বাংলাদেশের নারী উন্নয়ন নীতিমালা পর্যালোচনা কর

বাংলাদেশের নারী উন্নয়ন নীতিমালা পর্যালোচনা কর

বাংলাদেশের নারী উন্নয়ন নীতিমালা: একটি পর্যালোচনা

ভূমিকা: নারীর ক্ষমতায়নের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত হলো একটি সুসংগঠিত নারী উন্নয়ন নীতিমালা। সমাজে বিদ্যমান জেন্ডার বৈষম্য দূর করে নারীকে সমান অধিকার, সুযোগ ও মর্যাদা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন সময়ে যে নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করেছে, তা-ই নারী উন্নয়ন নীতিমালা নামে পরিচিত। ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৫ সালকে জাতিসংঘ “নারী দশক” হিসেবে ঘোষণা করার পর বাংলাদেশে নারী উন্নয়নে গতি আসে। পরবর্তীতে ১৯৯৭, ২০০৮ ও ২০১১ সালে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ নারী উন্নয়ন নীতিমালা গৃহীত হয়।

বাংলাদেশের নারী উন্নয়ন নীতিমালা পর্যালোচনা কর


১৯৯৭ সালের জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা:

১৯৯৭ সালের নীতিমালা ছিল বাংলাদেশের নারীর ক্ষমতায়নের পথচলার প্রথম দিকের একটি মাইলফলক। এতে নারীর জীবনমান উন্নয়নে নিচের দিকগুলোতে জোর দেওয়া হয়েছিল:

* নারী ও পুরুষের মধ্যে সমতা প্রতিষ্ঠা করা

* নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য দূরীকরণ

* নারীর মানবাধিকার সংরক্ষণ ও বাস্তবায়ন

* নারীকে দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তর

* সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারীর ভূমিকার স্বীকৃতি

* প্রশাসন, শিক্ষা, রাজনীতি, ক্রীড়া সহ সব ক্ষেত্রে সমান সুযোগ সৃষ্টি

* নারীর দারিদ্র্য হ্রাস

* নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা

* নারীর স্বাস্থ্য, প্রযুক্তি, আবাসন ও আশ্রয় নিশ্চিতকরণ

* দুস্থ ও পিছিয়ে পড়া নারীর জন্য বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ

* গণমাধ্যম এ নারীর ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি


২০০৮ সালের জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা:

২০০৮ সালের নীতিমালায় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদ ও নারীর মৌলিক স্বাধীনতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এই নীতিমালার মূল দিকগুলো ছিল:

* নারীর মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতার স্বীকৃতি

* সিডও সনদের বাস্তবায়ন ও প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন

* ধর্মের ব্যাখ্যার নামে নারী-বিরোধী কোনো কাজ রোধ

* মেয়ে শিশুর প্রতি বৈষম্য দূরীকরণ

* নির্যাতন প্রতিরোধ এবং নারী-নিরাপত্তা জোরদার

* শিক্ষা, ক্রীড়া ও সংস্কৃতিতে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি

* অর্থনীতিতে নারীর সমান অংশগ্রহণ ও সুযোগ

* সম-মজুরি, বৈষম্যদূর, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও মাতৃত্বকালীন ছুটি (৫ মাস) নিশ্চিতকরণ


২০১১ সালের জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা:

২০১১ সালের নারী উন্নয়ন নীতিমালা ছিল আগের নীতিমালাগুলোর একটি পরিপূর্ণ সংস্করণ, যেখানে ২২টি স্পষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। এর মধ্যে কিছু প্রধান লক্ষ্য হলো:


* নারীর অধিকার সংরক্ষণ ও দারিদ্র্য বিমোচন

* সকল প্রকার বৈষম্য ও সহিংসতা দূরীকরণ

* অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ

* বাজার-উপযোগী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের সুযোগ সৃষ্টি

* কর্মজীবী নারীদের জন্য ডে-কেয়ার, হোস্টেল, নিরাপদ আবাসন নিশ্চিতকরণ

* পাচার বা সহিংসতার শিকার নারীদের পুনর্বাসন

* রাজনৈতিক ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি

* স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ

* নারী উন্নয়ন মনিটরিং ও মূল্যায়নে প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধি

* জেন্ডার সংবেদনশীলতা ও পরিবেশগত সুরক্ষা

* আবহাওয়া ও পরিবেশের ক্ষতিকর প্রভাব হতে রক্ষার পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত নারীর পূর্ণবাসন।


উপসংহার: বাংলাদেশ সরকারের নারী উন্নয়ন নীতিমালাগুলো সময়ের প্রেক্ষিতে ক্রমাগত উন্নত ও আধুনিক হয়েছে। বিশেষত ২০১১ সালের নীতিমালায় ২২টি লক্ষ্য নির্ধারণ করে নারীর সামগ্রিক ক্ষমতায়নের রূপরেখা তৈরি করা হয়েছে। ১৯৯৭ সালের ভিত্তি ও ২০০৮ সালের আন্তর্জাতিক কাঠামোর সঙ্গে মিল রেখে তৈরি এই নীতিমালাগুলো নারীর অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে।


Post a Comment (0)
Previous Post Next Post