ভূমিকম্প: কারণ, প্রভাব, করণীয় ও পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি
ভূমিকম্প হলো পৃথিবীর ভেতরে হঠাৎ করে সঞ্চিত শক্তির মুক্তির কারণে সৃষ্ট একটি প্রাকৃতিক কম্পন যা কয়েক সেকেন্ড থেকে কয়েক মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। এটি পৃথিবীর অন্যতম বিধ্বংসী প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যা মুহূর্তের মধ্যেই ঘরবাড়ি, স্থাপনা, সেতু, রাস্তাঘাট ধ্বংস করে দিতে পারে এবং বড় ধরনের প্রাণহানির কারণ হতে পারে। তাই ভূমিকম্প সম্পর্কে জ্ঞান ও প্রস্তুতি সকলের জন্য জরুরি।
ভূমিকম্প কি?
ভূমিকম্প (Earthquake) হলো পৃথিবীর ভূগর্ভে সঞ্চিত শক্তি হঠাৎ মুক্তি পাওয়ার ফলে সৃষ্ট কম্পন। পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ঠ শক্ত প্লেট দিয়ে তৈরি, যেগুলো সবসময় ধীরে ধীরে নড়াচড়া করে। এই প্লেটগুলো যখন একে অপরের সাথে সংঘর্ষে আসে, সরে যায় বা ঘর্ষণের কারণে আটকে থাকে, তখন তাদের ভেতরে প্রচুর শক্তি জমা হয়। কোনো এক পর্যায়ে এটি আর ধরে রাখতে না পেরে হঠাৎ ফেটে যায় এবং কম্পনের সৃষ্টি হয় এটাই ভূমিকম্প।
ভূমিকম্পের কেন্দ্রকে বলা হয় হাইপোসেন্টার, আর ভূমি পৃষ্ঠে সেই কেন্দ্রের ঠিক উপরের স্থানকে বলা হয় এপিসেন্টার।
ভূমিকম্প কেন হয়?
ভূমিকম্প হওয়ার প্রধান কারণ হলো টেকটোনিক প্লেটগুলোর নড়াচড়া। পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ঠ মোট ৭টি প্রধান ও অনেক ছোট প্লেটে বিভক্ত। এরা সবসময় নড়াচড়া করে।
ভূমিকম্প হওয়ার প্রধান কারণগুলো হল—
১. টেকটোনিক প্লেটের সংঘর্ষ: দুই প্লেট পরস্পরের সাথে সংঘর্ষে এলে শক্তি উৎপন্ন হয়। যেমন- ইউরেশিয়ান প্লেট ও ভারতীয় প্লেটের সংঘর্ষে হিমালয় তৈরি হয়েছে এবং এই অঞ্চলে প্রায়ই ভূমিকম্প হয়।
২. প্লেট স্লাইডিং (একটি প্লেট আরেকটির পাশ দিয়ে সরে যাওয়া): যেমন সান আন্দ্রিয়াস ফল্ট (ক্যালিফোর্নিয়া)। এতে ঘর্ষণ সৃষ্টি হয় এবং হঠাৎ মুক্তি পেলে বড় কম্পন হয়।
৩. আগ্নেয়গিরির কার্যকলাপ: ম্যাগমা উঠানামার কারণে আগ্নেয়গিরি অঞ্চলে ভূমিকম্প ঘটে।
৪. ফাটল (Fault Line): পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ঠে ফাটল রয়েছে। এসব ফাটল বরাবর জমে থাকা চাপ হঠাৎ মুক্তি পেলেই ভূমিকম্প হয়। বাংলাদেশ অবস্থান করছে দুইটি সক্রিয় ফল্ট লাইনের কাছে এজন্য ঝুঁকি বেশি।
৫. মানবসৃষ্ট ভূমিকম্প (কমন নয়):
* বড় ড্যাম তৈরি
* মাইনিং
* জমিতে গভীর খনন
এগুলো ক্ষুদ্র ভূমিকম্প ঘটাতে পারে।
ভূমিকম্পের মাত্রা কিভাবে মাপা হয়?
✔ রিক্টার স্কেল (Magnitude)
এই স্কেলে ভূমিকম্পের শক্তি মাপা হয়।
3.0 – ছোট
5.0 – মাঝারি
7.0+ – বড় ও ধ্বংসাত্মক
✔মারকেলি স্কেল (Intensity)
মানুষ কতটা অনুভব করেছে সেটা মাপা হয়।
ভূমিকম্পের সময় কী হতে পারে?
* ভবন কাঁপতে থাকা
* দেয়ালে ফাটল
* জিনিসপত্র পড়ে যাওয়া
* রাস্তা ফেটে যাওয়া
* গ্যাস লাইন লিক
* বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন
* আতঙ্কে মানুষের হুড়োহুড়ি
এই সময় শান্ত থাকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
ভূমিকম্প হলে করণীয়
ভূমিকম্প চলাকালীন সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত প্রাণ রক্ষা করতে পারে। নিচে ঘরে, বাইরে এবং গাড়িতে থাকা অবস্থায় করণীয় তুলে ধরা হলো-
যদি আপনি ঘরের ভেতরে থাকেন
✔ ১.Drop, Cover, Hold পদ্ধতি অনুসরণ করুন
* মাটিতে বসে পড়ুন
* মজবুত টেবিল/ডেস্কের নিচে আশ্রয় নিন
* টেবিলের পা শক্ত করে ধরে থাকুন
✔ ২. দরজা বা জানালার কাছে যাবেন না
এগুলো থেকে কাচ ভেঙে আঘাত লাগতে পারে।
✔ ৩. লিফট ব্যবহার করবেন না
সবসময় সিঁড়ি ব্যবহার করুন।
✔ ৪. রান্নাঘরে থাকলে চুলা বন্ধ করে বের হয়ে আসুন
গ্যাস লিক হয়ে বড় দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে।
✔ ৫. বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি থেকে দূরে থাকুন
যদি আপনি বাইরে থাকেন
* ভবন, গাছ, বৈদ্যুতিক খুঁটি থেকে দূরে নিরাপদ স্থানে যান
* খোলা মাঠে থাকলে সবচেয়ে নিরাপদ
* সেতুর নিচে বা ভবনের ছায়ায় দাঁড়াবেন না
যদি গাড়িতে থাকেন
* গাড়ি থামিয়ে রাস্তায় দাঁড়ান
* সেতু, ফ্লাইওভার, বিল্ডিংয়ের নিচে নয়
* গাড়ির ভেতরেই থাকুন কম্পন থামা পর্যন্ত
ভূমিকম্পের আগে করণীয় (পূর্বপ্রস্তুতি)
ভূমিকম্প কখন হবে কেউ বলতে পারে না, তাই প্রস্তুতি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
✔ ১. জরুরি ব্যাগ প্রস্তুত রাখুন
ব্যাগে রাখুন-
* পানি
* শুকনো খাবার
* টর্চ
* পাওয়ার ব্যাংক
* ওষুধ
* ফার্স্ট এইড
* কাগজপত্রের কপি
* নগদ টাকা
✔২. ঘরের ভারী জিনিসপত্র সুরক্ষিতভাবে বসান
* আলমারি/শোকেস দেয়ালের সাথে স্ক্রু দিয়ে বেঁধে রাখুন
* গ্লাসের জিনিসপত্র নিচের তাকে রাখুন
✔৩. পরিবারকে ভূমিকম্প মহড়া শেখান
সন্তানদের Drop–Cover–Hold অনুশীলন করান।
✔৪. গ্যাস লাইন, ইলেকট্রিক লাইন নিয়মিত চেক করুন
✔৫. বের হওয়ার পথ আগে থেকে ঠিক করে রাখুন
ভূমিকম্পের পর করণীয় (পরবর্তী কার্যক্রম)
ভূমিকম্প থেমে গেলেও বিপদ কাটে না। পরবর্তী সময়ে সতর্ক থাকতে হবে।
✔১. ভবন চেক করুন
ফাটল, ঝুঁকিপূর্ণ অংশ, দেয়াল ক্ষতিগ্রস্ত হলে ভবনে প্রবেশ করবেন না।
✔২. গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির লাইন বন্ধ করুন
লিক বা শর্ট সার্কিট হলে বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
✔৩. এলিভেটর ব্যবহার করবেন না
লিফট আটকে যেতে পারে।
✔৪. পরিবার ও প্রতিবেশীদের সাহায্য করুন
বিশেষ করে
* শিশু
* বৃদ্ধ
* অসুস্থ
* প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা
✔৫. রেডিও বা মোবাইল দিয়ে খবর শুনুন**
সরকারি নির্দেশনা অনুসরণ করুন।
✔৬. আফটারশক বা পরাঘাতের জন্য প্রস্তুত থাকুন
ভূমিকম্পের পর আবারো ছোট বা বড় কম্পন হতে পারে।
✔৭. রক্তদান ও জরুরি সেবায় যুক্ত হোন (যদি সম্ভব হয়)
বাংলাদেশে ভূমিকম্প ঝুঁকি
বাংলাদেশ ভারতীয় প্লেট ও বার্মিজ প্লেটের কাছে অবস্থিত হওয়ার কারণে ঝুঁকি অনেক বেশি। ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম এবং বঙ্গোপসাগর উপকূলীয় অঞ্চল ১ম ও ২য় শ্রেণীর ঝুঁকিপূর্ণ জোনে রয়েছে।
ভবিষ্যতে বড় ভূমিকম্পের সম্ভাবনা থাকায় সচেতনতা ও প্রস্তুতি অত্যন্ত জরুরি।
উপসংহার: ভূমিকম্প একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কিন্তু সচেতনতা ও পূর্বপ্রস্তুতি জীবন রক্ষা করতে পারে। ভূমিকম্পের সময় শান্ত থাকা, Drop Cover Hold পদ্ধতি অনুসরণ করা, পরিবারকে প্রস্তুত রাখা এবং পরবর্তীকালে নিরাপদ পদক্ষেপ নেওয়া এসবই আমাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বাড়ায়। নিজের এবং সমাজের সুরক্ষার জন্য সবাইকে ভূমিকম্প সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান রাখতে হবে।

No comments:
Post a Comment