বস্তুভক্তিবাদ কী? কার্ল মার্কসের বস্তুভক্তিবাদ তত্ত্বটি আলোচনা কর

বস্তুভক্তিবাদ কী? কার্ল মার্কসের বস্তুভক্তিবাদ তত্ত্বটি আলোচনা কর

বস্তুভক্তিবাদ কী? বস্তুভক্তিবাদ সম্পর্কিত মার্কসীয় মতামত ব্যাখ্যা কর।

ভূমিকা : সমাজবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক ক্ষেত্র সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে যে দার্শনিকের নাম বিশেষভাবে স্মরণীয় তিনি হলেন কার্ল মার্কস। মার্কস তার লেখনীর মাধ্যমে অনেকগুলো সমাজতত্ত্বের ব্যাখ্যা ও উদ্ভব ঘটিয়েছেন। তার মধ্যে অন্যতম একটি বস্তুভক্তিবাদ বা Commodity Fetishism. মার্কস Commodity Fetishism প্রত্যয়টি ব্যবহার করেছেন এমন একটি প্রক্রিয়াকে বুঝাতে যেখানে ব্যক্তিগণ পণ্যের প্রতি একটি মূল্য নির্ধারণ করে এবং বিশ্বাস করে যে পণ্যগুলোর অস্বাভাবিক শক্তি রয়েছে। এ ধারণার আলোকে মার্কস যে তাত্ত্বিক কাঠামো গড়ে তুলেছে তাকে বলা হয় বস্তুভক্তিবাদ বা Theory of Commodity Fetishism.

বস্তুভক্তিবাদ কী বস্তুভক্তিবাদ সম্পর্কিত মার্কসীয় মতামত ব্যাখ্যা কর


বস্তু ভক্তিবাদ (Commodity Fetishism)

Fetishism শব্দটি এসেছে Fetish শব্দ থেকে। Fetish অর্থ হলো ভক্তির পাত্র বা বস্তুর প্রতি ভক্তি। পরিভাষায় Fetish হলো কোনো বস্তুগত জিনিস বা বিষয়ের প্রতি অস্বাভাবিক ভক্তি প্রদর্শনী যেখানে এ বিশ্বাস কাজ করে যে, জিনিসটির অসাধারণ ক্ষমতা রয়েছে। এ সম্পর্কে মরিসন বলেন, "Simply stated, a fetish is the display of unusual devotion toward a material thing or object in the belief that it has extraordinary powers. অর্থাৎ, সহজভাবে বলা যায়, Fetish হলো কোনো বস্তুগত জিনিস বা বিষয়ের প্রতি অস্বাভাবিক ভক্তি প্রদর্শন করা, এই বিশ্বাসে যে বস্তুটির অসাধারণ ক্ষমতা রয়েছে।

মার্কস Commodity Fetishism প্রত্যয়টি ব্যবহার করেছেন এমন একটি প্রক্রিয়াকে বুঝাতে যেখানে ব্যক্তিগণ পণ্যের প্রতি একটি মূল্যনির্ধারণ করে এবং বিশ্বাস করে যে পণ্যগুলোর অস্বাভাবিক শক্তি রয়েছে। পণ্যের রয়েছে শুধুই ব্যবহারিক মূল্য। সারবত্তা হিসেবে পণ্যের মূল্যের এক পরমাণু সমপরিমাণও পণ্যের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় না। বিনিময় মূল্য থেকে ব্যবহারিক মূল্য সম্পূর্ণ আলাদা। ব্যবহারিক মূল্য হলো কারণ এটি মানুষের অস্তিত্বের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত।

উপর্যুক্ত আলোচনা পরিশেষে বলা যায় যে, পণ্যের প্রতি অস্বাভাবিক ভক্তি ও বাস্তবতা বলতে একটি প্রক্রিয়াকে বুঝায় যা ঐ পণ্যের মূল্যনির্ধারণ করে এবং বিশ্বাস করে যে, পণ্যগুলোর এক ধরনের অস্বাভাবিক শক্তি রয়েছে। এটিই পণ্যের প্রতি অস্বাভাবিক ভক্তি ও বাস্তবতা।

কার্ল মার্কসের বস্তুভক্তিবাদ তত্ত্ব (Theory of Commodity Fetishism by Karl Marx)

মার্কস তাঁর বস্তুভক্তিবাদ আলোচনা করতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন যে, যখনই পণ্যগুলো তুচ্ছ বা গতানুগতিক বস্তু হিসেবে আবির্ভূত হয় তখনই এগুলোর একটি রহস্যময় প্রকৃতি থাকে। আর রহস্যময় প্রকৃতিটি হলো- এগুলো এমন কিছু ক্ষমতা প্রকাশ করে যাকে আমরা বিশ্বাস করি পণ্যের প্রকৃতিরই অংশ হিসেবে। এ সম্পর্কে মার্কস বলেছেন, "While commodities appear to be trivial things, they have a mysterious nature in that they manifest powers which we believe are part of their nature." অর্থাৎ মার্কস আরো বলেন, "রহস্যময় ক্ষমতা পণ্যের ব্যবহারিক মূল্য থেকে সৃষ্টি হয়নি। কারণ ব্যবহারিক পর্যায়ে পণ্যগুলো শুধুই মানুষের প্রয়োজনগুলো পূর্ণ করতো এবং এসব পণ্য সম্পর্কে কোনো রহস্য ছিল না। কিন্তু যখনই সমাজ বিনিময় ব্যবস্থার (A System of Exchange) আবির্ভাব হয়, পণ্য রহস্যময় প্রকৃতি লাভ করে। মার্কস যুক্তি দেখিয়ে বলেন, একমাত্র ঐ সমস্ত সমাজে যেখানে সামাজিক সম্পর্কগুলো এ পর্যায়ে যে, মানুষের এ বিশ্বাস করতে বাধ্য হয় যে, মূল্য এমন একটি বক্ত র্যামেণ্যের মাঝে সহজাত অংশ হিসেবে। অবস্থান করে এবং এ পর্যায়েই পণ্য অস্বাভাবিক ক্ষমতা লাভ করতে শুরু করে।

মার্কস দৃঢ়ভাবে বলেন, যখন বিশ্বাস করা হয় যে, পণ্যের মূল্য আছে এবং সেটা স্বয়ং পণ্যের মাঝে অবস্থিত, আমরা ভুলবশত পণ্যের প্রতি এমন ক্ষমতা আরোপ করি যা বাস্তবে পণ্যের নেই। এ প্রক্রিয়াটি বুঝানোর জন্য মার্কস উপজাতীয় সমাজের দিকে দৃষ্টি দিয়েছেন। উপজাতীয় সমাজে মানুষ বস্তুর প্রতি অলৌকিক ক্ষমতা আরোপ করে। কারণ, তারা বিশ্বাস করে এ ক্ষমতাগুলো স্বয়ং বস্তুর প্রকৃতি থেকেই সৃষ্টি হয়। মার্কস যুক্তি দেখিয়ে বলেন যে, এটি তাদের বিশ্বাস অথচ বাস্তবে এটি তাদেরকে এমন চিন্তার দিকে ধাবিত করে যে, বাস্তবগুলোর মাঝে ক্ষমতা বিরাজমান। মার্কস বলেন, এই বস্তুগুলোর কোনো ক্ষমতাই নেই। তিনি মনে করেন, মানুষের ধারণাকৃত এ ক্ষমতাগুলোর গোপন উৎস হলো বস্তুগুলোর সাথে মানুষের সক্রিয় সম্পর্ক। যে সম্পর্কটি গড়ে উঠেছে একমাত্র ঐ সামাজিক সম্পর্ক প্রণালির মাধ্যমে যে সামাজিক সম্পর্কের সাথে এ বিশ্বাসগুলো মিশে আছে।

মার্কস বলেন, "যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পুঁজিবাদী সমাজে মানুষের এ বিশ্বাস গড়ে উঠেছে যে, পণ্যের অস্বাভাবিক ক্ষমতা রয়েছে সেই প্রক্রিয়াকে বস্তুভক্তিবাদ (Commodity Fetishism) বলে।

মরিসন-এর ভাষায় "The same process takes place in capitalist societies, where individuals confer extraordinary powers and capacities on commodites-a process he called commodity fetishism. অর্থাৎ, পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় সেই একই প্রক্রিয়া আসে যেখানে ব্যক্তির হাতে অস্বাভাবিক ক্ষমতা ও ধারণক্ষমতা থাকে পণ্যের উপর, সেই প্রক্রিয়াকে বলা হয় বস্তুভক্তিবাদ।

পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মার্কস Fetishism প্রত্যয়টি ব্যবহার করেছেন এবং এর মাধ্যমে তিনি দুইটি প্রবণতাকে ব্যাখ্যা করেছেন যা বস্তুভক্তিবাদ বুঝার ক্ষেত্রে সহায়ক। প্রবণতা দুটি হলো:

ক. পুঁজিবাদী অর্থনীতি চেষ্টা করে মানুষের মাঝে এ বিশ্বাস সৃষ্টি করতে সে মূল্য হলো এমন একটি বস্তু যা পণ্যের সহজাত অংশ।

খ. পুঁজিবাদ অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও গুরুত্বপূর্ণভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করে যে, পণ্যের অস্বাভাবিক ক্ষমতা রয়েছে।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় মার্কস তাঁর বস্তুভক্তিবাদ তত্ত্বে পণ্যের মূল্যকে তার সহজাত অংশ হিসেবে মানুষের বিশ্বাস সৃষ্টির এবং পণ্য যে অস্বাভাবিক ক্ষমতার অধিকারী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সমাজতাত্ত্বিক গবেষণার ক্ষেত্রে মার্কসের বস্তুভক্তিবাদ তত্ত্বটি গুরুত্বপূর্ণ হলেও এর অনেক সমালোচনা করেছেন অনেক তাত্ত্বিক। সমালোচকদের মতে, মার্কসের এই তত্ত্বটি একটি অবাস্তব তত্ত্ব। অর্থনীতিতে এই তত্ত্বের কোনো গুরুত্ব নেই। তাছাড়া পণ্যের মূল্য এর সহজাত অংশ নয় এবং পণ্যের কোনো অস্বাভাবিক ক্ষমতা নেই বলেও সমালোচকরা মন্তব্য করেছেন। সর্বোপরি, মার্কসের বস্তুভক্তিবাদ একটি বহুল আলোচিত সমালোচিত সমাজতাত্ত্বিক মতবাদ।

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post