সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে জাতিসংঘের ভূমিকা আলোচনা কর
ভূমিকা: পৃথিবীর অনেক দেশেই সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর স্বীকৃতি মূলধারার সংখ্যাগরিষ্ঠদের কাছে না থাকায় কাগজে-কলমে তাদের নাগরিকতা থাকলেও কার্যত তার কোনো প্রতিফলন এসব মানুষের জীবনে গাড়ে না। তাই দেশের অভ্যন্তরে অধিকারবঞ্চিত, নিগৃহীত এসব সম্প্রদায়ের জীবনমান পরিবর্তনে যথাযথ আন্তর্জাতকি চাপ না থাকায় দেশীয় কাঠামোগুলো দেশের। সংখ্যাগরিষ্ঠদের স্বার্থ সংরক্ষণেই অধিক প্রণীত হচ্ছিল। এই বিভিন্ন বাস্তবতায় সংখ্যালঘুদের একটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির প্রেক্ষাপট অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছিল। এই সমস্যা নিরসনকল্পেই ১৯৯২ সালের ১৮ ডিসেম্বর সংখ্যালঘু সম্পপ্রদায়কে সামনে যেখে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের আলোচনায় তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার ঘোষণাগুলো উদ্ভুত হয়।
সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় জাতিসংঘের ভূমিকা
সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে জাতিসংঘের ভূমিকা নিম্নে আলোচনা করা হলো-
১. জাতিগত দ্বন্দ্ব নিরসনে সহায়তা: অনেক দেশে সংখ্যালঘুরা সংখ্যাগুরুদের নিপীড়নের শিকার হয়ে নিজেদের স্বশাসন বা স্বাধীনতার দাবি তোলে, ফলে রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা হুমকির মুখে পড়ে। জাতিসংঘ এ ধরনের সংকট নিরসনে সংখ্যালঘুদের স্বীকৃতি দিয়ে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পরিবেশ গড়ে তোলে।
২. সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা ও তৎপরতা বৃদ্ধি: মূলত সংখ্যালঘুদের জীবনমান উন্নয়ন এবং নূন্যতম মানবাধিকার পরিস্থিতি নিশ্চিত করতে সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় জাতিসংঘের ঘোষণা বিভিন্ন দেশের সরকারগুলো সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার রক্ষা ও জীবনমান উন্নয়নের ক্ষেত্রে আরও দায়বদ্ধ হয়। ফলে সংখ্যালঘুদের জন্য আইন প্রণয়ন, সুরক্ষা ও উন্নয়নমূলক কর্মসূচি গ্রহণে রাষ্ট্র বাধ্য হয়
৩. সংখ্যালঘুবিষয়ক সংগঠন ও কার্যক্রমে অর্থায়ন: জাতিসংঘ স্বীকৃতির পূর্ব থেকে অর্থাৎ ১৯৯২ সালের পূর্ব থেকেই অনানুষ্ঠানিক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক স্বেচ্ছাসেবী এবং মানবাধিকার সংগঠন বিভিন্ন দেশীয়, স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃতিবিহীন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিভিন্ন অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং বাস্তবায়নের জন্য বদ্ধপরিকর ছিল। আর এসব কর্মকাণ্ডগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদ এবং এর মাধ্যমে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য আন্তর্জাতিক তহবিল তৈরি ও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে অর্থায়নের সঠিক প্রেক্ষাপট নির্দেশ করার জন্যও জাতিসংঘ সনদ আসা দরকার ছিল।
৪. সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানবাধিকার নিশ্চিত করা: সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর স্বীকৃতি মূলধারায় সংখ্যাগরিষ্ঠদের কাছে না থাকায় কাগজে-কলমে তাদের নাগরিকত থাকলেও কার্যত তার কোনো প্রতিফলন এসব মানুষের জীবনে থাকে না। ফলে সংখ্যালঘুরা প্রায়শই চূড়ান্ত মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। জাতিসংঘ তাদের মৌলিক অধিকার, নিরাপত্তা ও মর্যাদা রক্ষায় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মাধ্যমে সহায়তা প্রদান করে।
৫. সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ: ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক সমাজের সংস্কৃতি সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করে জাতিসংঘ। এসব সংস্কৃতিগুলো যদি অতিরিক্ত গুরুত্ব না দিয়ে সংরক্ষণ করা না হয় তাহলে অনেক সংস্কৃতি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। জাতিসংঘ এসব প্রাচীন সংস্কৃতি রক্ষা ও সংরক্ষণে বিশেষ গুরুত্ব দেয়, যাতে বৈচিত্র্যময় মানবসভ্যতা টিকে থাকে।।
৬.গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতকরণ: দেশের অভ্যন্তরে সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর কোনো প্রকার প্রতিনিধিত্ব সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করে দেশের জাতির প্রেক্ষাপটে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা সঠিক ও বাস্তবায়ন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের সংস্কৃতির বিকাশ ও প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিটি দেশের প্রতিটি তৃণমূল পর্যায় হতে প্রতিটি মানুষের রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা খুবই দরকার ছিল। তাই প্রতিটি দেশের বাস্তবতায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করতে হলে প্রথমে সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা দরকার ছিল।
৭. সমগ্র পৃথিবীতে অসমতার সার্বিক উন্নতি সাধন: মূলত মানবাধিকার ব্যক্তির কাজের মূল্যায়ন, সুবিচার পাওয়ার অধিকার ইত্যাদি বিষয়গুলো কোনোভাবেই বাক্তির গোত্র, বর্ণ, ধর্ম, শ্রেণি, জীবনযাপন ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের বৈশিষ্ট্য দ্বারা নির্ধারিত হতে পারে না। এসব বৈশিষ্ট্য যদি নির্ধারক শক্তি হয়ে যায় তাহলে সমাজ কোনোভাবে সুষম থাকবে না। অসমতার সমাজে পরিণত হবে। অসম সমাজে কোনো মানুষের স্বাভাবিক জীবনের সঠিক বিকাশ ঘটা সম্ভব নয়। সমাজকে অসমতা মুক্ত করা না হলে মানুষের জীবনের ঝুঁকি কমবে না, তাই অসমতা মুক্তির প্রাথমিক বক্তব্য দিয়ে জাতিসংঘের সনদ প্রণীত হয়।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় জাতিসংঘ কেবল নীতিগত দিকনির্দেশনা প্রদান করেই থেমে থাকে না, বরং বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এর বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। জাতিসংঘের মূলনীতি ও সনদগুলো সংখ্যালঘুদের জীবনে ন্যূনতম মানবিক অধিকার নিশ্চিতকরণের এক বলিষ্ঠ আন্তর্জাতিক উদ্যোগ। এসব নীতিকে শুধু তাত্ত্বিকভাবে না দেখে কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমেই সংখ্যালঘুদের মর্যাদাপূর্ণ জীবন নিশ্চিত করা সম্ভব

No comments:
Post a Comment