শিল্প বিপ্লব কি? সমাজবিজ্ঞান উদ্ভব ও বিকাশে শিল্প বিপ্লব ও ফরাসি বিপ্লবের ভূমিকা

শিল্প বিপ্লব কি? সমাজবিজ্ঞান উদ্ভব ও বিকাশে শিল্প বিপ্লব ও ফরাসি বিপ্লবের ভূমিকা

ভূমিকাঃ মানুষের জীবন, চিন্তা-চেতনা, আচরণ পরিবর্তনশীল। সমাজব্যবস্থায় সর্বদা নতুনের উদ্ভব ঘটে এবং সে স্থানে পুরাতনকে জলাঞ্জলী দেওয়া হয়। ১৭৮০ থেকে ১৮৫০ সালের মধ্যবর্তী সময়ে একটি সূদুর প্রসারী ও দীর্ঘ সময়ব্যাপী সামাজিক বিপ্লব বিশ্বের অর্থনীতি, রাজনীতি ও চিন্তাধারার যে আমূল পরিবর্তন বয়ে আনে তাকেই শিল্প বিপ্লব বলে।

শিল্প বিপ্লব কি? সমাজবিজ্ঞানের উদ্ভব ও বিকাশে শিল্প বিপ্লব ও ফরাসি বিপ্লবের ভূমিকা


শিল্পবিপ্লব প্রত্যয়টি দ্বারা সুদুরপ্রসারী পর্বির্তনকে বোঝানো হয়েছে। যার মাধ্যমে একটা কৃষি নির্ভর সমাজ উন্নত হয়ে একটা শিল্প ভিত্তিক অর্থনীতিতে উত্তরণ ঘটে। ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে ইংল্যাণ্ডে শিল্প বিপ্লবের মধ্য দিয়েই সর্বপ্রথম শিল্প সমাজ গড়ে উঠে।
শিল্প বিপ্লবঃ ফরাসি সমাজতান্ত্রিক লেখক অগাষ্ট ব্লাস্কি সর্বপ্রথম শিল্পবিপ্লব কথাটি ব্যবহার করেন। শিল্পবিপ্লব বলতে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উৎপাদন ব্যবস্থায় পুরাতন পদ্ধতির আমূল পরিবর্তন সাধন করে যান্ত্রিক পদ্ধতির প্রবর্তনকে শিল্পবিপ্লব বলা হয়। এক কথায় শিল্পের উৎপাদন ব্যবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তনই শিল্পবিপ্লব।
শিল্পবিপ্লবের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে প্রফেসর লেন্ডি উইলিয়াম বলেন “অষ্টাদশ শতাব্দির শেষাংশ হতে উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমাংশ পযন্ত ইংল্যান্ডের বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি প্রয়োগের ফলে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় তাই শিল্পবিপ্লব।”
ইংরেজ ঐতিহাসিকদের মধ্যে আরনল্ড টয়েনবি তার lecture on the industrial Revolotion in England গ্রন্থে বলেন “ঐ সময় বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও তার উপযুক্ত প্রয়োগের আকস্মিক পরিবর্তনকে শিল্পবিপ্লব বলে।”
উপযুক্ত তথ্যের আলেকে বলা যায় যে- সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উৎপাদন ব্যবস্থায় পুরাতন পদ্ধতির আমূল পরিবর্তন সাধন করে যান্ত্রিক পদ্ধতির প্রবর্তনকে শিল্পবিপ্লব বলা হয়।
শিল্পবিপ্লব ও ফরাসি বিপ্লব ইউরোপসহ সমগ্র বিশ্বে সমাজচিন্তার সকল ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করে। বিপ্লবী চিন্তাচেতনা মানুষের জ্ঞানের জগৎকে আরও প্রভাবিত করে। এরই ফল ফলপ্রসুতিতে সমাজবিজ্ঞানের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে। 
ফরাসি বিপ্লবঃ প্রতিটি বিপ্লব পুরো সমাজকাঠামোকে পরিবর্তন করতে সক্ষম।শিল্পবিপ্লবের ন্যায় ফরাসি বিপ্লব সমাজকাঠামো, সমাজচিন্তার ক্ষেত্রে বিভিন্ন পরিবর্তন সাধন করে। ফরাসি বিপ্লব সামাজিক চিন্তার ক্ষেত্রে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। ফ্রান্সে বিদ্যমান আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার লক্ষ্যেবিপ্লব ঘটানো হয়েছিল। স্বৈরাচারী রাজার বৈষম্যমূলক শাসনব্যবস্থা জনজীবনকে অতীষ্ঠ করে তুলেছিল । সমাজের যাজক ও অভিজাত শ্রেণী যাবতীয় সুযোগ সুবিধা পারন করত। সাধারণ মানুষ চরম দুরদর্শার মধ্যে জীবনযাপন করত ।দীর্ঘদিনের অনিয়ম,বিশৃঙ্খলা, দুর্নীতি থেকে মুক্তি পাওয়ার লক্ষে  ১৭৮৯ সালে বিপ্লব ঘটায়।
মূলত তৎকালীন ফ্রান্সের দার্শনিকগণদের লেখনীর মাধ্যমের মধ্য দিয়েই ফরাসি বিপ্লবের সূত্র শুরু হয় যা ফরাসি বিপ্লবকে এগিয়ে নিয়ে যায়।তাদের মধ্য মন্স্কেু, রুশো,ভলটেয়ার এর নাম উল্লেখযোগ্য । পরবর্তীতে সমাজবিজ্ঞানের উদ্ভব ও বিকাশের ক্ষেত্রে যার অবদান সর্বাধিক তিনি হলেন ফ্রান্সের দার্শনিক অগাস্ট কোঁৎ । তিনি চুড়ান্তভাবে `Sociology’ শব্দ ব্যবহারের মধ্য দিয়ে ‘সমাজবিজ্ঞান’ নামক জ্ঞানের নতুন শাখার উদ্ভব ঘটান ।
উপযুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, মানুষের জীবন, আচরণ, চিন্তাচেতনা পরিবর্তনশীল। আর এ পরিবর্তনশীলতা সমাজব্যবস্থায় নতুনের উদ্ভব ঘটায়। নতুনের উদ্ভব ঘটলে পুরাতন জলাঞ্জলি ঘটে আর এভাবেই নতুন সমাজব্যবস্থার বর্ণণা প্রদানেই সমাজের উদ্ভব ও বিকাশ সাধন ঘটে।

 সমাজবিজ্ঞান বিকাশে শিল্প বিপ্লবের ভূমিকাঃ আধুনিক জীবন-যাপন, বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা, পুজিঁবাদী সমাজ, উন্নত চিন্তাচেতনা প্রভৃতি বিষ শিল্পবিপ্লবের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ফলাফল। এসব বিষয় পূ্র্বে ছিলো অনুপস্থিত। শিল্পবিপ্লব সমাজ জীবন ও সামাজিক চিন্তাচেতনার ক্ষেত্রে পরিবর্তন সাধন করে।অর্থাৎ নতুন শিল্পায়িত সমাজ মানুষকে নতুন ধ্যনধারণা ও চিন্তাচেতনার সাথে পরিচয় করিয়ে দেই। মূলত অভাব ও চাহিদার বিপুল বিকাশ মানুষকে নিয়ত সম্মুখ পানে চালিত করেছে। শিল্পবিপ্লবের মধ্যদিয়ে মধ্যদিয়ে মানুষ চূড়ান্তভাবে শিল্প সমাজে পর্যবসিত হয়। ১৯৭০ সালে জন কে এর উড়ন্ত মাকু আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে শিল্পবিপ্লবের অগ্রযাত্রা শুরু হয়। ১৭৮২ সালে জেমস ওয়াটের বাষ্পচালিত আবিষ্কার এ বিপ্লবকে আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যায়। ১৮ শতাব্দী হতে ১৯ শতাব্দীর প্রথম দিকে শিল্পবিপ্লবের ফলশ্রুতিতে সমগ্র পৃথিবীতে পরিবর্তনের স্রোত বয়ে যায়। এ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ছোট ছোট শিল্প কারখানা বৃহৎ ও বড় কারখানায় রুপ নেই।

সুতরাং এটা সহজেই অনুমেয় হয় যে শিল্পবিপ্লবের চিন্তাচেতনা জ্ঞানের নতুন শাখা হিসেবে সমাজবিজ্ঞানের উদ্ভব ও বিকাশে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। শিল্পবিপ্লবকে তরান্বিত করার জন্য বিভিন্ন অর্থলগ্নীকারী প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, ধনী ব্যবসায়ীরা এগিয়ে আসে।এ বিপ্লব অর্থনৈতিক কাঠামোকে সমৃদ্ধি করে। ইউরোপের দেশগুলির মধ্য ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবের মধ্য দিয়ে সর্বপ্রথম শিল্প সমাজ গড়ে উঠে। যন্ত্রপাতির উন্নয়ণ, সামরিক শক্তি বৃদ্ধি প্রভৃতির মধ্য দিয়ে শিল্পবিপ্লব এগিয়ে যায়। শিল্পবিপ্লবের ফলশ্রুতি হিসাবে সমাজচিন্তায় পরিবর্তন আসে যা জ্ঞানের পৃথক শাখা হিসেবে সমাজবিজ্ঞানের উদ্ভব ঘটাতে এগিয়ে আসে।

Comments

Popular posts from this blog

জনসংখ্যা সমস্যা কি? উন্নয়ণশীল দেশগুলিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণসমুহ লিখ?

রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত মতবাদ অলোচনা কর?