বাংলাদেশে প্রজনন স্বাস্থ্যসেবার গুরুত্ব: সুস্থ জাতি গঠনে অপরিহার্য এক ধাপ
ভূমিকা: বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে স্বাস্থ্যখাতের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা। এটি শুধু নারীর মা হওয়া নয়, বরং সন্তান জন্ম দেওয়ার পূর্ব ও পরবর্তী সময়কাল, নারীর মানসিক ও শারীরিক সুস্থতা এবং পরিবার পরিকল্পনার মতো বিষয়গুলোর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একটি জাতির টেকসই উন্নয়ন ও সুস্থ ভবিষ্যৎ গঠনে প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি।
১. জন্মহার নিয়ন্ত্রণ: অতিরিক্ত জনসংখ্যা বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সমস্যা। সঠিক প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা এবং পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতির মাধ্যমে জন্মহার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব, যা দেশের অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষায় সহায়ক।
২. নিরাপদ মাতৃত্বের সেবা: প্রসবকালীন জটিলতা রোধ ও মায়ের মৃত্যু হার কমাতে নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করা জরুরি। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, প্রশিক্ষিত ধাত্রী ও আধুনিক হাসপাতালের সহজলভ্যতা মায়ের জীবন বাঁচাতে পারে।
৩. পুষ্টি ও সচেতনতা: গর্ভবতী মা ও নবজাতকের পুষ্টি নিশ্চিত করা প্রজনন স্বাস্থ্যের গুরুত্বপূর্ণ দিক। আয়রন, ক্যালসিয়াম, ফোলিক অ্যাসিডের মতো প্রয়োজনীয় উপাদান গ্রহণে সচেতনতা বাড়ালে শিশু বিকলাঙ্গতা বা অপুষ্টি রোধ করা সম্ভব।
৪. নবজাতকের পরিচর্যা: জন্মের পর শিশুর প্রথম ২৮ দিন অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এই সময়ে পর্যাপ্ত পরিচর্যা, টিকাদান ও সঠিক পুষ্টি শিশুর সুস্থ বিকাশে মুখ্য ভূমিকা রাখে।
৫. ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভপাত: অবৈধ ও অনিরাপদ গর্ভপাত বহু নারীর মৃত্যুর কারণ। সচেতনতা, গর্ভনিরোধক ব্যবহারের জ্ঞান ও সামাজিক সহানুভূতি থাকলে এই সমস্যা হ্রাস পাবে।
৬. বন্ধ্যাত্ব দূরীকরণ: অনেক দম্পতি সন্তানহীনতার মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করেন। আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির মাধ্যমে বন্ধ্যাত্ব নিরাময় সম্ভব, তবে এর জন্য প্রয়োজন সচেতনতা ও উপযুক্ত স্বাস্থ্যসেবা।
৭. মানবাধিকার ও নৈতিকতাবোধ: প্রজনন স্বাস্থ্য একটি মৌলিক মানবাধিকার। প্রত্যেক নারী-পুরুষের উচিত এই বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণ করা এবং অন্যের সম্মান বজায় রাখা। জোরপূর্বক বিয়ে, কম বয়সে গর্ভধারণ কিংবা গোপনীয়তা লঙ্ঘন প্রজনন অধিকারের লঙ্ঘন।
৮. পুরুষদের স্বাস্থ্য গ্রহণ: প্রজনন স্বাস্থ্য মানে শুধু নারীর বিষয় নয়। পুরুষদেরও স্বাস্থ্য সচেতন হতে হবে—যেমন যৌনরোগ প্রতিরোধ, সন্তান জন্মের সময় সহায়তা করা, এবং যৌন স্বাস্থ্য সম্পর্কে জানা।
৯. বয়ঃসন্ধিকালে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ: বয়ঃসন্ধিকাল হচ্ছে জীবনের সবচেয়ে স্পর্শকাতর সময়। এই বয়সে ছেলে-মেয়েদের সঠিক দিকনির্দেশনা, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও মানসিক সহায়তা না পেলে তারা ভুল পথে চলে যেতে পারে।
১০. সংক্রমণ রোগ ও এইডস প্রতিরোধ: যৌনবাহিত সংক্রমণ এবং এইডস একবিংশ শতাব্দীর একটি বড় স্বাস্থ্য হুমকি। নিরাপদ যৌন অভ্যাস, পরীক্ষার গুরুত্ব, কনডম ব্যবহারের সচেতনতা এসব রোগ প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
উপসংহার: প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা কোনো বিলাসিতা নয়—এটি একটি মৌলিক প্রয়োজন। সুস্থ মা মানেই সুস্থ জাতি। একজন সচেতন নাগরিক, অভিভাবক ও তরুণ সমাজ হিসেবে আমাদের উচিত এই বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা, শিক্ষা এবং সেবার সুযোগ তৈরি করা। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং মিডিয়াকেও এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে দায়িত্ব নিতে হবে। একটি সচেতন জাতিই পারে ভবিষ্যতের জন্য একটি সুস্থ ও উন্নত প্রজন্ম উপহার দিতে।