আচরণবাদ কী? আচরণবাদের বৈশিষ্ট্য বা মানদন্ড
➢ভূমিকা:-সমাজবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার মধ্যে প্রতিটি শাখার একটি সুনির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে যা তাদের বিষয়বস্তু বিশ্লেষণে সহায়ক হয়। বিশেষভাবে রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানে, আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি একটি বিশেষ গুরুত্ব রাখে। এটি ১৯০৮ সালে ইংরেজ সমাজবিজ্ঞানী গ্রাহাম ওয়ালস এবং আমেরিকান সমাজবিজ্ঞানী আর্থার বেন্টলি দ্বারা উদ্ভাবিত হয়েছিল। এই দৃষ্টিভঙ্গি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ঐতিহ্যবাহী তাত্ত্বিক এবং আইনি বিশ্লেষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং রাজনীতি বিশ্লেষণের জন্য নতুন পদ্ধতির ওপর জোর দেয়।
আচরণবাদ বা আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি হল এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গি যা রাজনীতি, রাষ্ট্র এবং জনগণের আচরণকে গবেষণা ও বিশ্লেষণ করে। ১৯০৮ সালে গ্রাহাম ওয়ালসের *"Human Nature is Politics"* এবং আর্থার বেন্টলির *"The Process of Government: A Study of Social Pressure"* গ্রন্থ দুটি এই দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করে। তাদের মতে, রাষ্ট্র ও সরকারের কাজ শুধু আইন এবং প্রতিষ্ঠিত কাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর রাজনৈতিক আচরণের উপরও নির্ভর করে।
ডেভিড ট্রুম্যান এর সংজ্ঞায় বলেন, “রাজনৈতিক আচরণ বলতে বুঝায়, দেশ শাসনের পদ্ধতির সাথে যুক্ত ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর কার্যকলাপ ও মিথস্ক্রিয়া।” এটি বোঝায় যে রাজনীতি শুধুমাত্র আইন বা সংবিধানের বিশ্লেষণ নয়, বরং জনগণের মনোভাব এবং আচরণকেও প্রাধান্য দেওয়া উচিত।
আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির বৈশিষ্ট্য
আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির কিছু নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য বা মানদণ্ড রয়েছে, যা এই দৃষ্টিভঙ্গির সারবত্তা ও গুরুত্ব তুলে ধরে।
১. তত্ত্বকেন্দ্রিক:
আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি মূলত তত্ত্বকেন্দ্রিক। এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এটি রাজনৈতিক বিশ্লেষণকে তত্ত্ব ও বাস্তব অভিজ্ঞতার মধ্যে সমন্বিত করার চেষ্টা করে। আচরণবাদীরা বিশ্বাস করেন, যে কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষণ নির্দিষ্ট তত্ত্বের ভিত্তিতে হওয়া উচিত, এবং এ তত্ত্বকে গবেষণার মাধ্যমে পরীক্ষিত ও প্রমাণিত হতে হবে। যেমন ডেভিড স্টোন তার *"Political System"* গ্রন্থে বলেন, “এই তত্ত্বের ভিত্তিতেই গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক উপাদান নির্ধারণ করা যায়।”
২. তত্ত্ব ও গবেষণার মধ্যে সমন্বয় সাধন:
আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো তত্ত্ব এবং গবেষণার মধ্যে সমন্বয় সাধন। তারা মনে করেন, রাজনৈতিক বিশ্লেষণের জন্য কেবল তত্ত্বই যথেষ্ট নয়; এর পাশাপাশি সঠিক গবেষণাও অপরিহার্য। তারা তথ্যভিত্তিক গবেষণার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয় এবং তত্ত্ব ও গবেষণার সমন্বয়ে একটি বাস্তব ও কার্যকরী রাজনৈতিক বিশ্লেষণ তৈরি করার চেষ্টা করে।
৩. ইতিহাসকে উপেক্ষা করা:
আচরণবাদীরা ঐতিহাসিক বিশ্লেষণকে তেমন গুরুত্ব দেন না। তারা বিশ্বাস করেন যে রাজনীতি এবং রাজনৈতিক আচরণ মূলত বর্তমানের সাথে সম্পর্কিত। তাই তারা প্রাচীন বা ইতিহাসের ঘটনা বিশ্লেষণ করার পরিবর্তে, বর্তমানের রাজনৈতিক আচরণ এবং সিদ্ধান্তগুলো বিশ্লেষণে মনোযোগী থাকেন।
৪. মূল্যবোধ নিরপেক্ষতা:
আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এটি মূল্যবোধ নিরপেক্ষ। আচরণবাদীরা রাজনৈতিক বিশ্লেষণে কোনো নৈতিক বা আদর্শ মূল্যবোধকে অঙ্গীকার করতে চান না। তাদের মতে, রাজনৈতিক বিশ্লেষণ কেবল কার্যকরী ও অভিজ্ঞতালব্ধ হওয়া উচিত, যেখানে কোনও ব্যক্তিগত বা নৈতিক মূল্যবোধের স্থান নেই। এর ফলে রাজনীতি বিষয়ক আলোচনায় তাত্ত্বিকভাবে নিরপেক্ষতা বজায় থাকে।
৫. গবেষণার ওপর গুরুত্বারোপ:
আচরণবাদীরা রাজনৈতিক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে গবেষণাকে অগ্রাধিকার দেন। তারা মনে করেন যে, রাজনৈতিক আচরণ বিশ্লেষণ করার জন্য গবেষণার একটি সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করা উচিত। গবেষণা, তথ্য সংগ্রহ এবং পরিমাণগত বিশ্লেষণ তাদের দৃষ্টিভঙ্গির মূলভিত্তি। তারা এটাকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গণ্য করে এবং নিশ্চিত করতে চায় যে গবেষণার ফলাফল বাস্তবতার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।
উপসংহার:
পরিশেষে বলা যায় যে আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি রাজনীতি এবং রাষ্ট্রের বিশ্লেষণে একটি নতুন দৃষ্টিকোণ নিয়ে এসেছে। এটি নীতি, মূল্যবোধ বা ইতিহাসের চেয়ে রাজনৈতিক আচরণ এবং বাস্তব তথ্যের ওপর জোর দেয়। রাজনীতি কেবল আইনি কাঠামো বা আদর্শের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং মানুষের আচরণ, তাদের কার্যকলাপ এবং সামাজিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিশ্লেষণ করা উচিত। আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সাহায্যে সমাজবিজ্ঞানীরা রাজনৈতিক আচরণকে আরো ভালোভাবে বুঝতে পারে এবং এর মাধ্যমে সমাজের রাজনৈতিক কাঠামো ও প্রক্রিয়াগুলোর যথাযথ বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হয়।