জনসংখ্যা সমস্যা কি? উন্নয়ণশীল দেশগুলিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণসমুহ লিখ?

জনসংখ্যা সমস্যা কি? উন্নয়ণশীল দেশগুলিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণসমুহ লিখ?
অথবা, উন্নয়ণশীল দেশ হিসাবে বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণসমুহ লিখ?

ভূমিকাঃ বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যা একটি প্রধান সমস্যা। বিশ্বের সকল দেশেই এ জনসংখ্যা সমস্যা নিয়ে কম বেশি উদ্বিগ্ন। বিশ্বের জনসংখ্যা যেভাবে দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে  তাতে এ অতিরিক্ত জনসংখ্যা সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সহ সকল ক্ষেত্রে গুরুতর সমস্যার সৃষ্টি করছে। যেকোন দেশের জন্য জনসংখ্যা সমস্যা হুমকি স্বরুপ। অতিরিক্ত জনসংখ্যা দেশের কাঠামোকে দুর্বল করে, বেকারত্ব বৃদ্ধি করে ও দেশের উন্নয়নে ব্যাঘাত ঘটায়। জনসংখ্যা সমস্যা প্রতিটি দেশের জন্য হুমকি।
জনসংখ্যা সমস্যা কি? উন্নয়ণশীল দেশগুলিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণসমুহ লিখ?


সাধারণ সংজ্ঞাঃ কোন দেশের খাদ্য উৎপাদন এবং লোকসংখ্যার মধ্যে যদি তুলনামূলক অসমতা দেখা দেয় তখন তাকে জনসংখ্যা সমস্যা  বলে। এতএব, জনসংখ্যা সমস্যা বলতে কোন দেশের খাদ্য উৎপাদন ও লোকসংখ্যার মধ্যে যখন তুলনামূলক অসামঞ্জস্য দেখা যায় তখন সেই অবস্থাকে জনসয়খ্যা সমস্যা বলা হয়।
প্রামাণ্য সংজ্ঞাঃ ম্যালথাসের মতে " জনসংখ্যা বাড়ে জ্যামিতিক হারে আর খাদ্য উৎপাদন বাড়ে গাণিতি হারে।"
সাবেক বিশ্ব ব্যাংকের প্রসিডেন্ট মি ম্যাকনামারা জনসংখ্যা স্ফীতি সম্পর্কে বলেন- "পারমাণবিক যুদ্ধ ছাড়া বিশ্ববাসীর মুখে অন্যতম যে সমস্যা তা হলো জনসংখ্যাস্ফীতি "

উন্নয়ণশীল দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণসমুহ লিখ?
অথবা, উন্নয়ণশীল দেশ হিসাবে বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণসমুহ লিখ?

জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণঃ বর্তমান বিশ্বে জনসংখ্যা যেন এক অভিশাপ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে উন্নয়নশীল দেশে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পারিবারিক সমস্যা থেকে শুরু করে বেকারত্ব, দারিদ্র‌্যতা বেড়েই চলেছে। অতিরিক্ত জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে বিশাল জনগোষ্ঠীর খাদ্য সংকট দেখা দিচ্ছে । নিস্নে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কয়েকটি কারণ তুলে ধরা হলোঃ
১। খাদ্য উৎপাদনঃ বিশ্বের খাদ্য উৎপাদন আগপর তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। যেমন ১৯৫০ সালে খাদ্য উৎপাদন ছিলো ৬৩১ মিলিয়ন টন ১৯৮৪ সালে বেড়ে তা দাড়ায় ১.৬৫ বিলিয়ন। আর অধিক উৎপাদন করার জন্য আধুনিক প্রযুক্তি ও ব্যবহার করা হচ্ছে । সাথে এ উৎপাদন বাড়ার পাশাপাশি জনসংখ্যা ও কর্মের জন্য এক স্থান হতে অন্যত্র গিয়ে বসবাস করছে এভাবে জনসংখ্যা ও বাড়ছে।
২। পরিবেশঃ পরিবেশের অবস্থার উপর জনসংখ্যা বৃদ্ধি নির্ভর করে বিশ্বের নিরক্ষীয়  অঞ্চলসমুহ উচ্চ  তাপমাত্রা বিরাজ করায় মানুষ দ্রুত প্রজনন ক্ষমতা লাভ করে। ফলে সে অঞ্চলে অল্প বয়সে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় ফলে সন্তান জম্ম ও লালন পালনে সময় বেশি পাওয়ায় সন্তান জম্মদান বেশি করে। এভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়। যা পরবর্তীতে জনসংখ্যা সমস্যায় রুপ নেয়।
৩। বহুবিবাহঃ উন্নয়নশীল দেশের সমাজগুলিতে এখনও বহু বিবাহ লক্ষ্য করা যায় এই বহুবিবাহের কারণে একেক জন পুরুষ দুইটা তিনটা বিয়ে করে।যার ফলে তারা অধিক সন্তান জম্মদান করেন এ কারণে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় ও জনসংখ্যা সমস্যা দেখা দেয়। 
৪। বাল্যবিবাহঃ বাল্যবিবাহ উন্নয়নশীল দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হিসাবে ধরা হয়। উন্নয়নশীল দেশে গ্রামীণ সমাজে সচেতনতার অভাবে তারা তাদের মেয়েদের বাল্য বয়সেই বিবাহ দেই। যার ফলে তাদের প্রজনন ক্ষমতা দীর্ঘ সময় থাকে তাই তারা এই দীর্ঘ সময়ের মধ্য অধিক সন্তানের জম্ম দেই যা জনসংখ্যা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। 
৫। পুত্র সন্তান লাভের কামনাঃ উন্নয়নশীল দেশের অনেক মানুষ এখনও নিরক্ষর। তাই তারা  মনে করে বৃদ্ধ বয়সে কন্যা সন্তান তাদের খেয়াল রাখতে পারবে না এজন্য কন্যা সন্তান হওয়ায় পুত্র সন্তানের আশায় দিনের পর দিন সন্তানের জম্ম দেয় এবং এভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়। 
৬। সচেতনতার অভাবঃ উন্নয়নশীল দেশের অনেক মানুষ আছে এখনও তারা অসচেতন। তারা জনসংখ্যা বৃদ্ধির সামাজিক কুফল সম্পর্কে অবগত নয়৷ তারা মনে করেন সন্তান বেশি হলে পরিবার বড় হলে শক্তি বাড়বে। বৃদ্ধ বয়সে সন্তানেরা ছায়া হয়ে পাশে থাকবে এই ভেবে তারা অধিক সন্তান গ্রহণ করেন যার ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়। 
৭। দারিদ্র্যতাঃ উন্নয়নশীল দেশের অধিকাংশ মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করে তাই তারা তারা মনে করে যে অধিক সন্তান জম্ম দিলে বড় হয়ে কর্ম করলে দারিদ্র‌্যতা দূর হবে এ প্রত্যাশায় পুত্র সন্তানের আশায় দিনের পর দিন সন্তান জম্ম দেই যাতে তারা বড় হয়ে কর্ম করে দারিদ্র্যতা দুর করতে সহায়ক হয়। অপরদিকে, দারিদ্র্য হওয়ায় বিনোদন হিসাবে যৌনতাকে বেশি প্রাধান্য দেই ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়। 
৮। নারী শিক্ষা অভাবঃ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে নারীরা শিক্ষাক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে। যা জনসংখ্যা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। তারা জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে কি কি সমস্যা ঘটে সে বিষয়ে বুঝে না ফলে তারা ও সন্তান জম্ম দিতেই থাকে। যা জনসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি জনসংখ্যা সমস্যায় পরিণত হয়। অনেকাংশে লক্ষ্য করা যায় যে দেশে নারী শিক্ষার হার বেশি সে সকল দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কম। কারণ তারা কর্মে ব্যস্থ থাকার কারণে অধিক সময় বাইরে থাকে এবং নিজেদের জীবন সম্পর্কে সচেতন যার কারণে কম সন্তান গ্রহণ করে থাকে। আর এই নারী শিক্ষার অভাবের ফলে তারা অধিক সন্তান গ্রহণ করায় জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়।
৯। নারী কর্মসংস্থান অভাবঃ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এখনও নারীদের প্রতি অবিচার করা হচ্ছে তাদের যথাযথ শিক্ষা ব্যবস্থা করা হচ্ছে না অপরদিকে তারা বিভিন্ন সামাজিক ও পারিবারিক কারণেও কোন কর্মক্ষেত্রে যোগদান করতে পারে না। তাদের কাজ হলো ঘরে বসে ঘরের কাজ করা আর বাচ্চা উৎপাদন ও পরিবার সামালানো এতে তারাও তাদের সময় কাটানোর জন্য অধিক সন্তান গ্রহণ করে যেন সন্তানের সাথে সময় কাটাতে পারে। আর এভাবে জনসংখ্যা বেড়েই চলেছে।
১০। চিত্রবিনোদনের অভাবঃ উন্নয়নশীল দেশে গ্রামীণ সমাজে মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করায় তারা তেমন বিনোদন করার সুযোগ পাইনা যেটুকু সময় পায় স্ত্রী সন্তানের সাথে কাটায় বিশেষ করে স্ত্রীরা বাসায় একা থাকে তাই বিনোদনের জন্য সন্তান নিয়ে তাদের লালন পালন করার মধ্য দিয়ে সময় পার করে এছাড়া দারিদ্র‌্যতার কারণে স্বামীরা অধিক সময় পার করে বাসায় ফলে স্বামী- স্ত্রীর এ অধিক সময় পার করার কারণেও জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়।
১১। জম্ম নিয়ন্ত্রণে অনিহাঃ জনসংখ্যা বৃদ্ধির অন্যতম আর একটি সমস্যা হলো জম্ম নিয়ন্ত্রণে অনিহা প্রকাশ। কারণ গ্রামের অধিকাংশ নারীরা অশিক্ষিত যার কারণে তারা এ বিষয়ে তেমন কিছু জানেনা এছাড়া বিভিন্ন কুসংস্কার ও ভূল ধারনার কারনেও জম্ম নিয়ন্ত্রণে অসচেতন ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে
১২। মৃত্যুহার হ্রাসঃ উন্নত চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কার হওয়ার ফলে মৃত্যুর হার কমে গেছে ফলে মৃত্যুহার যতটা হ্রাস পেয়েছে সে তুলনায় জম্মহার বৃদ্ধি ততটা হ্রাস পাই নাই ফলে জনসংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি বেড়েই চলেছে। যা উন্নয়নশীল দেশগুলিতে জনসংখ্যা সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছে।
১৩। সামাজিক নিরাপত্তার অভাবঃ বেশিভাগ উন্নয়নশীল দেশে লক্ষ্য করা যায় যে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি এখনও সৃষ্টি হয়নি যার কারণে দেশের দারিদ্র‌্য শ্রেণির মানুষ সামাজিক নিরাপত্তা হিসেবে ও বদ্ধা বয়সের ঠাই হিসেবে অধিক সন্দান জম্ম দিয়ে থাকেন যাতে করে যখন তারা অক্ষম হয়ে যাবেন তখন একটা নিরাপদ স্থান পান।
উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে, জনসংখ্যা বৃদ্ধি জনসংখ্যা সমস্যা শুধু পরিবার বা সমাজের উপর প্রভাব ফেলে না বরং এটা দেশের অর্থনীতিতে মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। সুতরাং এ সমস্যা সমাধান করার চেষ্টা না করলে খুব শিঘ্রই জনসংখ্যা সমস্যা হতে জনসংখ্যা বিস্ফোরণ ঘটনা ঘটবে। তাই এ জনসংখ্যা সমস্যা সমাধান করতে পরিবার ও দেশকে সচেতন হতে হবে, না হলে এক সময়ে এ জনসংখ্যাই দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাড়াবে।


Comments

Popular posts from this blog

রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত মতবাদ অলোচনা কর?

শিল্প বিপ্লব কি? সমাজবিজ্ঞান উদ্ভব ও বিকাশে শিল্প বিপ্লব ও ফরাসি বিপ্লবের ভূমিকা