শ্রেণি ও জাতিবর্ণের মধ্যে পার্থক্যসমূহ আলোচনা
ভূমিকা:- সামাজিক জীব হিসেবে মানুষ সমাজে বসবাস করে। সমাজে বিভিন্ন শ্রেণি ও সমাজের লোক বসবাস করে। জাতিবর্ণ প্রথা এমন একটি স্তরবিন্যাস যা কোনো সমাজকে বিভিন্ন জাতিতে বিভক্ত করে। শ্রেণি ও জাতিবর্ণের মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান। পুঁজিবাদী সমাজে সমাজ দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত যথা- পুঁজিপতি শ্রেণি ও শ্রমিক শ্রেণি।
জাতিবর্ণ ও শ্রেণির মধ্যে পার্থক্য
নিম্নে জাতিবর্ণ ও শ্রেণির মধ্যে কয়েকটি পার্থক্য আলোচনা করা হল।
১। উন্মুক্ত ও বহু ব্যবস্থা
জাতিবর্ণ হলো একটি বড় ব্যবস্থা অন্যদিকে শ্রেণি হলো উন্মুক্ত ব্যবস্থা । কোনো বিশেষ জাতিবর্ণের সদস্য অন্য কোনো জাতিবর্ণের সদস্যপদ অর্জন করতে পারে না। তার জন্ম ও মৃত্যু একই জাতিবর্ণের মধ্য সীমিত। অন্যদিকে কোনো বিশেষ শ্রেণির সদস্য স্বীয় প্রচেষ্টা বা অন্য কোনো উপায়ে অন্যান্য উঁচু বা নিচু শ্রেণীতে মিল হতে পারে।
২। বিবাহভিত্তিক গোষ্ঠী
জাতিবর্ণ হলো একটি অন্তঃগোত্র বিবাহভিত্তিক গোষ্ঠী। অন্যদিকে শ্রেণি হলো কোনো বিবাহভিত্তিক গোষ্ঠী নয়। জাতিবর্ণের কোনো সদস্যকে নিজ জাতিতেই বিবাহ করতে হয়। অন্যদিকে এক শ্রেণির সদস্য অন্য জাতিতে বিবাহ করতে পারে।
৩। মর্যাদা অর্জনের ক্ষেত্রে
জাতিবর্ণ ও শ্রেণির মধ্যে মর্যাদা অর্জনের ক্ষেত্রে ও ভিন্নতা রয়েছে।জাতিবর্ণের ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তির মর্যাদা জন্মসূত্রে নির্ধারিত বা জাতিবর্ণ কর্তৃক অর্পিত। অন্যদিকে শ্রেণির ক্ষেত্রে ব্যক্তির মর্যাদা তার যোগ্যতার ভিত্তিতে অর্জিত।
৪। পেশাভিত্তিক গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে
জাতিবর্ণগুলো সাধারণত একটি পেশাভিত্তিক গোষ্ঠী। এই পেশা যেন জন্ম কর্তৃক নির্ধারিত। অন্যদিকে শ্রেণিগুলো কোনো পেশাভিত্তিক গোষ্ঠী নয়। শ্রেণির ক্ষেত্রে যে কোনো মানুষ যে কোনো পেশা গ্রহণ করতে পারে।
৫। নিয়মবিধি
জাতিবর্ণের কতকগুলি অপরিবর্তনীয় বা দুরপরিবর্তনীয় নিয়মবিধি বা সামাজিক বিধিনিশেধ থাকে যা জাতিবর্ণের সদস্যদের মেনে চলতে হয়। অন্যদিকে শ্রেণির ক্ষেত্রে এ ধরনের নিয়ম অপরিবর্তনীয়।
৬। দাস ও স্বাধীনতার ক্ষেত্রে
জাতিবর্ণের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে ব্যক্তি যেন সমাজব্যবস্থার অধীন দাস। তার স্বাধীন চিন্তা, স্বাধীনভাবে পেশা গ্রহণ, স্বাধীনভাবে মানুষের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের যেন সুযোগ নেই। অন্যদিকে শ্রেণি ব্যবস্থায় মানুষ অনেকটা স্বাধীন ও মুক্ত।
৭। সামাজিক গতিশীলতা:
জাতিবর্ণ প্রথায় ব্যক্তির সামাজিক অবস্থান জন্মসূত্রে নির্ধারিত এবং আজীবন অপরিবর্তনীয় থাকে। তবে শ্রেণি ব্যবস্থায় একজন ব্যক্তি তার শিক্ষা, আয়, প্রতিভা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে উঁচু শ্রেণিতে উন্নীত হতে পারে, অর্থাৎ শ্রেণি ব্যবস্থা অধিক সামাজিক গতিশীল।
৮। ধর্মীয় ভিত্তি:
জাতিবর্ণ সাধারণত ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচার-আচরণের উপর ভিত্তি করে গঠিত। যেমন: ভারতে হিন্দু ধর্মে জাতি ও বর্ণের ভিত্তিতে বিভাজন প্রচলিত। অপরদিকে শ্রেণি ব্যবস্থা ধর্মনিরপেক্ষ এবং এটি মূলত অর্থনৈতিক ও সামাজিক শক্তির উপর নির্ভরশীল।
৯। সামাজিক সম্পর্ক:
জাতিবর্ণ প্রথায় এক জাতিবর্ণের মানুষ সাধারণত অন্য জাতির সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া, ওঠাবসা বা সামাজিক সম্পর্ক রাখে না বা তা সীমিত থাকে। শ্রেণি ব্যবস্থায় যদিও শ্রেণি পার্থক্য থাকে, তবুও বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ একসাথে বসবাস, কাজ বা সামাজিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে।
১০। বৈষম্যের প্রকৃতি:
জাতিবর্ণ প্রথায় বৈষম্য অধিকতর স্থায়ী ও প্রাতিষ্ঠানিক। এটি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলে। শ্রেণি ব্যবস্থায় বৈষম্য থাকলেও তা তুলনামূলকভাবে পরিবর্তনযোগ্য ও অস্থায়ী। একটি শ্রেণির মানুষ তার অবস্থা পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়।
১১। আইনগত স্বীকৃতি
জাতিবর্ণ প্রথা সাধারণত সামাজিক ও ধর্মীয় রীতিনীতির উপর নির্ভরশীল, আইনের দ্বারা সরাসরি নিয়ন্ত্রিত নয়। অন্যদিকে শ্রেণি ব্যবস্থা অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোর সাথে যুক্ত এবং অনেক ক্ষেত্রে আইন ও রাষ্ট্রীয় নীতির দ্বারা প্রভাবিত।
১২। পরিবর্তনের গতি
জাতিবর্ণ ব্যবস্থায় পরিবর্তন খুব ধীরগতির এবং প্রায় স্থবির। কিন্তু শ্রেণি ব্যবস্থায় সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সাথে দ্রুত রূপান্তর ঘটে।
১৩। আধুনিক সমাজে প্রাসঙ্গিকতা
আধুনিক শিল্পায়িত ও গণতান্ত্রিক সমাজে শ্রেণি ব্যবস্থা অধিক কার্যকর ও বাস্তবসম্মত। বিপরীতে জাতিবর্ণ প্রথা আধুনিক মূল্যবোধের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ বলে বিবেচিত।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, শ্রেণি হলো একটি উন্মুক্ত ব্যবস্থা এবং জাতিবর্ণ হলো একটি বদ্ধ ব্যবস্থা। মানব সমাজের প্রতিটি পর্যায়ে সামাজিক স্তরবিন্যাস বিদ্যমান।সমাজে বিভিন্ন জাতির লোক বসবাস করে থাকে। সমাজে এই দুটি স্তরবিন্যাস প্রথার আলাদা বৈশিষ্ট্য ও প্রভাব রয়েছে।

No comments:
Post a Comment