বেইজিং সম্মেলনের কারণ ও ফলাফল

বেইজিং সম্মেলনের কারণ ও ফলাফল

বেইজিং নারী সম্মেলন ১৯৯৫ কারণ, ফলাফল ও বৈশ্বিক গুরুত্ব


ভূমিকা: ১৯৯৫ সালের ৪-১৫ সেপ্টেম্বর চীনের বেইজিং শহরে অনুষ্ঠিত হয়েছিল এক ঐতিহাসিক বৈশ্বিক আয়োজন—চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলন, যা “বেইজিং নারী সম্মেলন ১৯৯৫” নামে পরিচিত। জাতিসংঘ আয়োজিত এই সম্মেলনে ১৮৯টি দেশের প্রতিনিধি এবং প্রায় ১৭,০০০ প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন, যা ছিল নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী মাইলফলক।


এই সম্মেলনের মূল লক্ষ্য ছিল বৈশ্বিকভাবে নারীর অবস্থান পর্যালোচনা, বৈষম্য হ্রাস, মানবাধিকার রক্ষা এবং নারীর উন্নয়নে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ। বেইজিং ঘোষণা ও প্ল্যাটফর্ম ফর অ্যাকশন (Beijing Declaration and Platform for Action) ছিল এ সম্মেলনের প্রধান দলিল, যা আজও নারীর ক্ষমতায়নের দিকনির্দেশনা হিসেবে বিবেচিত হয়।


বেইজিং নারী সম্মেলনের প্রধান কারণসমূহ


১। নারী ও দারিদ্র্য: বিশ্বের গরিব জনগোষ্ঠীর বিশাল একটি অংশ নারী। দারিদ্র্য নারীদের জীবনে একাধিক প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে—শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, পুষ্টি ও কর্মসংস্থান থেকে তারা বঞ্চিত থাকে। নারী-পুরুষের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে এ বেইজিং সম্মেলন হয় ।

২। নারী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ: শিক্ষা নারীর ক্ষমতায়নের মূল চাবিকাঠি। কিন্তু তখনও অনেক দেশে মেয়েরা বিদ্যালয়ে যেতে পারত না, উচ্চশিক্ষা ও কারিগরি প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করত খুব কম। নারীর জন্য মানসম্মত শিক্ষা ও নারী শিক্ষার হার বাড়ানোর জন্য এ সম্মেলন হয়।


৩। নারী ও স্বাস্থ্য: নারীদের স্বাস্থ্যসেবা, প্রজনন স্বাস্থ্য এবং মাতৃত্বকালীন সুরক্ষায় বৈষম্য বিদ্যমান ছিল। নারীর স্বাস্থ্য অধিকারসহ বাল্যবিবাহ, পুষ্টিহীনতাসহ অন্যান্য সমস্যা সমাধান নিশ্চিত করার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য এ সম্মেলন হয়।


৪। নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা: পারিবারিক সহিংসতা, ধর্ষণ, যৌন নির্যাতন ও মানব পাচারের মতো ভয়াবহ অপরাধ নারীদের জীবনে নিত্যকার হুমকি।  নারী-নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক নীতিমালা প্রণয়ন ও আইনি পদক্ষেপ প্রণয়নের জন্য বেইজিং সম্মেলন হয় ।


৫। নারী ও সশস্ত্র সংঘাত: সশস্ত্র সংঘাত নারীর ওপর বিশেষভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ১৯৪৯ সালের জেনেভা কনভেনশন এবং ১৯৭৭ সালের অতিরিক্ত কূটনৈতিক বিধিতে নারীর সুরক্ষার কথা থাকলেও বাস্তবায়ন দুর্বল ছিল। এ বিষয়ে আরো কার্যকর পদক্ষেপের আহ্বান জানানোর জন্য এ সম্মেলন হয় ।


৬। নারী ও অর্থনীতি: নারীদের শ্রমবাজারে প্রবেশ, সমান মজুরি ও সম্পদের মালিকানা নিশ্চিত না হওয়ায় অর্থনৈতিক দাসত্ব অব্যাহত ছিল। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারীরা বঞ্চিত তাই এ সম্মেলনে নারীর অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধির ওপর জোর দেওয়া হয়।


৭। ক্ষমতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারী: জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণা অনুযায়ী নারী-পুরুষ উভয়ই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের অধিকারী। কিন্তু,  রাজনীতি, প্রশাসন ও কর্পোরেট খাতে নারীর অংশগ্রহণ ছিল সীমিত। নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য বেইজিং সম্মেলন সংঘটিত হয়  ।


৮। নারীর অগ্রগতির জন্য প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতি: নারী উন্নয়নের জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিষ্ঠান গঠন ও শক্তিশালীকরণের প্রয়োজনীয়তা সম্মেলনে গুরুত্ব পায়।


৯। নারীর মানবাধিকার: মানবাধিকার মানুষের জম্মগত অধিকার তবে মানবাধিকার শুধুমাত্র পুরুষদের নয়; নারীরাও তার পূর্ণভাগীদার। কিন্তু সারাদেশে মানবাধিকার লংঘিত হচ্ছে তাই বেইজিং প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে এই নীতি সুনির্দিষ্টভাবে ঘোষণা করার জন্য এ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। 


১০। নারী ও প্রচারমাধ্যম: প্রচার মাধ্যম আধুনিক যুগে অনেক উন্নত। গণমাধ্যমে নারীর বিকৃত উপস্থাপনা এবং নেতিবাচক প্রচারণা ছিল এক বড় সমস্যা। যা নারীর জন্য অবমাননাকর।তাই নারীর ইতিবাচক, সম্মানজনক ও শক্তিশালী উপস্থাপনার গুরুত্ব তুলে ধরার প্রয়োজন ।


১১। নারী ও পরিবেশ: প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার ও সুরক্ষায় নারীর অবদান থাকলেও নীতি প্রণয়নে তাদের ভূমিকা ছিল অনুপস্থিত। ফলে পরিবেশ সংরক্ষণে নারী ভূমিকা রাখতে পারতো না।


বেইজিং নারী সম্মেলনের ফলাফল ও গুরুত্ব


১। নারীর অবস্থা ও সম্মান প্রতিষ্ঠা: বেইজিং সম্মেলনের মাধ্যমে নারীর মর্যাদা, অবস্থা ও সম্মান নিয়ে বৈশ্বিকভাবে আলোচনা শুরু হয়। নারীর অধিকারকে মানবাধিকার হিসেবে বিবেচনা করার একটি ঐতিহাসিক ঘোষণা হয়।


২। বৈষম্য ও সহিংসতা দূরীকরণে পদক্ষেপ: নারীর প্রতি বৈষম্য, যৌন হয়রানি ও সহিংসতা বন্ধে জাতীয় আইন ও নীতিমালা প্রণয়নের ক্ষেত্রে এই সম্মেলন অনুপ্রেরণা জোগায়।


৩। নাইরোবি কর্মকৌশলের বাস্তবায়ন: ১৯৮৫ সালের নাইরোবি নারী সম্মেলনে গৃহীত পরিকল্পনার পূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য নতুন করে অঙ্গীকার করা হয়।


৪। নারী উন্নয়নে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা: বেইজিং প্ল্যাটফর্ম বিভিন্ন দেশকে নারী উন্নয়নমূলক প্রকল্পে বিনিয়োগ ও সহযোগিতার আহ্বান জানায়।


৫। শান্তি অর্জনে নারীর ভূমিকা: স্থানীয় থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায় পর্যন্ত শান্তি প্রতিষ্ঠায় নারীর অংশগ্রহণকে গুরুত্ব দেওয়া হয়।


৬। বাস্তবভিত্তিক কর্মকৌশল গ্রহণ: নারী উন্নয়ন, ক্ষমতায়ন ও সহিংসতা প্রতিরোধে ১২টি বিষয়ভিত্তিক (critical areas of concern) কর্মপরিকল্পনা গৃহীত হয়।


৭। দারিদ্র্য দূরীকরণে নারীর ভূমিকা: নারী ও শিশু দারিদ্র্য স্বীকার করে সমাজে তাদের অবস্থান উন্নয়নের জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়।


৮। আইন প্রণয়নের মাধ্যমে অধিকার রক্ষা: নারীর অধিকার রক্ষায় সদস্য দেশগুলোকে আইন প্রণয়ন, সংস্কার এবং প্রয়োগে অগ্রাধিকার দেওয়ার অনুরোধ করা হয়।


৯। নারীর শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থান: নারীর সমান সুযোগ যেমন- শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও কর্মসংস্থানে নারীর প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার আহ্বান জানানো হয়।


১০। প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো উন্নয়ন: নারীর উন্নয়নের জন্য প্রশাসনিক ও সাংগঠনিক কাঠামো তৈরির প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়।


উপসংহার: বেইজিং নারী সম্মেলন ১৯৯৫ ছিল নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা, ক্ষমতায়ন ও বৈষম্য দূর করার ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। সম্মেলনের ফলস্বরূপ নারীর মর্যাদা, সামাজিক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক অধিকার নিয়ে বৈশ্বিক সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। আজও বেইজিং প্ল্যাটফর্ম ফর অ্যাকশন নারী উন্নয়ন ও সমতার জন্য অন্যতম মূল দিকনির্দেশনা হিসেবে বিবেচিত হয়।

যতদিন পর্যন্ত নারীর বিরুদ্ধে বৈষম্য, সহিংসতা ও বঞ্চনা চলবে, ততদিন বেইজিং সম্মেলনের আদর্শ ও নির্দেশনা আমাদের নীতি-নির্ধারণে পথ দেখাবে। 

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post