বাংলাদেশের প্রধান প্রধান উপজাতি/ আদিবাসী এথনিক গোষ্ঠীর নৃগোষ্ঠীগত পরিচয় আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের প্রধান প্রধান এথনিক গোষ্ঠীর নৃতাত্ত্বিক পরিচয় তুলে ধর।
ভূমিকা: বাঙালি জাতির নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ে দেখা যায় বাঙালিরা সংকর জাতি, অর্থাৎ বিভিন্ন নরগোষ্ঠীর সংমিশ্রণ এ বাঙালিদের উৎপত্তি। এজন্যই এদেশের উপজাতি বা আদিবাসীদের নরগোষ্ঠীগত পরিচয়ে সংমিশ্রণ থাকাটাই স্বাভাবিক। উপজাতিরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশ থেকে এদেশে এসে বসতি স্থাপন করেছে। নৃবিজ্ঞানীদের মতে, "বিশুদ্ধ নৃগোষ্ঠী একটি অলীক কল্পনা। নৃবিজ্ঞানী বিরাজ শংকর উপমহাদেশের জনগোষ্ঠীকে ছয়টি নরগোষ্ঠীতে ভাগ করেছেন। সেই প্রেক্ষিতে এদেশের উপজাতিদের দ্রাবিড়ীয় আদি অস্ট্রেলীয়, মঙ্গোলীয়, ককেশীয় প্রভৃতি নৃগোষ্ঠীতে বিভক্ত করা হয়েছে।
বাংলাদেশের প্রধান প্রধান উপজাতি/আধিবাসী/এথনিক গোষ্ঠীর নৃগোষ্ঠীগত পরিচয়:
নিম্নে বাংলাদেশের প্রধান প্রধান উপজাতিসমূহের নৃগোষ্ঠীগত বা নৃতাত্ত্বিক পরিচয় তুলে ধরা হলো-
১. চাকমাদের নৃগোষ্ঠীগত পরিচয়: নৃগোষ্ঠীগত পরিচয়ের ব্যাপারে চাকমাদের মতভেদ রয়েছে। তবে এদের সাথে চীনা মঙ্গোলয়েডদের যথেষ্ট মিল রয়েছে। তাদের দৈহিক উচ্চতা মাঝারি থেকে বেঁটে পর্যন্ত হয়। গায়ের লোমের স্বল্পতা, দৈহিক গড়ন শক্তিশালী, নাক চ্যাপ্টা, ছোট চোখ, নাদুস আঁটসাঁট স্বাস্থ্য। তারা মগদের চেয়ে অধিক পরিষ্কার ও সুন্দর। চাকমাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো মুখমণ্ডল বেশ প্রফুল্ল।
২. গারোদের নৃগোষ্ঠীগত পরিচয়: গারোদের নৃগোষ্ঠীগতভাবে মঙ্গোলয়েড বলা হয়। কেননা এদেরে দেহে মঙ্গোলয়েড নৃগোষ্ঠীর প্রভাব রয়েছে। গারোদের মুখমণ্ডল গোলাকার এবং সমতল। তাদের ক্ষুদ্রাকৃতির নাক চ্যাপ্টা ও প্রশস্ত, ঠোঁট মোটা, চুল কালো কোঁকড়ানো ঢেউ খেলানো, কান বৃহদাকার, পুরুষের মুখে দাঁড়ি পরিমাণ কম এবং পুরুষ মহিলার গড় উচ্চতা পাঁচ ফুট। তারা কর্মঠ এবং দৈহিক গড়ন পাতলা।
৩. সাঁওতালদের নৃগোষ্ঠীদের পরিচয়: সাঁওতালরা আদি আস্ট্রলীয়। আদি অস্ট্রেলীয় গোষ্ঠীর দৈহিক গঠন এবং এদের দৈহিক গঠন প্রায় এক। এদের চেহারা কালো, নাক চ্যাপ্টা এটি মোটা, চুল কোঁকাড়ানো এবং দেহের উচ্চতা মাঝারি ধরণের। এদের দাড়ি গোঁফ মাঝারি ধরনের। এসব কারণে সাওতালদেরকে প্রাক দ্রাবিড়ীয় বলা হয়।
৪. মুরংদের নৃগোষ্ঠীগত পরিচয়: নৃতত্ত্ববিদ স্যার রিজলে (Reisley), ড, গ্রিয়ারসন ও হাটন (Haton) বলেছেন, চেহারাগত বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে মুরংদের রক্তধারায় নৃগোষ্ঠীর আংশিক লক্ষণ বিদ্যমান রয়েছে। তবে দৈহিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে দেখলে দেখা যায়, এরা মঙ্গোলয়েড নরগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। এরা প্রাথমিক পরিবেশে থাকতে ভালোবাসে এবং সভ্যসমাজ থেকে আজও অনেক দূরে।
৫. খাসিয়াদের নৃগোষ্ঠীগত পরিচয়: চীনা বার্মিজদের সাথে খাসিয়াদের মিল রয়েছে। এদেরকে আদি মঙ্গোলয়েড গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত করা যায়। চীনা ও বার্মিজদের মতো এদের গায়ের রং ফর্সা, নাক খাদা, চোখ ছোট, পায়ের গোড়ালি মোটা এবং প্রদেহের উচ্চতা মাঝারি ধরনের। এরা সুঠাম দেহের অধিকারী, মুখে দাড়ি নেই বললেই চলে, তবে গোঁফ ঘন ও দেহের লোম স্বল্পতা রয়েছে।।
৬. মণিপুরিদের নৃগোষ্ঠীগত পরিচয়: মণিপুরি সম্প্রদায়ের চীন ও বার্মিজদের ভাষ্যসহ অনেক দিকেই মিল রয়েছে। এদের গায়ের রং শ্যাম-ফর্সা, ছোট চোখ, নাক কিঞ্চিত খাদা, দেহের উচ্চতা মাঝারি ধরনের এবং পায়ের গোড়ালি মোটা। এসব দিক চিন্তা করে তাদের মঙ্গোলীয় গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত করা যায়।
৭. রাখাইনদের নৃগোষ্ঠীগত পরিচয়: রাখাইন উপজাতিদের মঙ্গোলীয় নৃগোষ্ঠীর একটি অংশ বলে আখ্যায়িত করা হয়। এদের মাথার আকার গোল, চুল সোজা ও কালো, নাক চ্যাপ্টা। রাখাইনরা দেখতে বাঙালিদের থেকে আলাদা, এদের দেখলেই তা বুঝা যায়।
৮. ওঁরাওদের নৃগোষ্ঠীগত পরিচয়ধ: কেউ কেউ ওঁরাওদের প্রাক-দ্রাবিড়ীয় বলে উল্লেখ করেছেন। এদের চেহারা কালো, চুল কোঁকড়ানো, নাক খানা ও চ্যাপ্টা, মাথা গোলাকার এবং দেহের উচ্চতা মাঝারি ধরনের। অন্যদিকে, এদেরকে সাঁওতালদের মতো আদি অস্ট্রেলীয় বলেও কেউ কেউ অভিহিত করেছেন। আবার ড. মিয়ারসন ওঁরাওদের মুণ্ডাসের অন্যতম শাখা বলে উল্লেখ করেছেন।
৯. মগ বা মারমাদের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়: স্যার রিজাল মারমাদের দৈহিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলেছেন, তাদের দেহ লোমহীন, চ্যাপ্টা নাক, মাড়িবিহীন মুখ, চোখ ছোট, সোজা চুল, মাথা গোল, ভারী ভ্র, বাদামি রং প্রভৃতি মঙ্গোলীয় মানবধারার বৈশিষ্ট্য তাদের মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে। এককথায়, মারমাদের মধ্যে ৮৪.৫ জন মঙ্গোলীয় আকৃতিবিশিষ্ট।
১০ রাজবংশীদের নৃগোষ্ঠীগত পরিচয়: রাজবংশীদের মধ্যে মঙ্গোলীয় প্রভাব লক্ষ করা গেলেও এদেরকে সহজেই দৈহিকভাবে দ্রাবিড়ীয় সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত করা যায়।
১১. টিপরামের নৃগোষ্ঠীগত পরিচয়: বাংলাদেশের দক্ষিন পূর্বাশয় পাহাড়িয়া অঞ্চলে বসবাসকারী টিপরা উপজাতিরা মঙ্গলীয় মানবগোষ্ঠীর তিব্বতি বর্শন উপগোষ্ঠীর অন্যতম শাখা বোরকা-এর অন্তর্ভুক্ত। তাদের আকৃতিই বলে যে মঙ্গলীয় মানবগোষ্ঠীর রক্তধারা এদের মধ্যে প্রবহমান। ভারতের ত্রিপুরায়ও অসংখ্য টিপরা বসবাস করে।
১২. কুকিদের নৃগোষ্ঠীগত পরিচয়: কুকি সম্পপ্রদায় মঙ্গলীয় থেকে উদ্ধৃত। এদের দেখতে খাটো, মাদা মেটি, গায়ের রং কালো, চোখ ছোট, নাক চওড়া, কপাল উঁচু, ঠোঁটের উপরের অংশ লম্বা এবং মুখে দাঁড়ি নেই বললেই চলে। ড. হাটল-এ মতে, কুকিদের মধ্যে নিগ্রোবটুর লক্ষণ বিদ্যমান। হডসন বলেন, কুকিরা আসামের নাগা ও মণিপুরিদের অন্তর্ভুক্ত।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, উপর্যুক্ত নৃগোষ্ঠী বা নরগোষ্ঠীগত পরিচয় বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসরত উপজাতিদের জন্য প্রযোজ্য। এসব উপজাতিরা পৃথিবীর বিভিন্ন নৃগোষ্ঠী থেকে এসেছে। আবার এদের সাথে বাঙালিদের আকৃতিরও কোনো মিল নেই। এদের ভাষা, সংস্কৃতি তথ্য জীবনযাপন পদ্ধতি সবকিছুই ভিন্ন। বাঙালিদের ন্যায় নৃগোষ্ঠীর সন্ধান লাভ অলীক কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়।

No comments:
Post a Comment