ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড কী এ বাংলাদেশ কীভাবে সুফল পেতে পারে
ভূমিকাঃ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড হলো কোন দেশের কর্মক্ষম জনসংখ্যা। বিশেষত, যখন কর্মক্ষম জনসংখ্যার (সাধারণত ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী) হার, অপেক্ষাকৃত কম নির্ভরশীল জনসংখ্যার (১৪ বছর বা তার কম এবং ৬৫ বছরের বেশি) হারের চেয়ে বেশি থাকে। সহজ কথায়, একটি দেশের কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা যখন নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যার চেয়ে বেশি হয়, তখন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড আসে।
ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড (Demographic Dividend) হলো কোন দেশের জনসংখ্যার বয়স কাঠামো যা ১৫-৬৪ বছর বয়সি জনসংখ্যা আধিক্য যার কাঠামোগত পরিবর্তনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সম্ভবনা তৈরি হয় । যখন এই কর্মক্ষম জনসংখ্যা দেশের মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশ বেশি থাকে তখন ঐ দেশে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড হয়। মনে করা হয়, এ জনসংখ্যা কোন না কোনভাবে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখে। ইউএনডিপির প্রতিবেদন অনুযায়ী বর্তমানে বাংলাদেশে কর্মক্ষম জনশক্তি ১০ কোটি ৫৬ লাখ যা মোট জনসংখ্যা ৬৬ শতাংশ। ২০৩০ সালে দেশে কর্মক্ষম লোকের সংখ্যা আরো বেড়ে দাঁড়াবে ১২ কোটি ৯৮ লাখ ২০৫০ সাল নাগাদ এ সংখ্যা ১৩ কোটি ৬০ লাখে উন্নতি হবে।
বাংলাদেশের ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড এর সুফল পাওয়ার উপায়সমূহ-
১। সঠিক পরিকল্পনাঃ কর্মক্ষম মানুষকে কাজে লাগাতে প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা। যদি সঠিকভাবে মাস্টার প্লান করে প্রতিটি সেক্টর নিয়ে চিন্তা করে এলাকা ভিত্তিক দক্ষ লোক গড়ে তোলা যায়, কারিগরি শিক্ষার প্রসার করা যায়, হাতে কলমে শিক্ষার মাধ্যমে বিপুল জনসংখ্যা কে মানবসম্পদে পরিণত করা যায় তবেই দেশ সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাবে।
২। যুগোপযোগী শিক্ষা ও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাঃ স্বল্প সম্পদ ও নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যে জনসংখ্যা এখন এদেশের সম্পদ ও সম্ভাবনার বড় জায়গা। এই জনসংখ্যাকে যুগ উপযোগী শিক্ষা প্রয়োজনীয় ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াবে। যেভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে চীন। এই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্টকে কাজে লাগিয়ে দেশটি আজ অর্থনীতিতে রাজত্ব করছে।
৩। পদক্ষেপ, পলিসি ও প্লানিং এর সমন্বয় সাধনঃ বাংলাদেশের জনসংখ্যা বেশি হলেও তা এখন দেশের জন্য আর্শিবাদ হয়ে দেখা দিয়েছে। সত্যিকারের সোনার বাংলা গড়ার এক অপূর্ব সুযোগ তৈরি হয়েছে। এখনই যদি আমরা এই তরুণ কর্মক্ষম জনসংখ্যা কে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারি তবে দেশের অর্থনীতির অল্প দিনে ঘুরে দাঁড়াবে। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ, পলিসি নিতে হবে তাদের নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি প্ল্যানিং করতে হবে। সর্বোপরি গৃহীত প্ল্যানিং অনুযায়ী সঠিক পদক্ষেপ নিতে হবে সময়ের মধ্যে।
৪। সকলের জন্য কর্মসংস্থানের সুব্যবস্থাঃ দেশের ১৬ কোটি জনগণের মধ্য প্রায় ১১ কোটি মানুষ কর্মক্ষম যাদের বয়স ১৫ থেকে ৬৪ এর মধ্যে। এই ১১ কোটির মধ্যে যাদের বয়স 15 থেকে 29 বছর এমন তরুণ প্রয়োজনম আছে প্রায় চার কোটি। তরুণদের বয়স যদি ৩৬ পর্যন্ত ধরি তবে তাদের সংখ্যা বেড়ে হবে সাড়ে ৫ কোটি। এদের কেউ কাজে ঢুকছে ও ঢুকবে। এছাড়া প্রায় এক কোটি ৩০ লাখ যুবক আছে যারা কোন কাজ করে না, কাজের প্রশিক্ষণও নেয় না সম্পূর্ণ বেকার। কিন্তু এরা সবাই কর্মক্ষম। এই কর্মক্ষম সকলেই দেশের প্রবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতে সক্ষম যদি তাদের সকলকে কাজের মধ্যে আনা সম্ভব হয়। তার জন্য প্রয়োজন সকলের যার যার দক্ষতা ও মেধা অনুযায়ী কর্মক্ষেত্রের সুব্যবস্থা।আতা অতি দ্রুতার সাথে করতে হবে সরকারকে।
৫। সময় উপযোগী শিক্ষানীতি প্রণয়নঃ জনসংখ্যা কে কাজে লাগাতে হলে খুবই প্রগতিশীল ও সময় উপযোগী শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতে হবে, যেখানে শ্রম সংশ্লিষ্ট কাজের কথা বলা থাকবে, নৈতিকতার শিক্ষার উপর জোর দেওয়া হবে, উচ্চশিক্ষার কথা বলা থাকবে। উচ্চ মাধ্যমিক থেকে কারিগরি শিক্ষার নিম্ন ব্যবস্থা করতে হবে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত যদি কেউ লেখাপড়া না করে সেও বেশ দক্ষতা অনুযায়ী একটি কর্ম বেছে নিতে পারে। আর যারা পড়বে লেখাপড়া শেষ করে বেকার জীবনে না পড়ে থাকে তার জন্য তাদের মেধা কে কাজে লাগানোর জন্য প্রয়োজনীয় কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। কর্মক্ষম, শিক্ষিত বা অশিক্ষিত একজন মানুষের একটি শ্রম ও যেন অপচয় না হয় সেদিকে লক্ষ্য রেখে কাজের পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্য রেখে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
৬। বাজেট বৃদ্ধিঃ শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও যুব উন্নয়ন খাতে বাজেট বাড়াতে হবে এবং কেবল বরাদ্দ করে বসে থাকলে হবে না শতকরা হার যথাযথভাবে ব্যয় হচ্ছে কিনা তার পরিকল্পনা ও নজরদারিতা বাড়াতে হবে। আমাদের লেভার ইনসেন্টিভ মার্কেট (শ্রম বাজার) থেকে ক্যাপিটাল ইনসেন্টিভ মার্কেটের (পুঁজিপ্রবণ বাজার) দিকে যেতে হবে৷ যার ফলে আমরা পরিকল্পিতভাবে শিল্পায়নের দিকে যেতে পারবো। একই সঙ্গে দক্ষ জনশক্তি ও তৈরি হবে এবং তার ফলে প্রচুর পরিমাণ দক্ষ শ্রমিক ইউরোপ আমেরিকার বাজারে পাঠাতে পারবো।
৭। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠাঃ বাংলাদেশে এখন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড এর গোল্ডেন পিরিয়ড চলছে। ২০০৭ সাল থেকে বাংলাদেশের তরুন ও কর্মক্ষম লোকের সংখ্যা বাড়ছে। এটি ২০৪০ আজ পর্যন্ত থাকবে। এই সময়ে মোট জনসংখ্যার বেশিরভাগ হবে তরুণ ও কর্মক্ষম মানুষ। তাই এই ৩৩ বছরই নির্ধারণ করবে ভবিষ্যৎ আমাদের দেশের অবস্থা কেমন হবে।কিন্তু এর পথে যদি রাজনৈতিক অস্থিরতা বাধা হয়ে দাঁড়াই, বিশৃঙ্খলতা কেড়ে নেয় আমাদের স্বর্ণ সময়ের তেত্রিশ বছর তবে এই দেশ পিছিয়ে যাবে উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা থেকে হাজারগুণ বেশি গতিতে। কাজে আমাদের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনয়ন অত্যন্ত জরুরী।
৮। কৃষির আধুনিকায়ন ও উন্নয়নঃ বাংলাদেশ কৃষি নির্ভর দেশ। এদেশের মোট জনসংখ্যার সিংহভাগ এখনো কৃষিতে নিয়োজিত। যদি দেশের কৃষিকে আধুনিকায়নের মধ্যে আনা সম্ভব হয় তবে অধিকসংখ্যক কর্মক্ষম মানুষ যথাযথভাবে তাদের শ্রম বিনিয়োগ করতে পারবে। কৃষিতে সেজন্য ইতিবাচকভাবে দেখার সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশ শ্রম ভিত্তিক শিল্পের বিকাশ লাভ করছে। যেমন- গার্মেন্টস শিল্প। আমাদের কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক উন্নয়ন করতে গেলে কৃষিতে শ্রমের বিনিয়োগের ব্যবস্থা করে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে হবে। শিল্পের উন্নয়নে আরো গতিশীলতা আনয়ন করে সকল কর্মক্ষম জনগণকে শ্রমের বিনিয়োগ করার পটভূমি প্রস্তুত করতে হবে।
উপসংহারঃ তরুণরাই রাষ্ট্রের প্রাণশক্তি । তাদের যত বেশি কাজে লাগানো যাবে তত বেশি দেশ অগ্রসর হবে। পৃথিবীর বহু দেশ এই তরুণদের কাজে লাগিয়েই উন্নত রাষ্ট্রের কাতারে পৌঁছে গেছে । বর্তমানে বাংলাদেশের চলছে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্টের স্বর্ণ সময়।এটা কোন জাতির মধ্য দীর্ঘ প্রতীক্ষার, দীর্ঘ সময়ের পরে আসে। বাংলাদেশের ২০৪০ সাল পর্যন্ত এই সুযোগের সময় কর্মক্ষম ব্যক্তির আধিক্য সময় চলবে। তাই এই সময়কে যেভাবেই হোক যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে জাতিকে অর্থনৈতিক পরাশক্তিতে পরিণত করতে হবে।
বর্তমান বাংলাদেশের জনসংখ্যা কত
১৬ কোটি ১০ লক্ষ (জুলাই-২০১৬ অনুযায়ী)
Black Death কী
১৩৪৫ থেকে ১৩৫৩ সালে মধ্য ইউরোপ ও এশিয়া মহাদেশে পেস্টিক চ্যাকটেরিয়ায় প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয়ে ৭৫-২০০ মিলিয়ন মানুষ মারা যায়। পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়া এই মহামারীকেই ব্লাক ডেথ বা কাল মৃত্যু বলে