বুখারেস্ট আন্তর্জাতিক জনসংখ্যা সম্মেলন ১৯৭৪: কর্মপরিকল্পনার ১২টি মূল ধারা বিশ্লেষণ
ভূমিকা: ১৯৭৪ সালে রুমানিয়ার রাজধানী বুখারেস্টে জাতিসংঘের উদ্যোগে একটি ঐতিহাসিক আন্তর্জাতিক জনসংখ্যা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, যা “বুখারেস্ট আন্তর্জাতিক জনসংখ্যা সম্মেলন” নামে পরিচিত। এই সম্মেলনে বিশ্বের ১৬৩টি দেশের প্রতিনিধি এবং অসংখ্য বেসরকারি সংস্থা, NGO অংশগ্রহণ করে। মূল উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জনসংখ্যা সমস্যা, উন্নয়ন এবং পরিকল্পনা নিয়ে একটি সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করা।
বিশেষ করে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রেক্ষাপটে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সামাজিক অগ্রগতির পারস্পরিক সম্পর্ক তুলে ধরা হয় এই সম্মেলনে। এতে গৃহীত কর্মপরিকল্পনার ধারাগুলো আজও জনসংখ্যা নীতির ক্ষেত্রে দিকনির্দেশনা হিসেবে বিবেচিত হয়।
নিচে বুখারেস্ট সম্মেলনের ১২টি গুরুত্বপূর্ণ কর্মপরিকল্পনা ধারার বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:
১. জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের মধ্যে ভারসাম্য:
সম্মেলনে বলা হয় যে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার নিয়ন্ত্রণ না করলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যাহত হয়। তাই পরিকল্পিত পরিবার গঠন, সচেতনতা এবং উন্নয়ন কার্যক্রমের মধ্যে একটি সুসমন্বয় জরুরী।
২. পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি প্রসার:
এ সম্মেলনে পরিবার পরিকল্পনার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে জন্মহার কমানোর জন্য জনগণকে সচেতন করা, সুলভ ও নিরাপদ জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সরবরাহের কথা বলা হয়।
৩. নারী শিক্ষা ও ক্ষমতায়ন:
নারীদের শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি এবং নারীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন এই সম্মেলনের অন্যতম বিষয় ছিল। নারী শিক্ষিত হলে তারা সচেতনভাবে পরিবার গঠন করতে পারেন।
৪. স্বাস্থ্যসেবা ও মাতৃস্বাস্থ্য উন্নয়ন:
সম্মেলনে জোর দেওয়া হয় মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্যের উন্নয়নে। গর্ভাবস্থা, প্রসব এবং প্রসব পরবর্তী সেবা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রকে স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগের আহ্বান জানানো হয়।
৫. শ্রমশক্তি উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান:
জনসংখ্যাকে বোঝা না ভেবে সম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। তাই শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি ছিল সম্মেলনের একটি মূল দিক।
৬. দারিদ্র্য দূরীকরণে জনসংখ্যা নীতি:
দারিদ্র্য ও অতিরিক্ত জনসংখ্যা একে অপরের সাথে সম্পর্কযুক্ত। সম্মেলনে উল্লেখ করা হয় যে, দারিদ্র্য হ্রাসের জন্য সুনির্দিষ্ট জনসংখ্যা নীতি গ্রহণ জরুরি।
৭. শিশুদের জন্য শিক্ষা ও সুরক্ষা:
শিশুদের শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি, নির্যাতন ও শোষণ থেকে সুরক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রের দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়।
৮. গ্রামীণ উন্নয়ন ও নগরায়ণ নিয়ন্ত্রণ:
অসংগঠিত নগরায়ণ জনসংখ্যা বিস্ফোরণ ঘটায়। সম্মেলনে বলা হয়, গ্রামীণ উন্নয়নের মাধ্যমে শহরমুখী জনসংখ্যার চাপ কমানো সম্ভব।
৯. পরিবেশ সংরক্ষণ ও টেকসই উন্নয়ন:
অতিরিক্ত জনসংখ্যা পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাই পরিবেশ রক্ষা ও **টেকসই উন্নয়নের সাথে জনসংখ্যা নীতির সামঞ্জস্য** প্রয়োজন।
১০. আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও প্রযুক্তি স্থানান্তর:
বুখারেস্ট সম্মেলনে বলা হয়, উন্নত দেশগুলোকে প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক সহায়তা দিয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সহায়তা করতে হবে।
১১. জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও গবেষণা:
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে জনগণের ভূমিকা অপরিহার্য। তাই মিডিয়া, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং এনজিও-র মাধ্যমে জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও গবেষণাভিত্তিক নীতি প্রণয়ন ছিল সম্মেলনের অন্যতম ধারা।
১২. জনসংখ্যা নীতি প্রণয়নে রাষ্ট্রের দায়িত্ব:
প্রতিটি দেশের নিজস্ব সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট অনুযায়ী জনসংখ্যা নীতি তৈরি ও বাস্তবায়নের জন্য রাষ্ট্রকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে।
উপসংহার: বুখারেস্ট আন্তর্জাতিক জনসংখ্যা সম্মেলন ১৯৭৪ ছিল বিশ্ব ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক, যেখানে জনসংখ্যা, উন্নয়ন ও সামাজিক অগ্রগতির মধ্যে একটি সুসমন্বয় গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়। এর ১২টি কর্মপরিকল্পনা ধারা আজও উন্নয়নশীল দেশের জন্য পথনির্দেশক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
এই সম্মেলন প্রমাণ করে যে, জনসংখ্যা সমস্যা শুধু একটি দেশীয় ইস্যু নয়, বরং এটি একটি বৈশ্বিক উন্নয়ন ইস্যু, যার সমাধানে প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগ।