বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণের প্রতিবন্ধকতা

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণের প্রতিবন্ধকতা

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণের প্রতিবন্ধকতা


ভূমিকা: বাংলাদেশের রাজনীতি নারীদের উপস্থিতির অভাবে এখনও পুরুষতান্ত্রিক ধাঁচে পরিচালিত হচ্ছে। যদিও সংবিধান নারী-পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করেছে এবং সংরক্ষিত আসনের মাধ্যমে নারীদের রাজনীতিতে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে, তবুও কার্যকর অংশগ্রহণ এখনো স্বপ্নের মতো। রাজনৈতিক অঙ্গনে নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা এখনো দৃশ্যমান।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণের প্রতিবন্ধকতা


রাজনৈতিক সচেতনতার অভাব: নারীদের অনেকেই রাজনৈতিক অধিকার এবং সুযোগ সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন নন। গ্রামীণ ও প্রান্তিক এলাকার নারীদের মধ্যে এই সচেতনতার ঘাটতি বেশি। ফলে রাজনীতি সম্পর্কে আগ্রহ ও অংশগ্রহণের অভাব পরিলক্ষিত হয়।

সামাজিক কারণ: বাংলাদেশে এখনো নারীদের মূল ভূমিকা হিসেবে দেখা হয় গৃহস্থালির কাজ এবং সন্তান পালন। সমাজ নারীদের রাজনীতি বা নেতৃত্বের দায়িত্ব নিতে মানসিকভাবে প্রস্তুত নয়। নারী যদি রাজনীতিতে সক্রিয় হতে চায়, তাকে নানা সামাজিক বাধার সম্মুখীন হতে হয়।


পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা: আমাদের সমাজ এখনও পুরুষতান্ত্রিক ধ্যানধারণায় পরিচালিত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দল, স্থানীয় প্রশাসন বা নেতৃত্বে পুরুষরাই আধিপত্য বিস্তার করে থাকে। এই কাঠামোর মধ্যে নারীরা অবহেলিত ও উপেক্ষিত থাকে।


পারিবারিক কারণ: অনেক পরিবারই চায় না তাদের মেয়েরা রাজনীতিতে যুক্ত হোক। রাত-বিরাতে বৈঠক, দূরে ভ্রমণ, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব বা সহিংসতা নিয়ে পরিবারের আশঙ্কা থাকে। এসব কারণে পরিবার থেকেই নারীদের নিরুৎসাহিত করা হয়।


ধর্মীয় কারণ: ধর্মের অপব্যাখ্যা করে অনেক সময় নারীদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণকে “অবৈধ” বলে আখ্যা দেওয়া হয়। কিছু ধর্মীয় নেতা ও দল নারীদের ঘরে রাখাকে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সমর্থন করে, যার ফলে নারীরা রাজনীতিতে আসতে দ্বিধাবোধ করেন।


পুরুষ কর্তৃক নিরুৎসাহ প্রদান: রাজনীতিতে অনেক সময় পুরুষ নেতৃত্বের পক্ষ থেকে নারীদের অবমূল্যায়ন করা হয়। তারা নারীদের কণ্ঠকে গুরুত্ব না দিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকেন। এতে নারী সদস্যরা হতাশ হয়ে পড়েন এবং ধীরে ধীরে সরে যান।


শিক্ষাক্ষেত্রে অনগ্রসরতা: রাজনীতি সম্পর্কে সচেতন হতে হলে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু অনেক নারী এখনো শিক্ষাক্ষেত্রে পিছিয়ে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে নারীদের শিক্ষার হার এখনও আশানুরূপ নয়, যা তাদের রাজনৈতিকভাবে সচেতন ও সক্রিয় হওয়ায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।


রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ড: অনেক রাজনৈতিক দল নারীদের শুধুমাত্র প্রতীকীভাবে ব্যবহার করে। নেতৃত্ব বা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নারীদের গুরুত্ব দেওয়া হয় না। তাদের শুধু সংরক্ষিত আসনে সীমাবদ্ধ রেখে কার্যকর অংশগ্রহণ থেকে বঞ্চিত করা হয়।


অভিজ্ঞতার অভাব: রাজনীতিতে টিকে থাকতে হলে অভিজ্ঞতা জরুরি। কিন্তু যেহেতু নারীদের সুযোগ কম, তারা প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারেন না। ফলে নেতৃত্বে আসার সম্ভাবনা হ্রাস পায়।


গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অবক্ষয়: রাজনৈতিক সহিষ্ণুতা, বাকস্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ইত্যাদি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অভাব নারীদের জন্য আরো ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরি করে। রাজনীতির সহিংস পরিবেশ নারীদের নিরুৎসাহিত করে।


নারী সমাজের অনীহা: নারীদের একাংশ নিজেরাও রাজনীতি নিয়ে আগ্রহী নন। তারা মনে করেন রাজনীতি কেবল পুরুষদের জন্য। নিজেদের অক্ষম বা অনুপযুক্ত মনে করে রাজনীতি থেকে দূরে থাকেন।


প্রচার মাধ্যমের কার্যক্রম: মিডিয়া অনেক সময় নারীদের নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করে, বিশেষ করে যখন কোনো নারী রাজনৈতিক ব্যর্থতা দেখান। আবার নারী রাজনীতিকদের ব্যক্তিজীবন নিয়েও অহেতুক সংবাদ পরিবেশন করা হয়, যা তাদের মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে।


ফতোয়াবাজদের দৌরাত্ম্য: কিছু মৌলবাদী গোষ্ঠী ও ফতোয়াবাজরা নারীদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণকে ইসলামবিরোধী বলে চিহ্নিত করে। এই ধরনের প্রচার নারীদের মানসিকভাবে ভয় পাইয়ে দেয় ও রাজনীতি থেকে সরিয়ে রাখে।


উপসংহার: বাংলাদেশে নারীদের রাজনীতিতে কার্যকর অংশগ্রহণের জন্য প্রয়োজন সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা, শিক্ষার প্রসার এবং নিরাপদ রাজনৈতিক পরিবেশ। নারীরা যেন কেবল একটি আসনের জন্য নয়, বরং নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হতে পারেন, সেই প্রচেষ্টা এখন সময়ের দাবি। উন্নত, সমতাভিত্তিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণ অপরিহার্য।

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post