সামাজিক বিপ্লব কি? মার্কসের সামাজিক বিপ্লব এর কারণ ও ফলাফল লিখ

সামাজিক বিপ্লব কি? মার্কসের সামাজিক বিপ্লব এর কারণ ও ফলাফল লিখ

সামাজিক বিপ্লব? কারণ ও ফলাফল

ভূমিকা : মার্কসের সমাজতাত্ত্বিক আলোচনার অন্যতম আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো বিপ্লব। মার্কসবাদীদের মতে বিপ্লব হলো ইতিহাসের চালিকাশক্তি এবং প্রগতির জন্য সহায়ক। তারা মনে করেন এটি একটি ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া যা সামাজিক পরিবর্তনের পথকে সুপ্রশস্ত করে। মার্কসীয়দের ভাষায় জনগণ যখন শোষণমূলক সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন ও নিজেদের অবস্থার উন্নয়নের জন্য সংগ্রাম করে সফল হয় তখন তাকে বিপ্লব বলে। তারা এটাকে ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার ফল হিসেবে মনে করে। তারা বিপ্লবকে রাজনৈতিক বিপ্লব হিসেবে দেখে না বরং সমাজ বিপ্লবের তত্ত্ব হিসেবে দেখে থাকেন।

সামাজিক বিপ্লব? কারণ ও ফলাফল


সামাজিক বিপ্লব

সামাজিক বিপ্লব হলো ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে সামাজিক পরিবর্তন সংঘটিত হয় এবং শাসক শ্রেণির পরিবর্তনও সংঘটিত হয়। মার্কসীয়দের মতে সামাজিক প্রগতির জন্য বিপ্লব অপরিহার্য। তারা বিপ্লবকে রাজনৈতিক বিপ্লব হিসেবে না দেখে বরং সামাজিক বিপ্লব হিসেবে দেখে থাকে। তারা মনে করেন এই বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজব্যবস্থার সামগ্রিক রূপান্তর ঘটে। বিদ্যমান শাসক শ্রেণির পরিবর্তে প্রগতিশীল শাসক শ্রেণির উদ্ভব ঘটে। তবে একশ্রেণির হাত থেকে অপর শ্রেণির হাতে শাসন ক্ষমতা অর্পণকে সামাজিক বিপ্লব বলে না। তাই সামরিক বিপ্লব বা প্রাসাদ বিপ্লব সামাজিক বিপ্লব নয়। কারণ সামাজিক বিপ্লবে ব্যক্তি, গোষ্ঠীর সাথে সাথে উৎপাদন সম্পর্কের পরিবর্তন ঘটে। অর্থাৎ পুরো উৎপাদন ব্যবস্থার রূপান্তরের হাতিয়ার হলো সামাজিক বিপ্লব। অর্থাৎ যে বিপ্লবের মাধ্যমে সামগ্রিক ব্যবস্থায় পরিবর্তনের পাশাপাশি সামগ্রিক উৎপাদন ব্যবস্থায় পরিবর্তন সূচিত হলে তবেই সেই বিপ্লব সামাজিক বিপ্লব।

উপসংহার: মার্কসীয় আলোচনায় বিপ্লব একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যয়। তারা এটাকে ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার ফসল হিসেবে মনে করে। তবে তারা বিপ্লবকে 'রাজনৈতিক বিপ্লব' হিসেবে মনে করেন না। তারা এটাকে সামাজিক বিপ্লব মনে করেন। কারণ রাজনৈতিক বিপ্লবের মূল লক্ষ্য হলো শাসকের পরিবর্তন আর মার্কসীয় তথা সামাজিক বিপ্লবের লক্ষ্য whole system এর পরিবর্তন।

মার্কস এর মতে সামাজিক বিপ্লবের কারণ ও ফলাফল আলোচনা কর। 

ভূমিকা : মার্কসবাদী চিন্তাধারার অন্যতম একটি প্রত্যয় হলো বিপ্লব যা মার্কসীয়দের ভাষায় সামাজিক। বিপ্লব। মার্কস ও তার অনুসারীরা তাদের বিপ্লব তত্ত্বকে রাজনৈতিক বিপ্লব মনে করেন না, তারা তাদের বিপ্লব ভাবনাকে সামাজিক বিপ্লব হিসেবে মনে করেন। কেননা রাজনৈতিক বিপ্লবের লক্ষ্য হলো শুধুমাত্র সরকার ও ক্ষমতার পরিবর্তন অপরদিকে মার্কস এর সামাজিক বিপ্লব বা বিপ্লবের মূল লক্ষ্য হলো Whole social system কে পরিবর্তিত করা। মার্কসীয়দের ভাষায় বিপ্লব হলো "জনগণ যখন শোষণমূলক সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন ও নিজেদের অবস্থার উন্নয়নের জন্য সংগ্রাম করে সফল হয় তখন তাকে বিপ্লব বলে।" মার্কস ও তার অনুসারীদের মতে বিপ্লব হলো ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার ফল।

সামাজিক বিপ্লবের কারণ

গোটা মার্কসবাদের মূলকথা হলো "যে সমাজব্যবস্থা সৃষ্টি করেছে শোষণ, নিপিড়ন, বিভেদ সেই সমাজব্যবস্থার আমূল রূপান্তর এবং এই অন্যায় অসম সমাজব্যবস্থার প্রধান শিকার বঞ্চিত উৎপিড়িত বিচ্ছিন্ন শ্রমিক শ্রেণিকে মুক্ত করা।" তিনি বিপব সম্পর্কে কতটুকু প্রত্যয়ী ছিলেন তা তার একটি বাক্য থেকেই উপলব্ধী করা যায়। তিনি লিখেন যে, "দার্শনিক জগৎকে ব্যাখ্যা করেছেন ঠিকই কিন্তু আসল কথা হচ্ছে তাকে বদলে দেওয়া।

মার্কস ও তার অনুসারীদের বিপ্লব সম্পর্কে আলোচনা করলে বিপ্লবের কারণ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। নিচে তাঁদের মতে বিপ্লবের কারণগুলো উলেখ করা হলো:

১. বিপব একটি ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া: মার্কস ও তাঁর অনুসারী চিন্তাবিদরা মনে করেন সামাজিক বিপ্লব একটি ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার ফল। তাঁরা বিপ্লবকে ইতিহাসের চালিকাশক্তি হিসেবে গণ্য করেন। এর মাধ্যমে ঘটে সামাজিক, আসে উৎপাদন ব্যবস্থায় পরিবর্তন, মোট কথা বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজের সামগ্রিক ব্যবস্থায় আসে পরিবর্তন।'

২. সামাজিক বিপ্লব: মার্কসীয়দের মতে সামাজিক অগ্রগতির জন্য বিপ্লব অপরিহার্য। তারা বিপ্লবকে রাজনৈতিক বিপ্লব হিসেবে না দেখে সামাজিক বিপ্লব হিসেবে দেখে থাকেন। কেননা বিপ্লব শুধু শাসক শ্রেণির পরিবর্তন এবং ক্ষমতার পরিবর্তনের নাম নয়। মার্কসীয়দের বিপ্লবের কারণে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর পরিবর্তনের সাথে সাথে উৎপাদন সম্পর্কেরও পরিবর্তন ঘটে। তাই সামগ্রিক সামাজিক ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনয়নের জন্য বিপ্লবের প্রয়োজন যাকে মার্কসবাদীরা সামাজিক বিপ্লব বলে অভিহিত করে থাকেন।

৩. উৎপাদন ব্যবস্থার পরিবর্তন : প্রতিটি সামাজিক ব্যবস্থায় রয়েছে নির্দিষ্ট উৎপাদন ব্যবস্থা। তাই মার্কসীয় বিপ্লবের অন্যতম লক্ষ্য বা কারণ হলো উৎপাদন ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটানো। উৎপাদনের উপকরণের পরিবর্তন হলে উৎপাদন শক্তির পরিবর্তন ঘটে। উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের পরিবর্তনের মাধ্যমে পুরো উৎপাদন ব্যবস্থায় তথা সামাজিক পরিবর্তন বা সামাজিক বিপ্লব সংঘটিত হয়। মার্কস বলেন, "উন্নয়নের এক বিশেষ। পর্যায়ে উৎপাদনের বস্তুগত শক্তিগুলো প্রচলিত উৎপাদন সম্পর্কের সাথে তথা সম্পত্তি সম্পর্কের সাথে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে। উৎপাদন শক্তির উন্নয়নের সাথে এ সম্পর্কসমূহ তাদের শৃঙ্খলের দিকে ধাবিত হয়। তখনই সামাজিক বিপ্লবের পর্যায়ে আসে।"

৪. শ্রেণি সংগ্রাম : শোষণমূলক সমাজের অভ্যন্তরে শ্রেণিদ্বয়ের যে বৈপরীত্য বা দ্বন্দ্ব বিরাজমান থাকে তার ফলেই বিপ্লব সূচিত হয় বলে মার্কসবাদীরা মনে করেন। মার্কসের ভাষায় শ্রেণি সংগ্রামের চূড়ান্ত হলো বিপ্লব। মার্কস অভিমত দেন আদিম সাম্যবাদী ব্যবস্থা ছাড়া সমাজ বিকাশের প্রতিটি স্তর বিপ্লবের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে। বর্তমান যে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা আমরা অতিক্রম করছি সেখানে রয়েছে পুঁজিপতি শ্রেণি ও সর্বহারা শ্রেণি। মার্কসবাদীরা মনে করেন এই দুটি শ্রেণির মধ্যে লড়াই অনিবার্য এবং তারা আরো আশা প্রকাশ করেন যে, এই দুটি শ্রেণির লড়াইয়ের মধ্যদিয়ে নতুন উৎপাদন ব্যবস্থা সূচিত হবে এবং লড়াই বা বিপ্লবের চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবে সর্বহারার একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পাবে।

কার্ল মার্কস তার সামাজিক বিপ্লবের কারণ আলোচনা করতে গিয়ে বিপ্লবকে সামাজিক বিপ্লব হিসেবে অভিহিত করেন এবং বলেন বিপ্লব ঐতিহাসিক ক্রিয়ার ফল। সামাজিক প্রগতির জন্য বিপ্লব অনিবার্য। সমাজ বিকাশের প্রতিটি পর্যায়ে উৎপাদন ব্যবস্থার যে পরিবর্তন লক্ষ করা যায় তার মূলে রয়েছে বিপ্লব এবং বিপ্লবের মধ্যদিয়ে সমাজ এক ব্যবস্থা থেকে অন্য ব্যবস্থায় রূপান্ত রিত হয়েছে এবং অপেক্ষাকৃত প্রগতিশীল হয়েছে।

মার্কসীয় সামাজিক বিপ্লবের ফলাফল

কার্ল মার্কস ও এঙ্গেলস মার্কসীয় ফলাফল হিসেবে কিছু দিকের প্রতি ইংঙ্গিত করেন। বস্তুত মার্কসীয় বিপ্লবের ফলাফল হিসেবে এঙ্গেলস যা বলেন সেটাই বিপ্লবের চূড়ান্ত ফলাফল হিসেবে ধরে নেওয়া যায়। এঙ্গেলস বলেন:

* বিপ্লবের মধ্যদিয়ে উৎপাদন ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন সূচিত হবে।

* উৎপাদন ব্যবস্থায় যে নৈরাজ্য বিদ্যমান, সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে তার অবসান ঘটবে গড়ে উঠবে সুসংগঠিত ব্যবস্থা।

* ব্যক্তি সমাজে টিকে থাকার জন্য যে সংগ্রাম করছে প্রতিনিয়ত তার অবসান ঘটবে।

* সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে মানুষ পরিবেশের দাসত্বের পরিবর্তে পরিবেশের নিয়ন্ত্রক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। 

* বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার ফলে মানুষ এখন নিজের কাজের নিয়ম নিজে তৈরি করবে এবং কাজগুলো নিজের কাজ মনে করে সম্পন্ন করবে।

* এই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে মানুষ প্রয়োজনের রাজ্য ছেড়ে স্বাধীন রাজ্যে পৌছে যাবে।

* আর এই সার্বিক মুক্তির কাজকে সফলভাবে সম্পাদন করাই হলো আধুনিক প্রলেতারিয়েত বা সর্বহারাদের ঐতিহাসিক দায়িত্ব। মূলত মার্কস তার বিপ্লব তত্ত্বে সামাজিক বিপ্লবের কারণকে বিস্তৃত পরিসরে তুলে ধরেছেন। মার্কসীয়রা শ্রেণি ও শ্রেণি দ্বন্দ্বের উপর জোর প্রদান করেন এবং বলেন প্রতিটি সমাজব্যবস্থায় বিদ্যমান দুটি শ্রেণি শাসক ও শাসিত এই দুটি শ্রেণি মধ্যকার দ্বন্দ্বের চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবে বিপ্লবের উত্থান এবং এর ফলে সামাজিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের কথা বলেন যা মূলত সার্বিক উৎপাদন ব্যবস্থার পরিবর্তনের কারণে সংগঠিত হবে।

উপসংহার: উপরের আলোচনার সূত্র ধরে বলা যায় যে,  কার্ল মার্কস ও তাঁর সহযোগীরা বিপবের তত্ত্ব দিয়েই তাদের দায়িত্ব পালন করেননি এবং তাঁরা সাংগঠনিকভাবে এই দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নেন এবং আমৃত্যু তা অব্যাহত রাখেন। তিনি নিজেই সংগঠন গড়ে তোলেন এবং শ্রমিক শ্রেণির অধিকার নিয়ে লড়াই করার ঘোষণা দেন। তবে তার সামাজিক বিপব কতটুকু বাস্তবায়নযোগ্য তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েই যায়। মার্কসবাদী ও তত্ত্বের আলোকে লেনিনের রাশিয়ায় সংঘটিত অক্টোবর বিপবকে ধরা হয়। কিন্তু সেখানে তার ভাবনা কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে। তাও প্রশ্ন সাপেক্ষ। অনেকেই প্রশ্ন তোলেন তার তত্ত্বগুলো আসলেই কি বাস্তবায়নযোগ্য নাকি দার্শনিক ব্যাখ্যা হিসেবে শুধু চমৎকার। এত সমালোচনা সত্ত্বেও দার্শনিক এবং সমাজতাত্ত্বিক চিন্তা জগতে মার্কস এর তত্ত্বের গুরুত্ব অনস্বীকার্য এবং বর্তমান চিন্তা জগৎ এ মার্কসের তত্ত্বের গুরুত্ব অনস্বীকার্য এবং বর্তমান পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা ব্যাখ্যা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ।

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post