কুট্টি সম্প্রদায় সম্পর্কে লেখ। গারো সমাজের পরিবর্তনের কারণগুলো উল্লেখ কর

কুট্টি সম্প্রদায় কারা? গারো সমাজের পরিবর্তনের কারণগুলো

ভূমিকা: বাংলাদেশে কুট্টি সম্প্রদায়ের আগমন ঘটে বেশি কিছু সময় থেকে। এ সম্প্রদায় ভারতের বিহার  অঞ্চল থেকে আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে এদেশে আসতে থাকে।

কুট্টি সম্প্রদায় সম্পর্কে লেখ। গারো সমাজের পরিবর্তনের কারণগুলো উল্লেখ কর

কুট্টিদের পরিচয়: কুটি শব্দটির অর্থ হচ্ছে খেদমতকারী। এরা প্রায় সকলে মুঘল আমলে পেয়াদা, বাবুর্চি, আয়া, খানসামা, গাড়োয়ান ছিল। তারা ছিল আজ্ঞাবহ শ্রেণি। অর্থাৎ, তারা মুঘল ও ঢাকাইয়া নবাবদের খেদমত ছাড়া কিছুই বুঝত না।

বাসস্থান: সাধারণত কুট্টিদের আদি বাসস্থান বাংলার বাইরে। এ সম্প্রদায় ভারত থেকে আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে এদেশে আসতে শুরু করে। কুটি সম্প্রদায় ঢাকার চকবাজার, ইসলামপুর, বাবুবাজার, টিকাটুলি ইত্যাদি এলাকায় বসতি স্থাপন করে।

ভাষা: মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত কুট্টিদের একটি স্বতন্ত্র ভাষা রয়েছে। এদের ভাথাকে 'খোট্টা' ভাষা বলা হয়। বাংলার সাথে উর্দু ও হিন্দি ভাষার সংমিশ্রণে এ ভাষা গড়ে উঠেছে।

অর্থনীতি: ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর তাদের রাতারাতি ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটে। সাম্প্রদায়িক কারণে পুরাতন ঢাকাকেন্দ্রিক বংশীয় জমিদার পরিবারগুলো যখন ভারতে যেতে শুরু করে, তখন তাদেরই নৃত্য, দারোয়ান এবং বিভিন্ন দেখাশুনার কাজে নিয়োজিত এই কুট্টি তাদের ফেলে যাওয়া সমস্ত সম্পত্তি হস্তগত করে। কুট্টি আর্থিকভাবে অত্যন্ত সবল।

সমাজকাঠামো: কুট্টিদের সমাজ কাঠামো ছিল সর্দার প্রথা ভিত্তিক। সমস্ত এলাকাটিকে তারা ১২টি অঞ্চলে ভাগ করে নিয়েছিল। প্রতিটি অঞ্চল পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি করে পঞ্চায়েত কমিটি থাকত। কমিটির প্রধান ছিল সর্দার। আর সব সর্দার ছিল নবাবের অধীনে। কোনো কোনো সর্দার আবার অত্যন্ত প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিল। তাদের মধ্যে মওলাবখস এবং মাজেদ সরদার ছিলেন অন্যতম। বর্তমানে এই পঞ্চায়েত প্রথার আর প্রচলন দেখা যায় না।

ধর্মীয় অনুষ্ঠান: কুট্টি বছরে বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব পালন করে। ঈদ, রমজান, শবেবরাত প্রস্তুতি তাদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। বিয়ে এবং বিভিন্ন পারিবারিক অনুষ্ঠানগুলোতে তারা বেশ আয়োজনের সাথেই করে থাকে।

শ্রেণিবিভাগ:  কুট্টিরা তিন শ্রেণিতে বিভক্ত। এই তিন শ্রেণির মধ্যে সামাজিক আদান-প্রদান, মেলামেশা ও বিয়ে-শাদি হয়। কুট্টিদের তিনটি শ্রেণির নাম- (১) পানু কুট্টি, (২) হাত কুট্টি ও - (৩) চুটকি কুট্টি। পানু কুট্টি সংখ্যায় বেশি।

পরিশেষে বলা যায় যে, কুট্টিরা এখন বাংলাদেশে একটি সম্পাসারিত সম্প্রদায়। কিন্তু সার্বিকভাবে এদেশের বাঙালি সমাজ তাদেরকে আজো অশিক্ষিত, নিম্ন সমাজভুক্ত সম্প্রদ হিসেবে দেখতে অভ্যন্ত। তবুও বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সাথে মিলেমিদে ধর্মীয় এবং বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানাদি সম্পন্ন করছে এরা সে সাথে বিভিন্ন গোষ্ঠীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছে।


গারো সমাজের পরিবর্তনের কারণসমূহ

বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কারণে গারো সমাজ পরিবর্তিত হচ্ছে। মূলত কৃষিতে নতুন পদ্ধতি গ্রহণ, বাজার অর্থনীতির অনুপ্রবেশ, প্রতিবেশী বাঙালি সমাজের সঙ্গে যোগাযোগ, খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ, আধুনিক শিক্ষা এবং বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক প্রভাব ইত্যাদির ফলে গারো সমাজের পরিবর্তন প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে।

গারো সমাজের পরিবর্তনের কারণ: নিম্নে গারো সমাজের পরিবর্তনের কারণসমূহ উল্লেখ করা হলো-

১. পরিবার ও বিবাহ ব্যবস্থার পরিবর্তন: সাধারণভাবে দেখা যায় যে, গারো পরিবারের বিবাহ ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে নি। তবে যতটুকু পরিবর্তন লক্ষ করা যায়, সেটা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। শিক্ষিত গারো মাতৃবাসের বিপরীত রীতি পিতৃবাসে অভ্যস্ত হচ্ছে।

২. শিক্ষার ক্ষেত্রে পরিবর্তন: ১৯ শতকের শেষ দিকে গারো অঞ্চলে খ্রিষ্টান মিশনারি ও ব্যাষ্টিসের আগমন ঘটে। তারা গারোদের কেবল যে খ্রিষ্টধর্মেই দীক্ষিত করেছে তা নয়, সে সাথে গারো এলাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। গারোদের শিক্ষার যার আজকাল ২০% ছড়িয়ে গিয়েছে। শিক্ষার প্রসার ঘটার ফলে গারো সমাজে গতিশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেকে চাকরি করছে।

৩. অর্থনৈতিক পরিবর্তন: বর্তমানে গারো সমাজে জুমচাষের স্থলে হালকৃষি প্রবর্তিত হয়েছে। এতে বিভিন্ন ধরনের ফসল উৎপাদিত হচ্ছে। ক্ষুদ্র অর্থনীতির প্রচলনের ফলে আর্থিক বৈষম্য ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

৪. ধর্মীয় পরিবর্তন: বর্তমান বাংলাদেশে গারোদের ৯০% খ্রিষ্টান ধর্মানুসারী। তবে ঐতিহ্যবাহী ধর্মের স্থলে অনেকেই তাই খ্রিষ্টান ধর্ম অনুসরণ করেছে। খ্রিষ্টীয় চার্চ এখন তাদের ধর্মের অন্যতম আকর্ষণীয় প্রতিষ্ঠান।

৫. রাজনৈতিক পরিবর্তন: এখন গারো সমাজ আর ভিন্ন জনপদ নয়। তারা এখন বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় শাসনাধীন।যেখানে বাংলাদেশের প্রশাসনিক কাঠামো এবং রাজনৈতিক অনুষ্ঠান প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। ফলে ঐতিহ্যবাহী গারো গ্রাম প্রধানের গুরুত্ব কমে গিয়েছে।

পরিশেষে বলা যায় যে, গারো সমাজের জরবিন্যাসে শিক্ষা অচিরেই এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে মনে হয়।

No comments:

Post a Comment