বাংলাদেশে মরণশীলতার কারণসমূহ

বাংলাদেশে মরণশীলতার কারণসমূহ

বাংলাদেশে মরণশীলতার কারণ: একটি বাস্তবচিত্র

ভূমিকা: বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সামনে এগিয়ে চলেছে। তবে দেশের সামগ্রিক অগ্রগতির পেছনে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতাগুলোর একটি হলো মরণশীলতার উচ্চহার। মরণশীলতা শুধু জনসংখ্যার স্বাস্থ্য ও স্থিতিশীলতায় প্রভাব ফেলে না, বরং এটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়নকেও ব্যাহত করে। এ লেখায় আমরা বাংলাদেশের মরণশীলতার প্রধান কারণগুলো তুলে ধরবো।

বাংলাদেশে মরণশীলতার কারণ


১। দারিদ্র্য: বাংলাদেশের বহু মানুষ এখনও দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। অর্থনৈতিক দুর্বলতার কারণে অনেকেই প্রয়োজনীয় চিকিৎসা, পুষ্টি ও স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করতে পারে না। অপুষ্টি, অনাহার, ও অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাত্রার কারণে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, যার ফলে মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যায়।


২। উপযুক্ত চিকিৎসার অভাব: গ্রামাঞ্চলে চিকিৎসা সুবিধার ভয়াবহ ঘাটতি রয়েছে। সেখানে আধুনিক হাসপাতাল বা প্রশিক্ষিত ডাক্তার খুবই কম। অনেক সময় রোগীকে সময়মতো চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয় না, যার ফলে সাধারণ অসুস্থতাও প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে। এমনকি শহরাঞ্চলেও ব্যয়বহুল চিকিৎসার কারণে দরিদ্র শ্রেণি সেবা থেকে বঞ্চিত হয়।

৩। স্বাস্থ্যকর পরিবেশের অভাব: অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ যেমন অপরিষ্কার পানি, নোংরা ড্রেনেজ ব্যবস্থা, এবং বায়ুদূষণ বিভিন্ন রোগের জন্ম দেয়। ডায়রিয়া, টাইফয়েড, ডেঙ্গু, ও অন্যান্য পানিবাহিত রোগ বাংলাদেশের শিশু মৃত্যু হার বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। তাছাড়া শিল্পাঞ্চলের বায়ুদূষণও শ্বাসকষ্ট ও হৃদরোগের প্রবণতা বাড়ায়।

৪। সমাজকল্যাণমূলক ব্যবস্থার অভাব: অনেক সময় সরকার কর্তৃক পরিচালিত সমাজকল্যাণমূলক কর্মসূচি বাস্তবায়নে দুর্বলতা দেখা যায়। বিশেষ করে প্রতিবন্ধী, বৃদ্ধ ও একক মায়েদের জন্য পর্যাপ্ত সেবা বা সহায়তা নেই। ফলে এসব গোষ্ঠী উপযুক্ত চিকিৎসা বা সেবা না পেয়ে মৃত্যুর মুখে পড়ে।

৫। পুষ্টিকর খাদ্যের অভাব: অসংখ্য মানুষ এখনো তিনবেলা পুষ্টিকর খাবার পায় না। বিশেষ করে শিশু ও মা’দের ক্ষেত্রে অপুষ্টি মারাত্মকভাবে প্রভাব ফেলে। এটি শুধু রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমায় না, বরং দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটায়, যার ফলে মৃত্যুর হার বাড়ে।

৬। নারী মৃত্যুর উচ্চহার: বাংলাদেশে গর্ভকালীন ও প্রসবকালীন মৃত্যুহার এখনও আশঙ্কাজনক। অনেক নারী গর্ভাবস্থায় সঠিক চিকিৎসা ও পুষ্টি না পাওয়ার কারণে জীবন হারান। তাছাড়া সমাজে নারী স্বাস্থ্যকে কম গুরুত্ব দেওয়ার কারণে নারীদের মরণশীলতার হার তুলনামূলকভাবে বেশি।

৭। যানবাহনের দুর্ঘটনা: বাংলাদেশে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছে। বেপরোয়া চালনা, ট্রাফিক আইন না মানা এবং রাস্তাঘাটের দুরবস্থা এসব দুর্ঘটনার মূল কারণ। অনেক সময় দুর্ঘটনার পর জরুরি চিকিৎসা না পাওয়ায় প্রাণহানি ঘটে।

৮। বাল্যবিবাহ: বাল্যবিবাহ এখনও বাংলাদেশের এক বড় সামাজিক সমস্যা। অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েরা গর্ভধারণে যেমন ঝুঁকিপূর্ণ, তেমনি মা ও শিশুর উভয়ের মৃত্যুর আশঙ্কাও বেশি থাকে। শিক্ষার অভাব ও সামাজিক চাপে মেয়েরা অল্প বয়সে গৃহবধূ হয়ে পড়ে, যার পরিণতিতে তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ে।

উপসংহার: বাংলাদেশে মরণশীলতার পেছনে যে বহুমুখী কারণ রয়েছে, তা স্পষ্ট। তবে সুখবর হলো, সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন এনজিও ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রচেষ্টায় অনেক ক্ষেত্রেই ইতিবাচক পরিবর্তন আসছে। প্রয়োজন শুধু কার্যকর নীতি, পরিকল্পিত কর্মসূচি ও জনসচেতনতা। তাহলেই আমরা একটি সুস্থ, সবল ও উন্নত জাতি গড়তে পারবো।

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post