জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে এনজিও-র অবদান: এক নিরব বিপ্লব
ভূমিকা: বাংলাদেশ একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশ, যেখানে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হিসেবে দীর্ঘদিন ধরেই বিবেচিত হয়ে আসছে। সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বা এনজিও (NGO) এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। এইসব এনজিও শুধু জনসচেতনতা নয়, বরং চিকিৎসা সহায়তা, শিক্ষা, পরামর্শ ও আধুনিক পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতির বিস্তারে একটি নিরব বিপ্লব ঘটিয়েছে।
পরিবার পরিকল্পনা সমিতি: ১৯৫৩ সালের ২ মার্চ, ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যাপিকা ডা. হুমায়রা ও কিছু সমাজসেবী নারী মিলে ‘পরিবার পরিকল্পনা সমিতি’ প্রতিষ্ঠা করেন। এটিই ছিল বাংলাদেশে পরিবার পরিকল্পনা আন্দোলনের সূচনা।
প্রধান কার্যক্রমসমূহ:
*পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম: সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি বিভিন্ন গর্ভনিরোধক পদ্ধতি প্রয়োগে সহায়তা করে। বর্তমানে ৬০ টির বেশি কল্যাণকেন্দ্র স্থাপন হয়েছে।
*মেডিকেল কার্যক্রম: প্রসূতি ও শিশুস্বাস্থ্যের উন্নয়নে চিকিৎসা সহায়তা প্রদান।
*শহরকেন্দ্রিক ক্লিনিক স্থাপন: নগরজীবনে সহজলভ্য চিকিৎসা সেবা।
*জনসংখ্যা চলচ্চিত্র প্রদর্শনী: সচেতনতা বৃদ্ধিতে ভিজ্যুয়াল মিডিয়ার ব্যবহার।
*যুব প্রকল্প: তরুণ প্রজন্মের মধ্যে পরিবার পরিকল্পনার ধারণা ছড়িয়ে দেওয়া ও জনসংখ্যা বিষয়ক শিক্ষা দেওয়া হয়।
*ইসলামি গবেষণা সেল: ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে পরিবার পরিকল্পনার গ্রহণযোগ্যতা তুলে ধরা।
*পরিবার পরিকল্পনা প্রকল্প: গৃহভিত্তিক প্রচার ও কনসালটেশন। যা ২৯ টি শহর এলাকায় প্রণয়ন করা হয়েছে।
রেডক্রিসেন্ট সমিতি: বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি পরিবার পরিকল্পনার পাশাপাশি দুর্যোগকালীন স্বাস্থ্যসেবা ও মাতৃসেবা দিয়ে থাকে। তাদের ফিল্ডভিত্তিক কার্যক্রমে নারীদের সচেতনতা ও স্বাস্থ্যসেবার অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।
পাথ ফাইন্ডার: আন্তর্জাতিক এনজিওর অবদান
সত্তরের দশকের শেষের দিকে ও আশির দশকে শুরু হওয়া পাথ ফাইন্ডার আন্তর্জাতিক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কাজ শুরু করে। তারা মূলত গ্রামীণ নারী ও কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতন করে তোলে এবং আধুনিক গর্ভনিরোধক পদ্ধতি প্রয়োগে সহায়তা করে।
এফপিআই ও ফ্যামিলি প্ল্যানিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (FBI):
FPI (Family Planning International) ও FPAB (Family Planning Association of Bangladesh) জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। তারা যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার নিশ্চিত করতে কমিউনিটি লেভেলে কাজ করে। বিশেষ করে বস্তি ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মাঝে তাদের কার্যক্রম প্রশংসনীয়।
ইউএসএআইডি (আমেরিকা সংস্থা): USAID বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে বিশেষ করে পরিবার পরিকল্পনা ও মা-শিশু স্বাস্থ্যখাতে দীর্ঘদিন ধরে অর্থায়ন ও কারিগরি সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। তাদের ফান্ডিংয়ে পরিচালিত প্রকল্পসমূহ স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ, স্বাস্থ্যকেন্দ্র উন্নয়ন ও সরঞ্জাম সরবরাহে সহায়তা করে।
এশিয়া ফাউন্ডেশন ও সিডিএস: এশিয়া ফাউন্ডেশন এবং সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট সার্ভিস (CDS), ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত, এই দুটি সংস্থা গ্রামীণ উন্নয়ন ও স্বাস্থ্যখাতের পাশাপাশি পরিবার পরিকল্পনার ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করছে। তাদের গবেষণামূলক কাজ ও কমিউনিটি এওয়ারনেস কার্যক্রম জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক।
ইনফসন্টস ডুমোট: এনজিও ইনফসন্টস ডুমোট মূলত তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও গবেষণার মাধ্যমে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। তারা বিভিন্ন সরকার ও বেসরকারি উদ্যোগের ফলাফল পর্যালোচনা করে নীতিনির্ধারকদের উপযুক্ত পরিকল্পনা নিতে সাহায্য করে।
ব্র্যাকের অবদান: বাংলাদেশের বৃহত্তম এনজিও ব্র্যাক ১৯৮০ সাল থেকেই পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম শুরু করে। ব্র্যাকের স্বাস্থ্যকর্মীরা ঘরে ঘরে গিয়ে নারীদের আধুনিক গর্ভনিরোধক সম্পর্কে জানায়, এবং কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে সহজলভ্য চিকিৎসা সহায়তা প্রদান করে। তারা পুরুষদেরও পরিবার পরিকল্পনার আওতায় নিয়ে আসায় বিশেষ ভূমিকা পালন করছে।
উপসংহার: বাংলাদেশে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে এনজিওগুলোর অবদান নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। তারা শুধু পরিসংখ্যান নয়, বরং জীবনের মান উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন, এবং স্বাস্থ্যসেবায় এক অব্যাহত সংস্কার এনেছে। সরকার-এনজিও যৌথভাবে কাজ করে গেলে, ভবিষ্যতে একটি সুশৃঙ্খল ও টেকসই জনসংখ্যা কাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব হবে।