প্রাক-ব্রিটিশ ভারতীয় গ্রাম সম্প্রদায়কে কেন স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম ব্যবস্থা বলা হতো।

প্রাক-ব্রিটিশ ভারতীয় গ্রাম সম্প্রদায়কে কেন স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম ব্যবস্থা বলা হতো।

প্রাক-ব্রিটিশ ভারতীয় গ্রাম সম্প্রদায়কে কেন স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম ব্যবস্থা বলা হয়

ভূমিকা: প্রাক ব্রিটিশ ভারতের সমাজকাঠামোর উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো গ্রামীণ সম্প্রদায় এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনীতি। গ্রামীণ সম্প্রদায়ের অর্থনীতির ভিত্তি ছিল কৃষি আর স্বয়ংসম্পূর্ণ এজন্য যে চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন হতো। নিজেদের প্রয়োজনের সকল জিনিসই পাওয়া যেত এবং বিনিময় প্রথা বিদ্যমান ছিল।

 জীবন ধারণের মৌলিক প্রয়োজনগুলো মিটানোর জন্য তাদেরকে বহির্বিশ্বের দিকে হাত বাড়াতে হতো না অথবা নির্ভর করতে হতো না। ক্ষুদ্রাকর রাষ্ট্রের মতো নিজেদের সব কাজই তারা নিজেরা সম্পাদন করতো যা গ্রামীণ সম্প্রদায়কে স্বয়ংসম্পূর্ণ অপরিবর্তনীয় স্থবির ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য দান করে

ভারতীয় গ্রাম সম্প্রদায়

প্রাক ব্রিটিশ ভারতের গ্রামগুলো ছিল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রজাতন্ত্রের মতো। সেগুলোকে সমাজের ভিত্তি বলে - অভিহিত করা হয়ে থাকে। আর এ গ্রামীণ সম্প্রদায়গুলো ছিল অর্থনৈতিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ। যার ফলে ভারতীয় সমাজকাঠামো বছরের পর বছর ধরে অপরিবর্তিত, নিশ্চল এবং স্থবির ছিল। বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী গ্রাম সম্প্রদায় সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন।

ব্রিটিশ অফিসার চার্লস মেটকাফ ১৮৩০ সালে গ্রাম সম্প্রদায় সম্পর্কে বলেছেন, গ্রামীণ সম্প্রদায়গুলো ক্ষুদ্র খুত প্রজাতন্ত্রের মতো যেসবের অভ্যন্তরে প্রয়োজনীয় প্রায় সবকিছুই এর পাওয়া যেত এসব ছিল প্রায় বৈদেশিক সম্পর্কযুক্ত।

মিনু মাসানির মতে, "একটি সাধারণ বংশোদ্ভূত এবং কিছু জমির উপর মালিকানাসহ কিছু লোককেই গ্রামীণ সম্প্রদায় বলে।"

গ্রামীণ উৎপত্তি সম্পর্কে স্যার হেনরি মেইন (Sir Henry Maine বলেন "Union of agriculture and handicraft constituted a single unit of village." ভারতবর্ষে ব্রিটিশরা আসার আগ পর্যন্ত মূলত আত্মরক্ষার তাগিদে গ্রাম সম্প্রদায়গুলো গড়ে ওঠে।

Beden Pouell বলেন, "চারদিকে চাষযোগ্য জমি পরিবেষ্টিত কয়েকগুচ্ছে ঘরবাড়ি মিলে হয় গ্রোম যার একটি নির্দিষ্ট নাম ও সীমানা রয়েছে।"

এককথায় বলা যায়, গ্রাম হলো এমন একটি সম্প্রদায় যার পত্তন হয়েছিল বসতির শুরু থেকেই। যেখানে প্রথম কৃষি ব্যবস্থার উদ্ভব এবং বিকাশ ঘটেছে। এ গ্রাম সম্প্রদায়গুলো ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ। অর্থাৎ মৌলিক প্রয়োজনের জিনিস তারা নিজেরাই উৎপাদন করতো এবং এজন্য তাদেরকে বহির্বিশ্বের উপর নির্ভর হতে হতো না।

এলফিন স্টোনের ভাষায়, "এ সম্প্রদায়গুলোর অভ্যন্তরে যেন ক্ষুদ্র পরিসরে রাষ্ট্রের সব উপাদান নিহিত ছিল।"

গ্রামীণ সম্প্রদায়ের স্বয়ংসম্পূর্ণতা সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত: বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী ভারতীয় গ্রাম সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্যাবলি আলোচনা করে একে অপরিবর্তনশীল স্বয়ংসম্পূর্ণ বলে গণ্য করেছেন। এ প্রসঙ্গে কয়েক জনের মতামত তুলে ধরা হলো।

ব্রিটিশ প্রশাসক চার্লস মেটকাফ (Charles Metcalfe) ১৮৩০ সালে গ্রাম সম্প্রদায় সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন যে, ভারতের গ্রাম সম্প্রদায়গুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এজাতন্ত্রের মতো যেসবের অভ্যন্তরে প্রয়োজনীয় প্রায় সব কিছুই পাওয়া যেত, এসব ছিল প্রায় বৈদেশিক সম্পর্কযুক্ত। যেখানে কোন কিছুই স্থায়ী নয় সেখানে গ্রামীণ সম্প্রদায় স্থিতিশীল ছিল।"

ডেনজিল ইবেটসন (Denzil (berson) ১৮৮১ সালে তার পাঞ্জাব আদমশুমারিতে বলেন, 'গ্রামটির শিল্পে যেসব উৎপাদিত হতো সেসব দিয়ে সাধারণত গ্রামের সকল চাহিদা মিটানো হতো। পাঞ্জাবের গ্রাম বিশেষভাবে আত্মনির্ভরশীল ছিল। এটি নিজেই নিজের খাদ্য উৎপাদন করতো। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র তৈরি করতো, গৃহস্থালির উপকরণ যোগান দিত। খুব সামান্য জিনিসের জন্য গ্রামটিকে বাইরের জগতের মুখাপেক্ষী থাকতে হতো।"

কে এম আশরাফ বলেন, "অর্থনৈতিকভাবে বলতে গেলে, গ্রাম হচ্ছে এমন একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ একক যার রয়েছে একটি জৈবিক ও সমুন্নত অর্থনৈতিক কাঠামো। যদি আমরা জৈবিক জীবন বলতে সম্প্রদায়ের সংঘবদ্ধ কর্ম সম্পাদনকে বুঝে থাকি তাহলে সেখানে অবশ্যই এর সদস্যদের চাহিদা মিটানোর ও ইচ্ছাপূরণের সুব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল।

ডিডি কোসাম্বি (D.D. Kosambi) তিনি মার্কসের সাথে একমত পোষণ করে বলেন, "যেহেতু লবণ ও ধাতু কোনটি উৎপাদিত হতো না, বিনিময়ের মাধ্যমে সংগৃহীত হতো, সেহেতু সীমিত অর্থে হলেও পণ্য উৎপাদনের অস্তিত্ব ছিল।"

সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানীয়া বিভিন্ন দিক থেকে স্বয়ংসম্পূর্ণতাকে মেনে নিয়েছেন এবং যুক্তি দেখিয়েছেন। নিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণতার পিছনে যুক্তি প্রদান করে আলোচনা করা হলো।

১. উৎপাদন ব্যবস্থা: প্রাক ব্রিটিশ ভারতের গ্রামীণ সম্প্রদায়ের সদস্য কৃষকদের প্রধান সম্পদ ছিল ভূমি। বাক্তিমালিকানার অনুপস্থিতি থাকলেও খাজনার বিনিময়ে কৃষকরা এ জমি বংশপরম্পরায় ভোগ করার অধিকার পেত। চাষ করার ক্ষেত্রে জমি, কৃষি যন্ত্রপাতি বা উৎপাদন ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত অন্যান্য কোন দ্রব্যাদির জানা গ্রামবাসী অন্য কারও উপর না বহির্বিশ্বের উপর নির্ভর করতে হয়নি। ফলে দেখা যাচ্ছে যে, গ্রামগুলো উৎপাদন ব্যবস্থার দিক দিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণই ছিল।

২. দ্রব্য বিনিময় ও সীমিত মুদ্রা অর্থনীতি: প্রাক ব্রিটিশ ভারতে দ্রব্য বিনিময় প্রথা প্রচলিত ছিল। প্রতিটি পরিবারেই প্রয়োজনীয় সব দ্রব্য উৎপাদন করতো না, বরং যে যার প্রয়োজনীয়তার দ্রব্য আরেকজনের কাছ থেকে বিনিময়ের মাধ্যাম প্য়োজনীয় দ্রব্য সংগ্রহ করতো। বিনিময় বা শস্যের মাধ্যমে দেনাপাওনা মিটিয়ে দেওয়া হতো। ফসল বা মুদ্রার মাধ্যমে খাজনা দেওয়া হতো। সুতরাং মুদ্রা অর্থনীতির সীমিত প্রচলন এবং দ্রব্য বিনিময়ের প্রাধান্য প্রমাণ করে যে গ্রামগুলো স্বয়ংসম্পূর্ণ মিল। 

৩. গ্রাম কমিটির ভূমিকা: গ্রাম কমিটি কৃষকের মাঝে জমি বণ্টন করে দেওয়ার দায়িত্ব পালন করে। প্রতিটি পরিবারকে জমি বরাদ্দ দেওয়া হতো। তারা খাজনা দেওয়ার বিনিময়ে ঐ জমির কৃষকরা বংশপরম্পরায় ভোগ করত। অর্থাৎ গ্রাম সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হিসেবে গ্রাম কমিটি জমি বরাদ্দ দিয়ে কৃষকদের কে স্বাধীন জীবন যাপনে যেমন ভূমিকা পালন করত অন্যদিকে কেন্দ্রীয় যে কোন ধরনের প্রভাব থেকে মুক্ত রাখতেও ভূমিকা পালন করত। সুতরাং দেখা যাচ্ছে জমির ব্যবস্থাপনায়ও গ্রামীণ সম্প্রদায় স্বাধীন ও স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল।

৪. জাতিবর্ণ ও পেশাদার গোষ্ঠী: ভারতীয় জাতিবর্ণ প্রথার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল বর্ণ অনুযায়ী পেশা নির্ধারিত হতো এবং সেটি অপরিবর্তনীয়। এ বর্ণপ্রথা জন্মগতভাবে অর্জিত যা ইচ্ছে করলেই পরিবর্তন করতে পারে না। এভাবে প্রতিটি বর্ণ তাদের নিজস্ব পেশায় গোষ্ঠী স্ব স্ব পেশায় থেকে গ্রামীণ সম্প্রদায়ের স্বয়ংসম্পূর্ণতাকে রক্ষা করতো। এভাবে প্রতিটি বর্ণ তাদের নিজস্ব পেশায় দক্ষ হয়ে উঠে। ফলে তারা আসবাবপত্র থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় অন্যান্য সব দ্রব্যই গ্রামে উৎপাদন করতো।

৫. উন্নত যানবাহন ব্যবস্থা ও স্বয়ংসম্পূর্ণতা: যেহেতু গ্রাম গুলোকে মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য বহিঃবিশ্বের উপর নির্ভর করতে হয়নি তাই যানবাহন ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটেনি। এর জন্য স্বয়ং সম্পূর্ণতা দায়ী কারণ যোগাযোগ করতে হয়নি তাই যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটেনি।

৬. যজমানি ব্যবস্থা: যজমানি ব্যবস্থায় বিভিন্ন পেশাদার গোষ্ঠী তাদের পেশা অনুযায়ী অন্যান্য পেশাদার গোষ্ঠীর জন্য কাজ করে দেয়। কখনো কখনো পেশাদার গোষ্ঠীকে জমি ভোগ করার অধিকার দেওয়া হতো, আবার কখনো কখনো ফলফলাদি বা অন্য কোন সেবার মাধ্যমে তা মিটানো হতো। এ যজমানি ব্যবস্থা ভারতীয় সমাজকাঠামোর স্বয়ংসম্পূর্ণতার সাক্ষী বহন করে। 

৭. নিশ্চলতা, স্থবিরতা ও অপরিবর্তনীয়তা: প্রাক ব্রিটিশ ভারতীয় সমাজব্যবস্থা ছিল অপরিবর্তনীয় নিশ্চল ও স্থবির। এর প্রধান কারণ হলো এটি ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ ও স্বনির্ভর। যে কোন প্রয়োজনই তারা নিজেয়া মিটাতে পারত সেজন্য তাদের মধ্যে কোন ধরনের পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়নি। 

সমালোচনা (Criticism)

প্রাক ব্রিটিশ ভারতীয় সমাজের স্বয়ংসম্পূর্ণতার বিষয়ে অনেকেই ভিন্নমত পোষণ করেছেন। অধ্যাপক নাজমুল করিম বলেন, 'ভারতে ব্রিটিশ আগমনের আমলে ভারতীয় গ্রাম সমাজ না ছিল পুরোপুরি স্বয়ংসম্পূর্ণ না ছিল পুরোপুরি মুদ্রা অর্থনীতি নির্ভর। এটা ছিল ক্রান্তিকালীন বা পরিবর্তনশীল একটি পর্ব। অন্যদিকে ব্রিটিশ ভারতীয় নৃবিজ্ঞানী এম এন শ্রীনিবাসের মতে, "গ্রাম সমাজের স্বয়ংসম্পূর্ণতা অতিকধনমাত্র। অর্থাৎ তিনি স্বয়ংসম্পূর্ণতার ধারণাকে অতিরঞ্জিত বংল আখ্যা দিয়েছেন। তথাপি প্রাক ব্রিটিশ ভারতীয় সমাজে যে স্বয়ংসম্পূর্ণ সে বিষয়ে যথেষ্ট সত্যতা এবং গুরুত্ব রয়েছে।

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, কিছু সমালোচনা বা দ্বিমত থাকা সত্ত্বেও ভারতীয় গ্রাম সমাজের স্বয়ংসম্পূর্ণতা সম্পর্কে বিভিন্ন ধারণার গুরুত্ব রয়েছে। আজকের তুলনায় প্রাক ড্রিটিশ যুগের গ্রামীণ সমাজ অনেক বেশি স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল। অনেক সমাজবিজ্ঞানীই গ্রামীণ সম্প্রদায়ের অপরিবর্তনশীল, স্বাংসম্পূর্ণ ইত্যাদি বৈশিষ্টাংকে স্বতঃসিদ্ধ বলে গ্রহণ করেছেন। সীমিত অর্থে বাজার ব্যবস্থা, লোহা ও লবণের ব্যবহার স্বয়ংসম্পূর্ণতার যুক্তিকে মেনে নেওয়া যায় না। তারপরও বিভিন্ন সেসব ক্ষেত্রে বাণিজ্যের প্রচলন ছিল। কিছু কিছু ক্ষেত্রে পেশাদার গোষ্ঠীর নিজস্ব ভূমিক। গ্রামগুলোতে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তুলেছিল। এছাড়াও অন্যান্য উপাদানের ভূমিকাও এরুত্বপূর্ণ ছিল।

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post