প্রশ্নঃ উৎপাদন হতে শ্রমিকের বিচ্ছিন্নতা বলতে কার্ল মার্কস কি বুঝিয়েছেন।
ভূমিকাঃ মধ্যযগীয় চিন্তাধারার ধর্মীয় নিগৃঢ় বন্ধনকে আগ্রহ্য করে চিন্তার জগতে সত্য প্রতিষ্ঠা কল্পে ঐতিহ্য, অনুমান ও প্রত্যাদেশকে বিসর্জন দিয়ে পর্যবেক্ষণ ও যুক্তিশ্রয়ী মূল্যায়নের উপর ভিত্তি করে যার আবির্ভাব ঘটে তিনি হচ্ছেন জার্মান দার্শনিক, অর্থনীতিবীদ ও সমাজবিজ্ঞানী কার্ল মার্কস। মার্কস তার 'The Economic and Philosophical Manuscript of 1844' শীর্ষক গ্রন্থে সমাজবিজ্ঞানের একটি অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ তত্ত্ব Alienation বা বিচ্ছিন্নতাবোধ ব্যাখ্যা করেছেন। কার্ল মার্ক্সের বিচ্ছিন্নতাবোধ তত্ত্বটি সমাজবিজ্ঞানের পাশাপাশি অর্থনীতির তাত্ত্বিক ক্ষেত্রেও গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হয়।
উৎপাদন হতে শ্রমিকের বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কে কার্ল মার্কসের ধারণাঃ নিম্নে উৎপাদন হতে শ্রমিকের বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কে মার্ক্সের ধারণাটি আলোচনা করা হলো।
১। উৎপাদিত বস্তু হতে শ্রমিকের বিচ্ছিন্নতাঃ শ্রমিক মজুরির বিনিময়ে উৎপাদন করে।আর পুঁজিপতি শ্রমিকের উৎপাদন থেকেই মুনাফা করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে। একজন শ্রমিক যতই সম্পদ উৎপাদন করে এবং উৎপাদনের কারনে যতই তার শক্তি ও ব্যপ্রতির বিকাশ ঘটে ততই সে দরিদ্র্যতর হতে থাকে। যতবেশি যে উৎপাদন করে ততবেশি সস্তামূল্যর সামগ্রীতে পরিণত হয় সে। এতে দেখা যায় শ্রমিক যা উৎপাদন করে তার কাছে একটি অপরিচিত বস্তু হিসেবে দেখা দেয়।এই শ্রম ফসল তার কাছে একটি ভিন্ন সত্তা, অপরিচিত বস্তু। এর সাথে বিনিময়ের কোন সংযোগ নেই।সে তার উৎপাদিত বস্তু হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
খ. উৎপাদিত কার্য হতে বিচ্ছিন্নতাঃ উৎপাদিত বস্তু হতে বিচ্ছিন্নতার ফলে শ্রমিক উৎপাদন কার্য থেকেও নিজেকে বিচ্ছিন্ন মনে করে। কেননা উৎপাদিত বস্তু হচ্ছে উৎপাদন কার্যেরই ফসল। যখন শ্রমিক নিজেকে তার উৎপাদনের সাথে পরিচিত মনে করতে পারেনা,স্বভাবতই উৎপাদন কার্যের সাথেো শ্রমিক তার একত্মা অনুভাব করেনা।কারণ কাজ শ্রমিকের কাছে একটি বাইরের বিষয়, তার নিজের প্রকৃতির অংশ নয়।ফলে তার নিজের পূর্ণতা আসেনা।মঙ্গলের পরিবর্তে অমঙ্গলের বোধ সৃষ্টি হয়, স্বাভাবিক নিয়মে তার মানসিক ও শারীরিক শক্তির বিকাশ ঘটে না। বরং দৌহিকভাবে তক্লান্ত ও মানসিকভাবে পর্যুদস্ত হয়ে উঠে। ফরে সময়টিকে নিজের মনে করে কর্মক্ষেত্রে নিজেকে মনে করে আশ্রয়হীনবা বিমুক্ত। কর্ম স্বতঃপ্রণোদিত নয় বরং চাপানো শ্রম।বাইরের শ্রম যা তাকে বিচ্ছিন্ন করে তা হলে আত্মত্যাগের শ্রম এবং আত্মবিনাশের শ্রম।চূড়ান্তভাবে কাজের এই বহিঃপ্রকাশের ফলে শ্রমিক তার নিজের কাজকে নিজের মনে করে না বরং অন্যের কাজ মনে করে। কেননা এছাড়া শ্রমিকের আর কোন উপায় নাই। এ জন্যই কার্ল মার্ক্স এদেরকে Proletariat বলেছেন।
পরিশেষে বলা যায়, পুঁজিবাদী সমাজের প্রেক্ষিতেই বিচ্ছিন্নতা তত্ত্বটি বিধৃত হয়েছে যা কার্ল মার্কস অত্যন্ত যুক্তিনিষ্ঠভাবে উপস্থাপন করেছেন। পুঁজিবাদ শ্রেণি কর্তৃক অত্যাধিক শোষণের ফলেই শ্রমিক মানুষের থেকে বিচ্ছিন্নতাবোধ করে।