এথনিক অসমতা কী? এথনিক অসমতার কারণগুলো তুলে ধর

এথনিক অসমতা বলতে কী বুঝায়?

ভূমিকা: এথনিক গ্রুপ হচ্ছে এমন একটি সামাজিক গোষ্ঠী যাদের নিজস্ব একটি বিশেষ ভাষা ও সংস্কৃতি রয়েছে যা অন্যদের থেকে ভিন্ন। এরা কোনো রাষ্ট্রীয় পরিসীমায় নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয়তা নিয়ে বসবাস করে। সংখ্যাগুরুদের সাথে সংখ্যালঘু বা এখনিক সম্প্রদায়ের ব্যাপক অসমতা ও পার্থক্য লক্ষ করা যায়।

এথনিক অসমতা কী? এথনিক অসমতার কারণগুলো তুলে ধর

এথনিক অসমতা: রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় সংখ্যালঘু এখনিক সম্প্রদায়ের প্রতি যেসব বৈষনামূলক আচরণ আচার-আচরণ করে থাকে তাকে এথনিক অসমতা বালে। এথনিক গোষ্ঠীর ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, রীতিনীতি সবই বৃহত্তর জনগোষ্ঠী থেকে পৃথক। এখনিক গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য দেখে তাদেরকে চিহ্নিত করা যায়। ব্যক্তির মনোভাব, ব্যক্তিত্ব, মূল্যবোধ, বিশ্বাস, রুচিবোধ ইত্যাদি স্বারা তাদের সমাজ মৌলভাবে প্রভাবিত। কিন্তু সমতলের সংখ্যাগুরু গোষ্ঠী তাদেরকে অসম মনে করে থাকে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্যাভ্যাস, চাকরির সুযোগ প্রভৃতি ক্ষেত্রে আইনে সমতা থাকলেও তা বাস্তবে তেমন একটা দেখা যায় না। তাদের অনেক চড়াই-উতরাই পার করে সবার সাথে অধিক যোগ্যতা প্রমাণ করতে হয়।

এছাড়াও সীমিত সম্পদ ও সুযোগ অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা সৃষ্টির অন্যতম কারণ, যা এথনিক অসমতা সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিগত আমেরিকার নির্বাচনে দৈহিক সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য এখনিক অসমতাকে দৃঢ়ভাবে প্রমাণ করেছে। আমেরিকার শ্বেতকায় ও কৃষ্ণকায় পৃথক স্কুল ও হোটেল তাদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করেছে।

প্রভাবশালীরা সবসময় এথনিক সম্প্রদায়কে তাদের নিয়ন্ত্রণে রেখে কর্তৃত্ব করে চলতে চেষ্টা করে। এতে অসমতা বেড়ে যায়। এথনিসিটির সাথে যেহেতু নাগরিকত্বের কোনো সম্পর্ক নেই, সেহেতু মূলধারার লোকেরা তাদেরকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য মনে করে এখনিক অসমতা বৃদ্ধি করে থাকে। এথনিক গোষ্ঠী নিজেদেরকে কখনোই জাতীয়তাবাদী মনে করতে পারে না। কারণ তারা মূলত সংখ্যালঘু। এখনিসিটি অত্যন্ত সীমিত পরিসরে কয়েকজন মানুষের মধ্যেও কাজ করতে পারে। এদের মধ্যে যেহেতু কোনো ধরনের দমন, ক্ষমতায়ন বা নেতৃত্বের বিষয় যুক্ত থাকে না, তাই তারা সবসময় নির্যাতিত, শোষিত ও বঞ্চিত হয়ে থাকে।

সর্বশেষ বলা যায়, একটি জাতিরাষ্ট্রের অংশ হয়েই এথনিক গোষ্ঠী বেঁচে থাকে। অন্য গোষ্ঠীর কাছ থেকে তারা সবসময় অসম অবস্থার স্বীকার হয়। তবুও তাদের কোনো অভিযোগ নেই। তারা তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃরিতে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ

এথনিক অসমতার কারণগুলো তুলে ধর।

এথনিক গ্রুপ কোনো না কোনো রাষ্ট্রীয় পরিসীমায় নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয়তা নিয়ে বসবাস করে। যেহেতু একটি রাষ্ট্রের নির্দিষ্ট এলাকায় পৃথক জীবনযাপন প্রণালি ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য নিয়ে বসবাস করে, সেহেতু এ সম্প্রদায়কে এথনিক গ্রুপ বলা হয়ে থাকে। আদিম সমাজের মানুষ রক্তের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে বসবাস করে। এ ধরনের দলকেই এথনিক গ্রুপ বলা হয়। বিশ্বের প্রায় সব দেশেই বিভিন্ন ধরনের এথনিক গ্রুপ-এর বসবাস হয়েছে।

এথনিক অসমতার কারণ: এথনিক অসমতা সুদীর্ঘকাল ধরে এথনিক গোষ্ঠী ও নৃ-গোষ্ঠী প্রত্যয়গুলোর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নানাবিধ অবস্থায় বহুবিধ কারণ দ্বারা এথনিক অসমতার অস্তিত্ব ক্রমশই সুস্পষ্ট হচ্ছে। সমাজবিজ্ঞানী, নৃবিজ্ঞানিশ্বণ নিম্নোক্ত বিষয়াবলির ওপর বিশেষ আলোকপাত করেছেন।

১. ব্যক্তিগত মনোভাব, ব্যক্তিত্ব ও মূল্যবোধ: এথনিক গোষ্ঠীর পরিচিতির সামাজিক ভিত্তি হলো সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য। ব্যক্তির মনোভাব, ব্যক্তিত্ব, মূল্যবোধ, বিশ্বাস, রুচিবোও ইত্যাদি সংস্কৃতি দ্বারা অতিমাত্রায় প্রভাবিত হতে থাকে। আবার ব্যক্তি সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই স্ব-স্ব পরিমণ্ডল, সমাজ ও পরিবারে নিজ নিজ বলয় সৃষ্টি করে থাকে।

ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব, বিশ্বাস, মুল্যবোধ ইত্যাদি সমাজ ও সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত। সমাজে বসবাস করতে গিয়ে ব্যক্তি নিম্ন গোষ্ঠী সম্পর্কে এবং চারপাশের অন্যান্য গোষ্ঠী ও সমাজ সম্পর্কে একটা ধারণা অর্জন করে। সে কারো প্রতি বা বিশেষ গোষ্ঠীর প্রতি বিদ্বেষী, নিরপেক্ষ, উদার বা বন্ধুত্বের মাসাতাৰ ও সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে। কখনও বা কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নিজদেরকে অন্যান্য গোষ্ঠীর চেয়ে উৎকৃষ্ট বা নিকৃষ্ট মান করতে পারে এবং সে অনুযায়ী তার মনোভাব গড়ে ওঠে। এভাবে কারো যধ্যে Superiority comples es Inferiority complex দানা বেঁধে উঠতে পারে। এর ফলে একে অপরের প্রতি বিদ্বেশপূর্ণ মনোভাব ও বৈষম্যমূলক আচরণ করতে পারে। কখন ও বা দেখা যায় অতান্ত কর্তৃত্বব্যঞ্জক ব্যক্তিত্বের লোক যখন তার সমমর্যাদায় কারো সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হিমশিম খাচ্ছে বা টিকে থাকতে পারছে না তখন তার অপারগতা বা দুর্বলতা ঢাকার জন্য তার রাগ, ক্ষোভ, অভিমান এমন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর ওপর প্রকাশ করে যারা তার চেয়ে দুর্বলতার, এভাবেই এথনিক অসমতা তৈরি হয়।

২. এথনিক গোত্রীয় সামাজিক মিথক্রিয়ার প্রকৃতি: সামাজিক মিথস্ক্রিয়া অতিমাত্রায় এথনিক অসমতাকে প্রভাবিত করে থাকে। এই সামগ্রিক প্রক্রিয়া এথনিক নৃগোষ্ঠীর মধ্যে দৃঢ় সামাজিক সংহতি সৃষ্টির মাধ্যমে আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্ক সৃষ্টি করে থাকে, যা নানা প্রকার অসংল্যাভাকে দূরীভূত করতে পারে।

৩. আর্থসামাজিক অবস্থা: বস্তুত সীমিত সম্পদ ও সুযোগ অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা সৃষ্টির অন্যতম প্রধান কারণ, যা এথনিক অসমতা সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। একই সমাজে বসবাসকারী বিভিন্ন এথনিক গোষ্ঠীর সদস্য যখন সীমিত সম্পদ ও সুযোগের জন্য প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়, তখন প্রভাবশালীদের ভূমিকার ওপর নির্ভর করে সমাজে এথনিক অসমতা তৈরি হবে, নাকি সমতার নীতি গৃহীত ও কার্যকর হবে।

মার্কসীয় তাত্ত্বিকরা মনে করেন যে, এথনিক অসমতা হচ্ছে অর্থনৈতিক শোষণের একটি ধরন বা রূপ। অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় শাসক শ্রেণির প্রয়োজন হয় সস্তায় শ্রমের যোগান এবং শাসক শ্রেণি এটাও চায় যে, সন্তায় যারা শ্রম বিক্রি করে সেই শ্রমিক শ্রেণি যেন সংগঠিত হয়ে শাসকদের ক্ষমতা থেকে সরিয়ে না দেয়। শাসক শ্রেণির দৃষ্টিতে অন্য গোষ্ঠীকে আর্থিকভাবে পঙ্গু করে নিম্ন অবস্থানে রাখতে পারলে সুবিধা হয়। বস্তুত দৈহিক ও সাংস্কৃতিক পার্থক্যগুলো প্রভাবশালী-প্রভাবাধীন বা শাসক শাসিতের 'চিহ্ন' হিসেবে কাজ করে। যেমন- আমেরিকায়। কৃষ্ণকায়দের চামড়ার রং সমাজে তাদের নিচে অবস্থানের চিহ্ন বহন করে। এতে করে এমন আদর্শের উদ্ভব ঘটতে পারে, যা সাদা-কালোর ব্যবধানের ভিত্তিতে সামাজিক অসমতা 'স্বাভাবিক' বলে ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম।

ট্যাব, গ্লাসকো এবং রেইচ বলেন যে, এক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অন্য গোষ্ঠীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লাগিয়ে দিয়ে শাসক শ্রেণি জনগণকে বিভক্ত করে রাখে, যাতে তারা শাসকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে না পারে। শাসক শ্রেণি যে অর্থনৈতিক সম্পন নিয়ন্ত্রণ করছে সেটা থেকে জনগণের দৃষ্টিকে অন্যদিকে সরিয়ে নেয়ার কাজটিও এভাবে সম্ভব হয়। এমনকি অমার্কসীয় তাব্লিকরাও মনে করেন যে, এথনিক অসমতার অন্যতম কারণ বা উপাদান হলো অর্থনৈতিক শোষণের ফলে সমাজে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উপাদানগুলোর মধ্যে যে জটিল অথচ তাৎপর্যপূর্ণ পারস্পরিক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকে, সেটা উপেক্ষিত হয়। ঔপনিবেশিক সম্পর্কের পাঁচটি উপাদানের কথা জানা যায়। এগুলো হলো-

(১) প্রভাবশালী গোষ্ঠীতে অপ্রভাবশালী স্থানীয়দের জোরপূর্বক অন্তর্ভুক্ত। (২) সংস্কৃতিকে নিয়ন্ত্রণ ও তাতে পরিবর্তন আনতে প্রভাবশালীদের প্রয়াস। (৩) রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রয়ণ। (৪) অর্থনৈতিক শোষন এবং (৫) এমন আদর্শ গড়ে তোলা যা প্রভাবশালীদের নিয়ন্ত্রণকে যথাযথ বলে সমর্থন দেয়। অন্যদের এথনিক গোষ্ঠীর তুলনায় কৃষ্ণকায়, স্থানীয় আমেরিকান এই মেক্সিকান আমেরিকানরা স্বদেশে আর্থরাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণে তেমন কোনো সমতা নেই। তাদের অধিকাংশ সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করে বাইরের প্রভাবশালীরা। এসব এথনিক গোষ্ঠীর দু'চার জনকে সরকারি সংস্থায় প্রতিনিধি হিসেবে নেয়া হয় প্রভাবশালীদের স্বর্গ রক্ষার্থেই ঐসব এথনিক গোষ্ঠীর সংস্কৃতিকে নিকৃষ্ট আখ্যা দিয়ে ধ্বংস করার চেষ্টা হয়েছে এবং সেখানে প্রভাবশালীদের সংস্কৃতির উপাদান অনুপ্রবেশের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

৪. দৈহিক সাংস্কৃতিক পার্থক্য: ঐ ব্যক্তির দৈহিক, সাংস্কৃতিক পার্থক্য এথনিক অসমতার অন্যতম কারণ। দৈহিক সাংস্কৃতিক পার্থক্য বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। বিগত আমেরিকায় নির্বাচনে দৈহিক, সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য এথনিক অসমতাকে দৃড়ভাবে প্রমাণ করেছে। এথনিক গোষ্ঠীগুলো যদি সামাজিকভাবে পরস্পর বিচ্ছিন্ন থাকে, সামাজিক যোগাযোগ তথ্য সামাজিক মিথস্ক্রিয়া যদি তেমন একটা সংঘটিত না হয়, তাহলে পরস্পরকে কারণে-অকারণে ভুল বোঝাতে থাকে এবং সামাজির সুরত্ব বেড়ে চলে। এভাবে একে অপরের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব গড়ে তোলে, যা বৈষম্যমূলক আচরণের সূত্রপাত করায় পারে। বস্তুত গবেষণায় এটাই প্রমাণিত হয়েছে যে, আমেরিকান সমাজে কৃষ্ণকায় ও শ্বেতকায়দের ভিন্ন ভিন্ন স্কুল, হোটেল ইত্যাদি তাদের মধ্যকার দূরত্ব বৃদ্ধি করেছে, যা এখনিক বৈষম্যকে তাড়িয়ে দেয় এবং আন্তঃনৃগোরী যোগাযোগ ও সম্পর্ক নৃগোষ্ঠীগর বিয়েষের মাত্রা কমিয়ে আনে।

No comments:

Post a Comment