অনুমান কি? উত্তম অনুমানের বৈশিষ্ট্যসমূহ ও গবেষণায় অনুমানের ভূমিকা

অনুমান কি? উত্তম অনুমানের বৈশিষ্ট্যসমূহ ও গবেষণায় অনুমানের ভূমিকা

অনুমান (Assumption) কি? উত্তম অনুমানের বৈশিষ্ট্যাবলি আলোচনা কর। গবেষণায় অনুমানের ভূমিকা লিখ।

ভূমিকা: বৈজ্ঞানিক গবেষণায় অনুমিত সিদ্ধান্তের ন্যায় অনুমানও দিক নির্দেশক হিসেবে কাজ করে। অনুমান মূলত বিভিন্ন প্রকৃতির ধারণা প্রকাশ করে যেগুলো গবেষণার মূল উদ্দেশ্যের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত না হলেও গবেষণা কর্মের যথার্থতা নিরূপণে ভূমিকা পালন করে। গবেষণামূলক কর্মকাণ্ডে অনুমিত সিদ্ধান্ত যেমন দিকনির্দেশক হিসাবে সহায়ক হয় তেমনি অনুমানও গবেষককে তার কর্ম পরিচালনার সহায়তা করে থাকে। আপাত অনুমান ও অনুমিত সিদ্ধান্ত সম্পর্কে মনে হলেও উভয়ের মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান। অনুমিত সিদ্ধান্ত হচ্ছে গবেষণাধীন বিষয়ের একাধিক চলকের মধ্যে সম্পর্কের একটা পরীক্ষামূলক বিবৃতি যার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রয়োজন হয়। পক্ষান্তরে, অনুমান কোন বিষয়ে উল্লিখিত বিবৃতি যা পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রশ্ন না রেখেই মোটামুটি যথার্থ বলে গ্রহণ করা হয়। গবেষণায় অনুমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।

অনুমান কি? উত্তম অনুমানের বৈশিষ্ট্যসমূহ ও গবেষণায় অনুমানের ভূমিকা

অনুমানের সংজ্ঞা: সাধারণভাবে বলা যায় যে, অনুমান হলো একটা বিবৃতি যা পরীক্ষা নিরীক্ষার কোন অবকাশ না রেখে যথার্থ বলে ধরে নেয়া হয় এবং এর উপর ভিত্তি করে গবেষক গবেষণা পরিচালনা করে সিদ্ধান্তে উপনীত হন।

অন্যভাবে বলা যায়, বিশ্লেষণাধীন বিষয়ের একটি নির্দিষ্ট দিকের সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করাই হলো অনুকল্প আর এক্ষেত্রে একই বিষয় সম্পর্কিত কিছু কিছু দিক সংশ্লিষ্ট গবেষণায় সত্য বলে ধরে নেয়াই হলো অনুমান।

আবার বলা যায়, অনুমান হচ্ছে প্রমাণাদির উদ্দেশ্য ছাড়াই কোন বিবৃতিকে সত্য বলে ধরে নেয়া।

Lillian Ripple বলেন, "An assumption is a proposition that is taken a given in the particular investigation." (অর্থাৎ, একটি নির্দিষ্ট অনুমান কর্মে গৃহীত কোন প্রস্তাবনাকে হুবহু গ্রহণ করাই অনুমান)।

K. D. Bailey বলেন, "অনুমান হচ্ছে এমন এক প্রস্তাবনা, যা পরীক্ষাযোগ্য আকারে বিবৃত এবং যা দুই বা ততোধিক চলকসমূহের বিশেষ সম্পর্ক সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী করে।"

Black and Champion-এর মতে, "কোন বিষয় সম্পর্কে আপাত স্থিরকৃত বিবৃতি, যা গবেষক সমর্থন করতে অথবা খণ্ডন করতে চায়।

Laroy Christensen and Charles Stoup বলেছেন, "কোন গবেষণায় অনুমান হচ্ছে উক্ত গবেষণার ফলাফল সম্পর্কে সর্বোত্তম অনুমান না ভবিষ্যদ্বাণী।"

এ. এস. এম. আতীকুর রহমান, বলেছেন, "একই বিষয় সম্পর্কিত কিছু কিছু দিক সংশ্লিষ্ট গবেষণায় সত্য বলে ধরে নেয়াই হলো অনুমান।"

উত্তম অনুমানের বৈশিষ্ট্যসমূহ

উত্তম অনুমানের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য রয়েছে তার মধ্য প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নে উপস্থাপন করা হলো:

১. ধারণাগত স্পষ্টতা: অনুমান ব্যবহৃত ধারণাসমূহ সুস্পষ্ট এবং সকলের কাছে বোধগম্য হতে হবে। ব্যবহৃত ধারণাগুলোর অস্পষ্টতা এবং দ্ব্যর্থকতা অবশ্যই পরিহার করতে হবে। এজন্য গবেষক ব্যবহৃত ধারণাগুলোর কার্যকর সংজ্ঞা প্রদান করবেন। কোন গবেষণার একাধিক অর্থ থাকলে সে ক্ষেত্রে গবেষণার সাথে সংগতিপূর্ণ অর্থটি গ্রহণ করবেন। সুস্পষ্ট ধারণাসমূহের সমন্বয়ে গঠিত অনুমান সহজবোধ্য কার্য উপযোগী ও সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য।

২. বাস্তব অভিজ্ঞতা: ভিত্তিক অনুমান বাস্তব অভিজ্ঞতা ভিত্তিক হওয়া প্রয়োজন। কেননা, বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে উদ্ভূত অনুমান বেশি গবেষণামূলক হয়। অনুরূপভাবে, উত্তম অনুমান নৈতিকতার প্রশ্নের সাথে জড়িত থাকে না। কেননা, নৈতিকতার সাথে জড়িত অনুমানকে বাস্তভিত্তিক ও বৈজ্ঞানিকভাবে পরীক্ষা- নিরীক্ষা করা কঠিন।

৩. পর্যবেক্ষণযোগ্যতা: গৃহীত অনুমানকে পরীক্ষাযোগ্য ও যাচাইযোগ্য হতে হবে। এমন অনেক প্রশ্ন আছে যেগুলোর সত্যাসত্য যাচাই করা যায় না। বিশেষ করে অনুমানের বিষয় পর্যবেক্ষণযোগ্য না হলে তা পরীক্ষা ও যাচাই করা যায় না। এজন্য অনুমানের বিষয়কে পর্যবেক্ষণযোগ্য হতে হয়।

৪. বিষয়বস্তুর স্পষ্টতা: অনুমানের বিষয়বস্তুকে সহজ, সরল ও স্পষ্ট হতে হবে। কি অনুমান করা হচ্ছে এবং কি বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা হবে এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট উল্লেখ থাকতে হবে। অন্যথায়, অনুমান গবেষণার নির্দেশক হিসেবে ভূমিকা পালন করতে পারে না।

৫. সংক্ষিপ্ত আকৃতি: অনুমানের আকৃতি খুব বড় আকারের হওয়া উচিত নয়। কারণ বৃহৎ আকৃতির অনুমানে অনেক বেশি ধারণা ব্যবহার করা হয়। যেগুলের বিভিন্ন রকমের অর্থ থাকে। এর ফলে অনুমানে অহেতুক জটিলতা ও দ্ব্যর্থকতা সৃষ্টি হতে পারে। এজন্য অনুমান যতটা সম্ভব সংক্ষিপ্ত ও অর্থবোধক হওয়া বাঞ্ছনীয়।

৬. সম্পর্কযুক্ত পদ্ধতি: গৃহীত অনুমান যাচাই করার উপযোগী পদ্ধতি সম্পর্কে গবেষকের ধারণা থাকতে হবে। প্রয়োজনীয় ধারণার অভাবে গবেষক সঠিক অনুমান করতে পারবেন না। পদ্ধতির সাথে সম্পর্কহীন অনুমান বাস্তবে যাচাইযোগ্য নয় এবং গ্রহণযোগ্য ও নয়।

৭. তত্ত্বভিত্তিক অনুমান: তত্ত্ব অনুমান গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অনুমান যাচাই করে কোন তত্ত্ব গ্রহণ বা বাতিল করা হয় এবং নতুন তত্ত্ব নির্মিত হয়। তত্ত্ব ও অনুমানের এরূপ পারস্পরিক সম্পর্কের কারণে অনুমান কোন তত্ত্বের সম্পর্কযুক্ত হলে তা হবে উত্তম অনুমান। কেননা, তত্ত্বের পরিধি হোক বিচ্ছিন্ন কোন গবেষণা অখণ্ড জ্ঞানের বিকাশ কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে না। এজন্য অনুমান তত্ত্ব নির্ভর হওয়া প্রয়োজন।

সামাজিক গবেষণায় অনুমানের গুরুত্বসমূহ

সামাজিক গবেষণায় অনুমান চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। গবেষণার প্রাথমিক পর্যায়ে অনুমান স্থির করা হয় এবং পরবর্তী পর্যায়গুলোতে উক্ত অনুমান পরীক্ষা করা হয়। বাস্তবে যে কোন বৈজ্ঞানিক গবেষণায় অনুমানের ভূমিকা অন্যন্য। নিম্নে অনুমানের ভূমিকা বা কার্যাবলিগুলো উপস্থাপন করা হলো:

১. গবেষণা প্রশ্ন ও উত্তর প্রদান: অনুমান একদিকে গবেষণা প্রশ্ন এবং অন্যদিকে গবেষণা প্রশ্নের উত্তর বা সমাধান। কারণ, অনুমানকে গবেষণা প্রশ্নের সম্ভাব্য উত্তর আকারে উপস্থাপন করা হয়। অবশ্য স্থিরকৃত উত্তর ইতিবাচক বা নেতিবাচকভাবে পরীক্ষিত হতে পারে।

২. তথ্যের ধরন: গবেষণার কাজ কি ধরনের তথ্য সংগ্রহ করতে হবে তা অনুমান নির্দিষ্ট করে দেয়। কারণ, গবেষণার জন্য কি ধরনের তথ্য প্রয়োজন তা অনুমানের প্রকৃতির উপর নির্ভর করে।

৩. অপ্রয়োজনীয় তথ্য বর্জন: অনুমান গবেষককে অপ্রয়োজনীয় তথ্য বর্জন করতে নির্দেশ দেয়। অনুমান পরীক্ষা করার জন্য যে ধরনের তথ্য সংগ্রহ করা প্রয়োজন গবেষক কেবল তাই করেন।

৪. তথ্য বিন্যাস ও বিশ্লেষণ: কিভাবে তথ্য বিন্যাস, বিশ্লেষণ করতে হবে অনুমান সে ব্যাপারে নির্দেশ দেয়। একটি অনুমান পরীক্ষা করার জন্য কি তথ্য সংগ্রহ করা হবে তা অনুমান নির্ধারণ করে দেয়।

৫. গবেষণার নির্ধারণ: অনুমান গবেষণার জন্য নির্দিষ্ট ও সীমিত পরিসর চিহ্নিত করে দেয়। এর ফলে গবেষক অপ্রয়োজনীয় ও অনির্ধারিত ক্ষেত্রে বিচরণ করেন না। অনুমানের অনুপস্থিতির কারণে গবেষক প্রয়োজনীয় পরিসর খুঁজে পান না।

৬. অনুসন্ধান পদ্ধতি নির্ধারন: অনুমান অনুসন্ধান পদ্ধতি নির্ধারণ করে। একটি নির্দিষ্ট অনুমান পরীক্ষা করার জন্য কি ধরনের অনুসন্ধান পদ্ধতি অনুসরণ করা হবে তা অনুমান নির্ধারণ করে দেয়। কারণ, সবধরনের অনুমান পরীক্ষা করার জন্য একই ধরনের অনুসন্ধান পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় না।

৭. বিধি প্রতিষ্ঠা: অনুমান একাধিক চলকের মধ্যে সম্পর্ক কল্পনা করে এবং উক্ত সম্পর্ক পরীক্ষা করার চেষ্টা করে এর ফলে অনুমান বাস্তবে সাধারণীকরণ ও বিধি প্রতিষ্ঠা করে।

৮. তত্ত্ব গঠন: অনুমান তত্ত্ব গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। কারণ, পরীক্ষিত অনুমান কোন তত্ত্বকে গ্রহণ, বর্জন বা সংশোধন করে। কাজেই তত্ত্ব গঠনে অনুমানের ভূমিকা অনন্য।

৯. মিতব্যয়ী: অনুমান যেহেতু কি তথ্য সংগ্রহ করা হবে তা নির্ধারণ করে দেয় এবং গবেষণার পরিসীমা নির্ধারণ করে দেয়, কাজেই তা গবেষকের অর্থ, সময় ও শ্রম বাঁচাতে সহায়তা করে।

উপসংহার: উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় সামাজিক গবেষণায় অনুমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অনুমান গবেষণার পরিচালক ও পথ নির্দেশক। অনুমানের উপস্থিতির অভাবে গবেষণা বিশৃঙ্খলভাবে অগ্রসর হয় এবং গবেষকের অর্থ, সময় এবং শ্রমের অপচয় সাধিত হয়। এজন্য সামাজিক গবেষণায় গবেষক নির্দিষ্ট অনুমান নিয়ে গবেষণাকার্য শুরু করেন এবং পুরো গবেষণায় মেধার পরীক্ষা করেন। সামাজিক গবেষণায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির উপাদান হিসেবে অনুমান গবেষণা কাজে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post