সমগ্র মানব জাতির ইতিহাস হলো শ্রেণি সংগ্রামের ইতিহাস
ভূমিকাঃ মানবসমাজের ইতিহাসে সমাজব্যবস্থা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রূপ ধারণ করেছে। ভিন্ন ভিন্ন সমাজব্যবস্থায় শ্রেণিসংগ্রামের প্রকৃতিতেও বিভিন্নতা দেখা যায়। আদিম সমাজব্যবস্থা থেকে আধুনিক সমাজব্যবস্থা বিভিন্ন সমাজব্যবস্থায় শ্রেণি সংগ্রামের বিভিন্ন স্বরূপ সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলো।
১. আদিম সাম্যবাদী সমাজে শ্রেণিসংগ্রামের প্রকৃতি: আদিম সাম্যবাদী সমাজে কোনোরকম শ্রেণিভেদ বা শ্রেণিদ্বন্দ্ব ছিল না। আদিম সাম্যবাদী সমাজে সমাজই ছিল সমগ্র উৎপাদনের মালিক। এই উৎপাদন ছিল সামাজিক উৎপাদন। এই উৎপাদনে সকলের অধিকার ছিল এবং এই অধিকার ছিল সমান। এই উৎপাদন ব্যবস্থায় উৎপাদনের উপাদানসমূহের সঙ্গে সকলের এক ও অভিন্ন সম্পর্ক বর্তমান ছিল। এই সময় শোষক শ্রেণি বা শোষিত শ্রেণি বলে কিছু ছিল না। কিন্তু দাস সমাজব্যবস্থা থেকে আরম্ভ করে পরবর্তী প্রত্যেক পর্যায়ে প্রতিটি সমাজই হলো শ্রেণিবিভক্ত সমাজ। এই সমস্ত সমাজব্যবস্থায় শ্রেণিসংগাত অনিবার্যভাবে এবং অবিরত দেখা দিয়েছে। নতুন উৎপাদনশক্তি সৃষ্টি এবং নতুন উৎপাদন সম্পর্কের আবির্ভাবের পরিপ্রেক্ষিতে আদিম সাম্যবাদী সমাজের বিলুপ্তি ঘটে। তখন থেকেই সমাজ পরস্পর বিরোধী দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই দুটি শ্রেণি হলো শোষক শ্রেণি ও শোণিত শ্রেণি।
২. দাস সমাজে শ্রেণিসংগ্রামের প্রকৃতি: দাস সমাজ বিভক্ত ছিল দাসমালিক ও দাস এই দুই শ্রেণিতে। দাসসমাজের সমগ্র ইতিহাস হলো শ্রেণি দুটির মধ্যে বিরামহীন শ্রেণি সংগ্রামের ইতিহাস। এখানে উৎপাদন উপাদানের সঙ্গে দাস মালিকরা ক্রীতদাসদেরও মালিক ছিল। দাস-সমাজ ব্যবস্থায় উৎপাদন। উপাদানের সঙ্গে দাসমালিকদের সম্পর্ক এবং দাসদের সম্পর্ক ছিল পৃথক ও বিপরীত প্রকৃতির। সমাজ উৎপাদনের উপাদাননসূহের উপর দাস মালিকদের ব্যক্তিগত মালিকানা স্বীকৃতি ছিল। তার ফলে এই সময় দাস ও দাসমালিক এই দুটি শ্রেণির মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ছিল বিরোধিতার। দাসদের শ্রম শোষণ করে মুষ্টিমেয় দাস মালিক কালক্রমে সম্পদশালী হয়ে উঠল এবং তখন সমাজের বৃহত্তম অংশ দাসদের অর্থনৈতিক অবস্থা হয়ে উঠল দুর্বিসহ। এভাবে ক্রমশ স্বার্থের সংগাত তীব্রতর হতে লাগল। এক সময় শ্রেণিদ্বন্দ্ব ব্যাপক আকার ধারণ করল। কালক্রমে মালিক শ্রেণির স্বার্থে সমাজের মধ্যে সৃষ্টি হলো রাষ্ট্র শক্তির। বস্তুত দাসদের উপর দাস-মালিকদের শাসন-শোষণ অব্যাহত রাখার হাতিয়ার হিসেবে রাষ্ট্রের আবির্ভাব ঘটে। সুতরাং সমাজবিকাশের এই পর্যায়ে একটি শ্রেণির উপর আর একটি শ্রেণির শাসন শোষণ কায়েম করার উদ্দেশ্যই রাষ্ট্র যন্ত্র সৃষ্টি করা হয়েছে। দাস সমাজব্যবস্থায় দাস-মালিকদের অর্থনৈতিক ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা সংরক্ষণ করাই হলো রাষ্ট্রের কাজ। এই রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হলো প্রচলিত শ্রেণিশোষণকে অব্যাহত রাখা। দাসদের শোষণ-মুক্তির সংগ্রামকে প্রতিহত করার জন্য এই রাষ্ট্রযন্ত্র সক্রিয় হয়েছে। রোমে স্পার্টাকাসের নেতৃত্বে দাস বিদ্রোহ হয়। এই বিদ্রোহকে নির্মমভাবে স্তব্ধ করা হয়েছে। দাস মালিকদের শোষণ পীড়ন এই থেকে মুক্তির জন্য দাসদের মরণপণ সংগ্রামের বহু নজির মানবজাতির ইতিহাসে বর্তমান।
৩. সামন্ত সমাজে শ্রেণিসংগ্রামের প্রকৃতি : সামন্ত সমাজব্যবস্থায় সমাজ দুই শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল সামন্ত প্রভু এবং ভূমিদাস। এই সমাজে সামন্ত প্রভু ছিল শোষক হিসেবে আর শোষিতের ভূমিকাই ছিল ভূমিদাসরা। সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় ভূস্বামী ও ভূমিদাসরাই ছিল দুটি মুখ্য শ্রেণি। তবে এই সময় মধ্যবর্তী অনেক শ্রেণি ছিল। ভূমিদাস শ্রেণি দাসদের জায়গায়। আবির্ভূত হলো। দাস সমাজের মতো সমাজব্যবস্থায়ও উৎপাদন উপাদানের উপর ব্যক্তিগত মালিকানা স্বীকৃতি ছিল। সামন্ত সমাজের উৎপাদন ব্যবস্থায় উৎপাদন উপকরণের মালিক হলো সামন্ত প্রভু। এই সামন্ত প্রভুরাই কৃষকদের শ্রমক্ষমতাকে শোষণ করেছে। সামন্ত প্রভুরা ভূমিদাস ও কৃষকদের শ্রমক্ষমতাকে শোষণ করেছে। সামন্ত প্রভুরা ভূমিদাস ও কৃষকদের শ্রমক্ষমতা শোষণ করেছে এবং নিজেদের সম্পদসামগ্রী ভাণ্ডারকে ক্রমশ সমৃদ্ধ করেছে। তার ফলে, স্বাভাবিকভাবে এখানে এই দুই শ্রেণির মধ্যে শ্রেণিদ্বন্দ্ব অবশ্যম্ভাবী। এই কারণে সামন্ত যুগের ইতিহাস হলো অসংখ্য কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাস, প্রকৃত প্রস্তাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের এই অধ্যায়ের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে কৃষক বিদ্রোহের অসংখ্য উদাহরণ পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে চতুর্দশ শতাব্দীতে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের কৃষক বিদ্রোহ এবং ষোড়শ শতাব্দীর জার্মানির কৃষক বিদ্রোহ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
সামন্ত সমাজে নতুন নতুন যন্ত্রপাতি আবিষ্কৃত হয় কলকারখানার বিকাশও বিস্তার ঘটে। ব্যবসায়বাণিজ্য সম্প্রসারিত হয়। অর্থাৎ উৎপাদনশক্তি বিকশিত ও উন্নত হয়। তখন সামন্ত অ তান্ত্রিক উৎপাদনসম্পর্কের সঙ্গে তার বিরোধ বাঁধে। বুর্জোয়ারা উন্নত উৎপাদনশক্তির বিকাশ সাধন এবং নতুন উৎপাদন সম্পর্ক সৃষ্টির ব্যাপারে উদ্যোগী হয়। তখন কলকারখানার মালিকদের সঙ্গে সামন্ত প্রভুদের সংঘাত অনিবার্য হয়ে পড়ে।
৪. ধনতান্ত্রিক সমাজে শ্রেণিসংগ্রামের প্রকৃতি : সাম্প্রতিককালের ধনতান্ত্রিক সমাজেও শিল্পপতি শ্রেণি ও শ্রমিকশ্রেণি বা বুর্জোয়া শ্রেণি ও সর্বহারা শ্রেণি এই দুই শ্রেণিতে বিভক্ত। ধনতান্ত্রিক সমাজে উৎপাদন উপাদানের মালিক হলো শিল্পপতি শ্রেণি। এই শ্রেণিই নিজেদের শ্রেণি স্বার্থে শ্রমিক শ্রেণির উপর শোষণ কায়েম করে। ধনতান্ত্রিক সমাজে শোষণের একটি প্রকৃতি আছে তা হলো শ্রমিক শ্রেণির দ্বারা সৃষ্ট উদ্বৃত্ত-মূল্য আত্মত্মসাৎ করা। এই কারণে এই সমাজে পুঁজিপতি শ্রেণি ও সর্বহারা শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে শ্রেণিসংগ্রাম সৃষ্টি হয়। ধনতান্ত্রিক সমাজ বুর্জোয়া শ্রেণি ও মেহনতি শ্রেণি এই দুটি পরস্পর বিরোধী শ্রেণিতে বিভক্ত। বুর্জোয়াদের শোষণ ক্রমশ ব্লগাহীন হতে থাকে। শ্রমিক শ্রেণির শোষণমুক্তির সংগ্রাম ক্রমশ কঠিনতর হতে থাকে। এইভাবে একসময় সংগঠিত সর্বহারা শ্রেণি রাষ্ট্রশক্তি দখল করার জন্য রাজনীতিক সংগ্রামের সামিল হয়ে থাকে। অর্থনৈতিক সংগ্রাম ব্যক্ত হয় মজুরি বৃদ্ধি, কাজের উন্নত পরিবেশ প্রভৃতির জন্য মিছিল, ধর্মঘট ইত্যাদির মাধ্যমে। তবে, লেনিনের মতানুসারে অর্থনৈতিক সংগ্রামকে প্রধান ও একমাত্র সংগ্রাম হিসেবে গণ্য করা ঠিক নয়। মার্কসের মতানুসারে শ্রেণিসংগ্রাম মাত্রই হলো রাজনৈতিক সংগ্রাম। তিনি বলেছেন- "Every class struggle is a political struggle" সর্বহারার সংগ্রামের প্রধান রুপ হলে রাজনৈতিক সংগ্রাম। শ্রমিক শ্রেণি রাজনৈতিক সংগ্রামের পথে বুর্জোয়া শ্রেণির কাছ থেকে ক্ষমতা দখল করতে পারে। আবার মতাদর্শগত সংগ্রামও রাজনৈতিক সংগ্রামের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। কারণ সর্বহারা শ্রেণির কর্তব্য হলো বৈপ্লবিক পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা। এই সর্বহারা শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে শ্রেণিসচেতনতা সৃষ্টি, বুর্জোয়া মতাদর্শের বিরোধিতা, সংকীর্ণতা ও সংশোধনবাদিত্য পরিহার এবং সর্বহারার বিশ্ব-দৃষ্টিবোধ সৃষ্টির জন্য মতাদর্শগত সংগ্রাম অপরিহার্য।
এই সংগ্রামের ফলস্বরূপ পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার অবসান - ঘটে। তাছাড়া সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানা, শ্রেণিশোষণ প্রভৃতিরও অবসান ঘটে এবং এই সময় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের - উদ্ভব হয়। সর্বহারা শ্রেণির একনায়কতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাই হলো - শ্রেণিসংগ্রামের চূড়ান্ত ও স্বার্থক পরিণতি। আগের শোষণমূলক রাষ্ট্রতন্ত্রের ধ্বংস সাধন এবং শ্রমিকশ্রেণির নিজস্ব শ্রেণিহীন, - শোষণহীন, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগঠন অপরিহার্য। শ্রেণিসংগ্রাম অবশ্যই সর্বহারার একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে মার্কস এই সত্যের নির্দেশ দিয়েছেন। লা ভিন্ন এর এর বুর্জোয়া ঐতিহাসিকরাও শ্রেণিসংগ্রামের বিকাশ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। শ্রেণিসংগ্রামের ধারণা মার্কসের আবিষ্কার নয়। মার্কস নিজেই তা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, "Long before me bourgeois historians has described the historical development of class struggle" কিন্তু বর্জোয়া তাত্ত্বিকরা এই সত্য স্বীকার করেননি যে, শ্রেণিসংগ্রাম অবশ্যম্ভাবী রূপে সর্বহারার একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সর্বহারা শ্রেণি একনায়কতন্ত্রে পরিচালিত হতে থাকে ও সমাজতান্ত্রিক গঠন কার্য এই সময় উৎপাদন উপাদানের সঙ্গে এবং মানুষের সম্পর্কের যাবতীয় বৈষম্য বিলুপ্ত হয়। অর্থাৎ, উৎপাদন সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো রকম পরস্পর বিরোধ শ্রেণি স্বার্থ থাকে না বলে মানুষের দ্বারা মানুষের শোষণেরও অবসান ঘটে। এই পথে শ্রেণিভেদ, শ্রেণিশোষণ ও শ্রেণিদ্বন্দ্বের সমাপ্তির মাধ্যমে সাম্যবাদী সমাজের সৃষ্টি হয়।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, শ্রেণিসংগ্রামকে এক সমাজে পরিবর্তনের হাতিয়ারস্বরূপ। বিভিন্ন সমাজব্যবস্থায় এক শ্রেণি দ্বারা আরেক শ্রেণি শাসন-শোষণের শিকার হয়। শোষণের । এক পর্যায়ে সমাজের শোষিত নিম্ন শ্রেণির মধ্যে শ্রেণি সচেতনতার সৃষ্টি হয় এবং তারা শ্রেণি সংগ্রামে লিপ্ত হয়। এই তর শ্রেণি সংগ্রাম শোষণমূলক সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে এক সাম্যবস্থা ফিরিয়ে আনে। প্রত্যেক শ্রেণিবিভক্ত সমাজে এরূপ মি শ্রেণি সংগ্রাম ঘটে এবং সমাজব্যবস্থায় একটা বড় পরিবর্তন নিয়ে ১ আসে। মার্কসবাদীরা মনে করেন, আধুনিক পুঁজিবাদী শ্রেণিবিভক্ত ক/সমাজে শ্রেণিসংগ্রামের মাধ্যমে শোষণের অবসান ঘটবে এবা ত পরিণতিতে সাম্যবাদী সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিকাশ ঘটতে যেখানে কোন শ্রেণি বিভক্তি ও শোষণ থাকবে না। এ ধারণার ক বিপরীতে সমালোচনা রয়েছে তবে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে সামাজিক পরিবর্তন এর ক্ষেত্রে শ্রেণী সংগ্রামের ভূমিকা রয়েছে।