাবে বিচার না করে স্থান কাল অবস্থার পটভূমিতে দেখতে হবে। ঐতিহাসিক বস্তুবাদের অর্থ হলো ইতিহাসের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা। কারণ, মার্কস মনে করেন অর্থনৈতিক অবস্থা দ্বারাই ইতিহাস নির্ধারিত হয়।তিনি বলেন উৎপাদন পদ্ধতি পরিবর্তন হলে সমাজ কাঠামোর পরিবর্তন হয় এবং উৎপাদন সম্পর্কের পরিবর্তন হয় তথা ইতিহাসে পরির্বতনের সূচনা হয়।
উপসংহারঃ সর্ববশেষ লা যায় যে কার্ল মার্কসের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ সমাজবিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার একটি বিশেষ উদাহরণ।