সমাজতাত্ত্বিক তত্ত্ব? পারসন্সের প্যাটার্ন ভেরিয়েবল সংজ্ঞা ও প্রকারভেদ
ভূমিকা:- সমাজবিজ্ঞানে যে সকল প্রত্যয় ব্যবহৃত হয় তার মধ্যে সমাজতাত্ত্বিক তত্ত্ব উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে। এ তত্ত্বের মাধ্যমেই মানুষ সমগ্র সমাজ সম্পর্কে এবং সমাজস্থ বিভিন্ন মানুষ সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারে। এছাড়া সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহ সম্পর্কে এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের সাথে সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করা হয়।এছাড়া ব্যক্তি ও সমাজজীবনের প্রতিটি বিষয়ের ব্যাখ্যা একমাত্র সমাজতাত্ত্বিক তত্ত্বেই পাওয়া সম্ভব।
সমাজতাত্ত্বিক তত্ত্ব
অধ্যাপক জে. জে ম্যাকিউনিস বলেন ''সমাজতাত্ত্বিক তত্ত্ব হলো এমন এক বিকৃতি যার সাথে নির্দিষ্ট কিছু বিষয় (যেমন- কখন ও কিভাবে) সম্পর্কিত।''রবার্ট কে মার্টনের মতে ''সমাজতাত্ত্বিক তত্ত্ব হচ্ছে এমন কতকগুলো অভিজ্ঞতা দ্বারা লব্ধ প্রস্তাবনার সমষ্টি যারা যুক্তির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত।''
কনসাইজ অক্সফোর্ড ডিকশোনারিতে বলা হয় ''সমাজতাত্ত্বিক তত্ত্ব হচ্ছে প্রত্যাহিক উদ্দেশ্যর একটি নির্দেশক অনুমান বা কল্পনা ব্যাখ্যাকারী কোনোকিছু যা ঘটনার নিরপেক্ষতার মূল সূত্র সমূহের উপর প্রতিষ্ঠিত।
পরিশেষে বলা যায় যে, সমাজ সম্পর্কিত কোনো সাধারণ সূত্রই হচ্ছে সমাজতাত্ত্বিক তত্ত্ব। সমাজতাত্ত্বিক তত্ত্ব হলো সমাজের গঠন, কার্যপ্রণালী ও পরিবর্তন সম্পর্কিত নিয়মিত ব্যাখ্যা বা সাধারণ সূত্র যা সমাজবিজ্ঞানীরা উপস্থাপন করেন
পারসন্সের প্যাটার্ন ভেরিয়েবল তত্ত্ব
সমাজ বিশ্লেষণে যে সব ক্রিয়াবাদী তাত্ত্বিক রয়েছেন তাদের মধ্যে ট্যালকট পারসন্স হলেন উল্লেখযোগ্য। তার চিন্তাধারা জটিল ও বিমূর্ততায় আচ্ছন্ন। এ কারণে অনেকে তার গ্রন্থ অধ্যয়ন করে পশুশ্রম নামে আখ্যায়িত করেছেন। ট্যালকট পারসন্স সমাজবিজ্ঞানে যতগুলি তত্ত্ব প্রদান করেছেন তার মধ্যে অন্যতম প্যাটার্ন ভেরিয়েবল তত্ত্ব ।প্যাটার্ন ভেরিয়েবল/ ধরণ চলকসমূহ সংজ্ঞা
সাধারণভাবে বলা যায়, সামাজিক সম্পর্ক বা আচরণের ক্ষেত্রে ব্যক্তির সামনে নির্বাচন করার যে সব সুযোগ বিদ্যমান থাকে সেগুলোই প্যাটার্ন ভেরিয়েবলস।১৯৫১ সালে ট্যালকট পারসন্স এবং ই-মিলস নামক একজন বিজ্ঞানী values Motives and system of social Action নামক গ্রন্থে প্যাটার্ন ভেরিয়েবল এর কথা আলোচনা করেছেন।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা
ট্যালকট পারসন্স এর মতে, প্রত্যেক মানুষের আচরণের একটি বিশেষ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য রয়েছে। এ উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করে এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে অনেকগুলো অপশন থেকে বিকল্প একটি গ্রহণ করে। একজন মানুষের সামনে যেসব অপশন বিকল্প থাকে তাকে Pattern Variable বলে।জি. ই. সোয়ানসন বলেছেন ''কোনো সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে দ্বৈতক অবস্থান বিরাজ করে তাকেই প্যাটার্ন ভেরিয়েবল বলে।
ট্যালকট পারসন্স বলেন -''A pattern variable is a dischotomy one side of which must be chosen by an actor before the meaning of a situation is determinate for him and thus before the can act with respect to that situation. In other words catch pattern variable represent a problem or a dilemma that must solved the actor before action can take place.
ডিভেরেক্স এর মতে, "The Pattern variables are described as representing dilemas paced by individuals actors in attempting to deteine sifuations,"
উন্নয়ন সমাজচিন্তাবিদ হুগভেন্ট এর মতে, "Pattern variables are alternative pattern of value orientation in the role expectations of the actors in a social system."
Timasheff এর মতে, "একজন ব্যক্তির পছন্দের বিকল্পসমূহই হচ্ছে প্যাটার্ন ভেরিয়েবলস।"
প্যাটার্ন ভেরিয়েবলসের/ ধরন চলকসমূহের প্রকারভেদ:
পাঁচ ধরনের প্যাটার্ন ভেরিয়েবলসের কথা উল্লেখ করেছেন। নিম্নে এগুলো উল্লেখ করা হলো-১. স্নেহাশীলতা বনাম স্নেহনিরপেক্ষতা:
পারসন্স সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে মনোভাবের উপাদান নির্ণয়ে এ ভিন্নকদ্বয় ব্যবহার করেন কোনো আন্তঃব্যক্তিকে সম্পর্ক স্নেহজাত নাকি স্নেহনিরপেক্ষ তা ব্যাখ্যা করবে সম্পর্কের ধরনকে। যেমন- শিশু মায়ের মধ্যে যে সম্পর্ক তা স্নেহনিরপেক্ষ নয়। কেননা এ সম্পর্কের মধ্যে এক ধরনের হৃদয়বোধের বিষয় নিহিত থাকে। কিন্তু একজন ডাক্তার ও রোগীর মধ্যে সম্পর্ক তা অনেকাংশে হৃদয়বোধের নয়।
২. নির্দিষ্টতা বনাম সর্বাত্মকতা:
এ সম্পর্কের ক্ষেত্রে অহমের নিয়োজিত হবার মাত্রা নির্দেশ করে তা বিশেষায়িত নাকি সর্বাত্মক। যেমন- বাবা-মায়ের সম্পর্ক সর্বাত্মক। কিন্তু অন্যদিকে ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে যে সম্পর্ক তা সাময়িক, স্থানিক এবং সংক্ষিপ্ত পরিধির মধ্যে সীমাবদ্ধ। তাই এ ধরনের সম্পর্ক নির্দিষ্টতা আপন করে।
৩. বিশ্বজনীনতা বনাম বিশিষ্টতা:
এ ভিন্নকদ্বয় সামাজিক যেকোনো বস্তুর প্রকারভেদের প্রক্রিয়া নির্দেশ করে। কোনো বিষয়কে অহম বিশ্বজনীন কিংবা বিশেষভাবে পরিমাপ করতে পারে। যেমন ইংরেজি ভাষার ব্যবহার বিশ্বজনীনতাকে নির্দেশ করে। কিন্তু বাংলা ভাষা বিশেষ অঞ্চলের ভাষাকে বুঝায়। তাই এটা বিশিষ্টতার পর্যায়ে পড়বে।
৪. গুণ বনাম দক্ষতা:
এই ভিন্নক জোড়া নির্দেশ করে অহম তার সামাজিক লক্ষ্যবস্তুটি কীভাবে প্রত্যক্ষ করছে। অর্থাৎ জন্মগত বা অনার্জিত গুণাবলির দৃষ্টিকোণ থেকে নাকি অর্জিত দক্ষতার সৃষ্টিকোণ থেকে। যেমন- একজন ছাত্রের পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সে একজন ছাত্র এটা মূল্যায়ন করা হবে নাকি 'তার লেখা মূল্যায়ন করা হবে। মোটকথা অহমের আচরণ নির্ধারিত করবে কোন দিকটি অধিক গুরুত্ব পাবে।
৫. ব্যক্তিস্বার্থ বনাম গোষ্ঠীস্বার্থ:
কোনো ব্যক্তি তার নিজস্ব স্বার্থ উদ্ধারের জন্য চেষ্টা করতে পারে আবার কেউ সমষ্টির স্বার্থ উদ্ধারের প্রচেষ্টা চালাতে পারে। যেমন- একজন লেখক বহির্বিশ্বে নিজের কর্ম ও জীবন সম্পর্কে লিখে নিজের উন্নতির শিখরে পৌঁছাতে পারে এবং অন্যদিকে নিজ দেশের প্রকৃতি, বৈশিষ্ট্য, ভালো দিকগুলো লিখে বহির্বিশ্বে নিজের দেশকে এবং দেশের জনগণকে পরিচিত করতে পারে।
সমালোচনা:
পারসন্সের প্যাটার্ন ভেরিয়েবলসের তত্ত্বটি নানাভাবে সমালোচিত হয়েছে। যেমন-১. অনেকের মতে, পারসন্সের এ তত্ত্বটি শুধু ধনতান্ত্রিক সমাজের উদাহরণের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। তাই ধনতান্ত্রিক সমাজের ব্যাখ্যায় তত্ত্বটির গুরুত্ব থাকলেও অন্য কোনো সমাজের ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব নেই।
২. প্যাটার্ন ভেরিয়েবলসের জোড়াগুলোর কমসংখ্যক বিকল্পই কর্তার নিকট সত্য হিসেবে প্রতিফলিত হয় বলে অনেকে মনে করেন। যখন সমাজের বিধিনিষেধের সম্মুখীন হয় তখন সেগুলো স্বাধীনভাবে চয়ন করা যায় না।
৩. যেকোনো বিকল্পের ক্ষেত্রে মধ্যপন্থা বলে একটা কথা থাকে। কর্তা এমন আচরণ সম্পাদন করতে পারে, যা উভয় বিকল্পকেই সন্তুষ্ট করে। কিন্তু পারসন্স তাঁর তত্ত্বে এরূপ সম্ভাবনাকে সম্পূর্ণরূপে বর্জন করেছেন।

খুব সুন্দর উত্তর।
ReplyDelete