মধ্যবিত্ত শ্রেণি কী?
ভূমিকাঃ- মানব সমাজ প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। বিভিন্ন ঘটনার দুর্বিপাকে সমাজ পরিবর্তিত হয়। সমাজ পরিবর্তিনের স্বাভাবিক রীতির হাত ধরেই বাঙালি সমাজে মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব হয়। মূলত মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব ঘটেছে নিজ সমাজের মধ্য হতেই। সমাজে বসবাসরত একদম নিচু পর্যায়ের থেকে শুরু করে উচ্চ পর্যায় পর্যন্ত যত লোক বসবাস করত তার মধ্যে যারা মধ্যবর্তী পর্যায়ে অবস্থানরত ছিলো সে সকল বসবাসরত শ্রেণীকে মধ্যবিত্ত বলা হতো। এ মধ্যবিত্ত পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন শিক্ষক, ডাক্তার, সাধারণ চাকুরীজীবি।
প্রামাণ্য সংজ্ঞাঃ নাজমুল করিম মধ্যবিত্ত শ্রেণি বলতে এমন এক শ্রেণিকে বুঝায় যারা সমাজে মধ্যম আয়ের লোক। যারা সমাজে মধ্যম আয়ের পর্যায়ে অবস্থান করে। এই মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত শিক্ষক, শিল্পপতি, বিচারপতি, উকিল, ডাক্তার, চাকরিজীবী সকলে। সাধারণত এরা শিক্ষিত হয়ে থাকে।
আর এইচ গ্রিটন তার English middle class গ্রন্থে বলেন সমাজের সে শ্রেণিকে মধ্যবিত্ত শ্রেণি বলা যায় মুদ্রা যাদের জীবনের প্রধান নিয়ামক ও মুদ্রাই যাদের জীবনের প্রাথমিক উপাদান।
Foundation of Modern sociology তে বলা হয়েছে যে মধ্যবিত্ত শ্রেণি হলো তারাই যাদের উল্লেখযোগ্য কোন কর্ম নেই কিন্তু তারা অন্যান্য কার্য সম্পাদনের মাধ্যমে মুনাফা অর্জনে সক্ষম হয়।
সুতরাং বলা যায় যে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের মধ্যে সেতুবন্ধন রয়েছে। বৃহৎ অর্থে সমাজের রীতিনীতি, সমাজনীতি, শিক্ষানীতি, অর্থনীতি ও সাংস্কৃতিক জীবনে যে শ্রেণি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে তাই হলো মধ্যবিত্ত শ্রেণি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব ট্রেজারি অনুযায়ী বছরে ১০ হাজার থেকে ২৫০০০ টাকা বা তার কাছাকাছি বাৎসরিক আয়ের পরিবারকে মধ্যবিত্ত শ্রেণি বলে। বছরে ৩২০০ থেকে ১০০০০০ ডলার উপার্জনক্ষম পরিবারকে মধ্যবিত্ত শ্রেণিভুক্ত করেছেন।
মধ্যবিত্ত শ্রেণির বৈশিষ্ট্য?
মধ্যবিত্ত শ্রেণির কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হলো
১। গভীর আত্মসম্মানবোধ: মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ সাধারণত আত্মমর্যাদা ও আত্মসম্মানকে খুব গুরুত্ব দেয়। তারা দারিদ্র্য বা অভাবের মধ্যেও নিজের সম্মানের ব্যাপারে আপসহীন থাকে।
২। শিক্ষার প্রতি প্রবল আগ্রহ: এই শ্রেণির মানুষ বিশ্বাস করে শিক্ষা জীবনের উন্নতির মূল চাবিকাঠি। তাই তারা নিজেরা যেমন শিক্ষিত হওয়ার চেষ্টা করে, তেমনি সন্তানদের ভালো শিক্ষা দেওয়ার জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত থাকে।
৩। সন্তান প্রতিপালনে বিশেষ যত্নবান: মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে অত্যন্ত সচেতন। তারা ছোটবেলা থেকেই সন্তানকে নৈতিকতা, সময়ানুবর্তিতা, অধ্যবসায় এবং ভদ্রতায় শিক্ষিত করার চেষ্টা করে। তাদের অনেক সীমাবদ্ধতা থাকলেও সন্তানের জন্য সেরা কিছু দেওয়ার চেষ্টা করে।
৪। নৈতিক প্রতিবন্ধকতা: মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ মেনে চলতে চেষ্টা করে।
৫। প্রগতিশীল চেতনা: মধ্যবিত্ত শ্রেণি নতুন চিন্তা, আধুনিকতা ও সংস্কারের দিকে ঝোঁক রাখে। তারা কুসংস্কার বা গোঁড়ামির চেয়ে বিজ্ঞান, যুক্তি এবং ন্যায়বিচারকে বেশি মূল্য দেয়। তারা নারী শিক্ষা, পরিবেশ সচেতনতা, প্রযুক্তির ব্যবহার ইত্যাদি বিষয়ে ইতিবাচক থাকে।
৬। নাগরিক সচেতনতা: এই শ্রেণির মানুষ সাধারণত নিয়মকানুন মেনে চলতে চায়। তারা কর পরিশোধ, ভোটাধিকার প্রয়োগ, আইন মেনে চলা ইত্যাদি বিষয়ে সচেতন থাকে
৭। অধিক কায়িকশ্রমমুক্ত পেশায় নিয়োজিত: মধ্যবিত্তরা সাধারণত চাকরি বা সেবামূলক পেশায় নিযুক্ত থাকে, যেমন: শিক্ষকতা, চিকিৎসা, প্রশাসন, ইঞ্জিনিয়ারিং, ব্যাংকিং ইত্যাদি। এরা কায়িক শ্রমের সাথে মানসিক শ্রম নির্ভর কাজ বেশি করে।
৮। স্বাধীনতাবোধের চেতনা বিদ্যমান: মধ্যবিত্ত শ্রেণির ব্যক্তি স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও জীবনের সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়ার অধিকারকে মূল্য দেয়। পরিবার বা সমাজের মধ্যে থেকেও তারা নিজস্ব অবস্থান বজায় রাখার চেষ্টা করে।
৯। অদম্য বাণিজ্যিক ও পেশাগত উদ্যোগ: মধ্যবিত্ত শ্রেণির অনেকে ছোট ব্যবসা, ফ্রিল্যান্সিং, অনলাইন উদ্যোগ কিংবা পেশাগত দক্ষতা দিয়ে আত্মনির্ভর হতে চায়। সীমিত সম্পদ নিয়ে বড় কিছু করার ইচ্ছা ও প্রচেষ্টা তাদের মাঝে দেখা যায়।
১০। আর্থসামাজিক পরিবর্তনে মধ্যবিত্ত শ্রেণি মূখ্য ভূমিকা: দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি বা প্রযুক্তির প্রসারে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বড় অবদান রয়েছে। তারা নতুন ধারণা গ্রহণ করে, আন্দোলন গড়ে তোলে এবং সমাজকে এগিয়ে নিতে প্রভাব ফেলে।
পরিশেষে বলা যায় মধ্যবিত্ত শ্রেণি সমাজের উঁচুনিচু তলার মানুষের মধ্যে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করে। মধ্যবিত্ত শ্রেণিই সমাজের রাজনীতি, শিক্ষানীতি,অর্থনীতি ও সাংস্কৃতিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

No comments:
Post a Comment