সামাজিক গবেষণার প্রকারভেদ আলোচনা কর।
ভূমিকা: সামাজিক গবেষণা আসলে বৈজ্ঞানিক গবেষণার ভিন্ন রূপ। এই অর্থে বৈজ্ঞানিক গবেষণা যেমন রীতিসিদ্ধ ঠিক তেমনি সামাজিক গবেষণাও রীতিসিদ্ধ। তবে এটা সামাজিক বিষয়ের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠে। মানুষ সমাজ জীবন সম্পর্কে যা জানতে চায় সে দিক আকৃষ্ট হয়ে মানুষ গবেষণার দিকে ধাবিত হয়। সমাজ জীবনের বিভিন্ন দিকের সঠিক চিত্র তুলে ধরে এই সামাজিক গবেষণা। সামাজিক সমস্যা কি কারণে ঘটে তার জন্য সামাজিক গবেষণা সহায়তা করে। একজন গবেষক সবকিছুকে গবেষণার ভিত্তিতে ও উদ্ভাবনের উদ্দেশ্য নিয়ে সবকিছু উদঘাটন করে থাকে। তবে এ গবেষণার জন্য বিশেষ কিছু নিয়ম ও পদ্ধতি রয়েছে।
সামাজিক গবেষণার প্রকারভেদ
গবেষণার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের আলোকে সামাজিক গবেষণাকে দুভাগে ভাগ করা যায়।
যথা: ১. মৌলিক গবেষণা (Basic research)
২. ফলিত গবেষণা (Applied research)
১. মৌলিক গবেষণা (Basic research) : সাধারণত মৌলিক গবেষণাকে Basic research or fundamental research অথবা, Pure research নামেও উল্লেখ করা হয়ে থাকে। সাধারণীকরণ ও তত্ত্ব তৈরি এবং শুধু জ্ঞানের অনুসন্ধানের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করার গবেষণাকে মৌলিক গবেষণা বলে। অন্যভাবে বলা যায়, পৃথিবী ও তার বিভিন্ন ঘটনাবলি সম্পর্কে শুধুমাত্র জ্ঞান অর্জনের জন্য যে গবেষণা কর্ম পরিচালনা করা হয় তাকে মৌলিক গবেষণা বলে।
P. V. Young-এ কে, 'Gathering knowledge for knowledge sake is termed pure or hasic research"
William Pfeiffer বলেন, "Basic research deals with a theoritical problem arising in basic discipline
কোন মৌলিক গবেষণার তাৎক্ষণিক প্রত্যাশা থাকে না, বরং এর ব্যবহার পরোক্ষভাবে হতে পারে। এ ধরনের গবেষণার সাধারণ দৃষ্টিতে মৌলিক গবেষণার দুটি কাজ সম্পন্ন করে। এগুলো নিম্নরূপ:
(ক) নতুন তত্ত্ব আবিষ্কার: মৌলিক গবেষণা এমন তত্ত্ব আবিষ্কার করে, যা সম্পূর্ণ নতুন এবং যার অস্তিত্ব পূর্বে ছিল না এ আবিষ্কার হতে পারে গবেষকের নিজস্ব ধারণ বা কল্পনা থেকে। যে গবেষক যত বেশি প্রতিভাবান, যত বেশি মেধাবী তার আবিষ্কৃত জ্ঞান তত বেশি উৎকৃষ্ট।
(খ) বিদ্যমান তত্ত্বের উন্নয়ন: মৌলিক গবেষণা কোন বিদ্যমান বা প্রচলিত তত্ত্বের কিছু কিছু অনুমানকে সংশোধন বা পরিমার্জন করে বিদ্যমান তত্ত্বের উন্নয়ন সাধন করে। কখন ও কখনও এ ধরনের গবেষণা পুরনো তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে নতুন তত্ত্বের বিকাশ ঘটায়।
২. ফলিত গবেষণা: যে গবেষণা বাস্তব সমস্যা সমাধানে কোন কর্মসূচি প্রণয়ন বা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্য পরিচালিত হয়, তাকে ফলিত গবেষণা বলে। অন্যভাবে বলা যায়, সামাজিক কোন সমস্যার সমাধানের জন্য গবেষণার জ্ঞান আশু প্রয়োগ করা যাবে এমন ফলাফল বিশিষ্ট গবেষণাকে প্রায়োগিক বা ফলিত গবেষণা বলে।
K. D. Baily বলেন, "Applied cach a rosearch with findings that can be applied to dve social problems of immediate concem." (অর্থাৎ, প্রায়োগিক গবেষণা সাম্প্রতিক সমস্যা সম্পর্কিত আবিষ্কার ও সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে পরিচালিত হয়।)
ফলিত বা প্রায়োগিক গবেষণা সামাজিক গবেষণার ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত কাজসমূহের মাধ্যমে অবদান রাখতে পারে।
(i) সমাজে উপকার সাধনের লক্ষ্যে সমাজ থেকে যেসব বিষয়ের জন্য সমর্থন প্রয়োজন তাদের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ফলিত গবেষণা সন্দেহাতীতভাবে বিশ্বাস জন্মানোর ব্যবস্থা করে।
(ii) ফলিত গবেষণা তথাকথিত মৌলিক গবেষণায় ব্যবহৃত কৌশলের উন্নয়ন ঘটাতে সহায়তা করে।
(iii) সাধারণীকরণ (Generalization) প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করার জন্য উপাত্ত ও ধারণা (Concept) সরবরাহ করে।
ফলিত যা ব্যবহারিক গবেষণাকে কতিপয় ভাগে ভাগ করা যায়। তবে এর প্রধান দুটি ভাগ হচ্ছে।
(ক) কার্যক্রম গবেষণা (Action Research)
(খ) মূল্যায়ন গবেষণা (Evaluation Research)
(ক) কার্যক্রম গবেষণা: সামাজিক গবেষণায় অর্থভ্রম গবেষণা একটি নতুন সংযোজন। কোন কর্মসূটির বৃদ্ধির জন্য এবং কর্মসূচির অধিকতর সফলতার জন্য এ গবেষণা কার্য পরিচালনা করা হয়। এর মুখ্য উদেশ্য হচ্ছে শিক্ষা গ্রহণ ও শিক্ষাকে বাস্তব ক্ষেত্রে প্রয়ে Phillips -এর মতে, puming idem and goals to work in an actor wa (কার্যকরী গবেষণার ফলফেণ প্রতাশ অপেক্ষা ভাইভারিয়া মূল্যায়ন করা হয়।
(খ) মুল্যায়ন গবেষণা: প্রবর্তিত কোন কার্যকারিয়া জানার জন্য যে গবেষণা কর্ম পরিচালিত হয় আকে মূল্যায়ন গবেষণা বলে। মূল্যায়ন গবেষণা প্রকৃত পক্ষে এ কর্মসূচি। কার্যকারিতা মূল্যায়নের পাশাপাশি তার লক্ষ্য মাত্রা ও অর্জিত সাফল্যের পার্থক্য নির্দেশ করে এবং একই সাথে কৌশলসমূহের কার্যকারিতাও জানা যায়। মূল্যায়ন পবেষণায় প্রধানত তিন পর্যায়ে হয়ে থাকে যথা।
(i) সহগামী মূল্যায়ন, (ii) পর্যায়ক্রমিক মূল্যায়ন ও (iii) প্রান্তিক মূল্যায়ন।
সামাজিক গবেষণায় ব্যবহৃত পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে গবেষণাকে প্রধানত পাচ ভাগে ভাগ করা যায়। যথা- (i) ঐতিহাসিক গবেষণা (ii) পরীক্ষামুলক গবেষণা (iii) বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ (iv) কেস স্টাডি (v) সামাজিক জরিপ গবেষণা।নিম্নে এগুলো সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।
(i) ঐতিহাসিক গবেষণা (historical research): বর্তমানকে সঠিকভাবে বুঝতে এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সঠিক ধারণা লাভের জন্য সামাজিক গবেষকরা ইতিহাস থেতে তথ্য সংগ্রহ করে সেগুলোর যাচাই বাছাই করে ব্যাখ্যা দান করেন।
(ii) পরীক্ষামূলক গবেষণা (Experimental research): পরীক্ষা পদ্ধতি মূলত প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের গবেষণাতেই ব্যাপকভাবে ও সফলভাবে ব্যবহৃত হয়। এ পদ্ধতিতে গবেষক সুনিয়ন্ত্রিত অবস্থায় একটি চলকের উপর জন্য চলকের প্রভাব এবং বিভিন্ন চলকের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক পর্যবেক্ষণ ও ফলাফল নিরুপন নিন করেন। এরূণ নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় পরীক্ষাধীন চলকের উপর অন্য কোন চলক যেন অনাকাঙ্ক্ষিত প্রভাব বিস্তার না করতে পারে সেজন্য সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়।
(iii) বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ (content analysis): সামাজিকগবেষণার বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ পদ্ধতিতে গবেষণা বিভিন্ন যোগাযোগের মাধ্যমে প্রকাশিত বিষয়বস্তু সংগ্রহ করেন এবং সেগুলোর উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্তে উপনীত হন।
Barnard Berelson বলেছেন, "বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ হচ্ছে গণযোগাযোগের প্রকাশ্য বিষয়বস্তুর বস্তুনিষ্ঠার নিয়মানুগ এবং সংখ্যাগত বর্ণনা প্রদানের গবেষণা কৌশল।"
(iv) কেস স্টাডি (case study): কোন সামাজিক বিষয় বা ঘটনা সম্পর্কে গভীর ও বিস্তারিত জানার জন্য ঘটনা অধ্যয়ন পদ্ধতি বা কেস স্টাডি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি হিসেবে স্বীকৃত। এ সম্পর্কে বলা যায়, "যে বিশেষ ঘটনাটি বিচার করা হচ্ছে সেটি সমস্ত ঘটনার না হলেও সমগোত্রীয় বহু ঘটনার প্রতিনিধিত্ব করে।" যেমন- বাংলাদেশের একটি গ্রামকে যদি Case হিসেবে গ্রহণ করা হয়, তাহলে এমন গ্রামকে নির্বাচন করতে হবে সেটি বাংলাদেশের অধিকাংশ গ্রামের প্রতিনিধিত্ব করে। এরূপ প্রতিনিধিত্বকারী (Typical) গ্রাম সম্পর্কে যা সত্য সাধারণত বাংলাদেশের অধিকাংশ গ্রাম সম্পর্কে তা সত্য হবে বলে ধরে নেয়া যায়।
(v) সামাজিক জরিপ গবেষণা: বর্তমানে সামাজিক গবেষণার জরিপ-গবেষণা অতি পরিচিত ও বহুল প্রচলিত। এ ধরনের গবেষণার গবেষক সরাসরি মাঠ পর্যায়ে থেকে তথ্য সংগ্রহ করে থাকেন। সাধারণত কোন ভৌগোলিক এলাকায় বসবাসকারী জনসমাজের সামাজিক ব্যবস্থার বর্ণনা, সমস্যার প্রকৃতি বর্ণনা, জনগণের মতামত তুলে ধরা ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। অধিকাংশ সামাজিক গবেষণাতেই প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহের লক্ষ্যে জরিপ গবেষণার কলাকৌশল প্রয়োগ করা হয়।
উপসংহার: উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সামাজিক গবেষণা সমাজ কর্মকে তথা-সামাজিক বিজ্ঞানকে সমৃদ্ধ করেছে। আর সামাজিক বিজ্ঞানকে সমৃদ্ধশালী করার জন্য এর বিশেষ কিছু পদ্ধতি রয়েছে। এ পদ্ধতিগুলো অত্যন্ত কার্যকরীভাবে অনুসরণ করা হয়। তবে সমাজকর্মের জন্য বিশেষ কোন নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় না; বরং কয়েকটি পদ্ধতির সমন্বয়ে গঠিত পদ্ধতি অনুসরণীয়। সামাজিক বিজ্ঞানকে সমৃদ্ধশালী করার জন্য সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করা উচিত।