বাংলাদেশ সরকারের পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির ব্যর্থতা: একটি সমালোচনামূলক মূল্যায়ন
ভূমিকা: বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার একসময় ছিল আশঙ্কাজনক। এ সমস্যা মোকাবেলায় সরকার ১৯৭০-এর দশক থেকে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি চালু করে। প্রথম দিকে এটি কিছুটা সফলতা অর্জন করলেও সামগ্রিকভাবে কর্মসূচিটি নানা কারণে কাঙ্ক্ষিত ফল দিতে ব্যর্থ হয়েছে। বর্তমানে দেশে স্বাস্থ্যসেবা খাতে উন্নয়ন ঘটলেও পরিবার পরিকল্পনার কার্যক্রম তেমন অগ্রগতি পায়নি। নিচে এ কর্মসূচির ব্যর্থতার বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হলো।
চিকিৎসকদের অপেশাদার আচরণ: পরিবার পরিকল্পনা সংক্রান্ত সেবাদানকারী চিকিৎসকদের মধ্যে অনেকের আচরণ ও মনোভাব পেশাদারসুলভ নয়। তারা গ্রামীণ ও সুবিধাবঞ্চিত জনগণের সঙ্গে প্রায়ই উপেক্ষামূলক বা অবহেলাজনক আচরণ করে থাকেন। কখনো কখনো রোগীর বক্তব্য না শুনে ও প্রয়োজনীয় ব্যাখা না দিয়ে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়, যা স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করে। এই অপেশাদার মনোভাব অনেক নারীকে পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতির প্রতি বিমুখ করে তোলে।
পদ্ধতিগত সমস্যা: পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির নীতিগত দিকগুলোর মধ্যে অসংগতি রয়েছে। অনেক সময় সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার কাজের মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকে। আবার পরিবার পরিকল্পনার প্রচারণা পদ্ধতি এখনও বহু ক্ষেত্রে পুরনো ধ্যান-ধারণার ওপর নির্ভরশীল, যা আধুনিক সমাজের চাহিদা পূরণ করতে ব্যর্থ।
কর্মীদের অদক্ষতা: পরিবার পরিকল্পনা বিভাগে নিযুক্ত অনেক মাঠকর্মী ও স্বাস্থ্য সহকারীদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ না থাকায় তারা সচেতনতামূলক কাজগুলো সঠিকভাবে করতে পারেন না। তারা কীভাবে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করবেন, কাকে কোন পদ্ধতি উপযুক্ত হবে—এসব বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা না থাকায় কার্যকারিতা কমে যায়।
প্রশিক্ষণ কর্মসূচি মূল্যায়নের অভাব: প্রতিনিয়ত কর্মীদের দক্ষতা উন্নয়নে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হলেও এসব প্রশিক্ষণের ফলাফল বা কার্যকারিতা পর্যালোচনা করা হয় না। ফলে প্রাপ্ত জ্ঞান বাস্তবে প্রয়োগে কোনো তদারকি থাকে না। কার্যকর মূল্যায়নের অভাবের কারণে প্রশিক্ষণ শুধুই আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ থাকে।
জন্ম নিয়ন্ত্রণ সামগ্রী সরবরাহ সমস্যা: বিভিন্ন এলাকায় বিশেষ করে দুর্গম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিয়মিত জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী সরবরাহ করা হয় না। ফলে চাহিদা থাকলেও সরঞ্জামের অভাবে মানুষ পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারে না। এমনকি কখনো কখনো সঠিক সময়ের মধ্যে পিল বা ইনজেকশন না পাওয়ার কারণে গর্ভধারণের ঘটনা ঘটে।
সমন্বয় ও মনিটরিং-এর অভাব: কর্মসূচির বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর মধ্যে প্রয়োজনীয় সমন্বয় নেই। একজন ফিল্ড কর্মী যে তথ্য সংগ্রহ করেন, সেটি উচ্চপর্যায়ে উপস্থাপিত হয় না কিংবা সেই অনুযায়ী নীতিমালা তৈরি হয় না। এ ছাড়া নিয়মিত মনিটরিং না থাকায় কর্মসূচির দুর্বলতা চিহ্নিত ও সংশোধন করা সম্ভব হয় না।
দুর্বল তত্ত্বাবধানের অভাব: জেলা ও উপজেলায় কর্মসূচি তত্ত্বাবধানের জন্য নির্ধারিত কর্মকর্তারা অনেক সময় যথাযথ দায়িত্ব পালন করেন না। রাজনৈতিক প্রভাব, প্রশাসনিক গাফিলতি ও দুর্নীতির কারণে তত্ত্বাবধান দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে মাঠপর্যায়ে সেবা প্রদানে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।
উপকরণাদি অপর্যাপ্ততা: পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির আওতায় ব্যবহৃত তথ্যবহুল লিফলেট, ভিডিও, পোস্টার, মডেল ইত্যাদি উপকরণ অনেক ক্ষেত্রেই পর্যাপ্ত নয়। ফলে জনগণ সচেতন হওয়ার সুযোগ পায় না। বর্তমান সময়ে প্রযুক্তির ব্যবহার যেমন মোবাইল অ্যাপস বা অনলাইন প্ল্যাটফর্মের সদ্ব্যবহার করাও হয়নি।
উপসংহার: সর্বশেষ বলা যায় বাংলাদেশের পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি কাঠামোগতভাবে সঠিক হলেও বাস্তবায়নের জায়গায় বহু ঘাটতি রয়েছে। চিকিৎসক ও কর্মীদের পেশাগত উন্নয়ন, প্রশিক্ষণের কার্যকর মূল্যায়ন, উপকরণের পর্যাপ্ততা ও তত্ত্বাবধান জোরদার না করলে এ কর্মসূচির দীর্ঘস্থায়ী সাফল্য সম্ভব নয়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রযুক্তিনির্ভর, অংশগ্রহণমূলক এবং জনমুখী একটি নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ জরুরি, যা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নকেও এগিয়ে নিতে সাহায্য করবে।
- অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখা
- নারীর স্বাস্থ্য ও ক্ষমতায়ন
- জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ
- সমাজে সুস্থ ও শিক্ষিত প্রজন্ম গঠনে সহায়তা
- জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি (Oral pills)
- কনডম (Condom)
- ইনজেকশন (Injectables)
- ইমপ্লান্ট
- আইইউডি (IUD)
- স্থায়ী পদ্ধতি (পুরুষ ও নারীর বন্ধ্যত্বকরণ)