আন্তর্জাতিক আইন কী? আন্তর্জাতিক আইনের পরিধি আলোচনা কর।

আন্তর্জাতিক আইন কী?

বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় কোন রাষ্ট্রই সয়ংসম্পূর্ণ নয়। বিবিধ কারণে এক রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করছে। এ ধরনের যোগাযোগ বৈধ প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হয়ে থাকে। একটি রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের সাথে যোগাযোগের উদ্দেশ্য হলো আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শান্তি ও সমৃদ্ধি রক্ষা। বর্তমান বিশ্ববলয়ে আন্তর্জাতিক আইনের গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে।

আন্তর্জাতিক আইনঃ আন্তর্জাতিক আইন বিশ্বের সকল দেশ বা রাষ্ট্র এর মধ্য সম্পর্ক নির্ণয় ও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সংগঠন এ আইনের বিষয়বস্তু। আন্তর্জাতিক আইন হলো আন্তর্জাতিক বিধিবিধানের সমষ্টি। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় যেসব নিয়ম-কানুন সভ্য রাষ্ট্রসমূহের পারস্পরিক সম্পর্ক ও আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে তাকে আন্তর্জাতিক আইন বলে।
প্রামাণ্য সংজ্ঞাঃ বিভিন্ন আইনজ্ঞ ও চিন্তাবিদ বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন।
ফেনউইক (Fenwik) এর মতে আন্তর্জাতিক আইন হলো সেসব সাধারণ নীতি ও নির্দিষ্ট নিয়মের সমষ্টি যা আন্তর্জাতিক সমাজের সদস্যগণ তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণের ক্ষেত্র মেনে চলে।
গ্রোটিয়াস (Grotious) এর মতে “আন্তর্জাতিক আইন সেসব প্রথা ও সঠিক শর্তাবলি নির্দেশ করে যেগুলো রাষ্ট্রসমূহের পারস্পরিক ব্যবস্থায় আইনত কার্যকরী বলে বিবেচিত হয়।
S. J. Lawronce এর মতে-“রাষ্ট্রসমূহের পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যেসব স্বীকৃত আন্তর্জাতিক নিয়মাবলি প্রচলিত তাই আন্তর্জাতিক আইন হিসেবে পরিণত হয়।”
Briarly এর মতে-“যেসব নিয়ম ও মূলনীতি সভ্য রাষ্ট্রসমূহের পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক মেনে চলা হয়, তাই হলো আন্তর্জাতিক আইন।”

আন্তর্জাতিক আইনের প্রকৃতি বা পরিধি আলোচনা কর?

আন্তর্জাতিক আইনের প্রকৃতিঃ আন্তর্জাতিক আইন হলো আন্তর্জাতিক বিধিবিধানের সমষ্টি। এ আইনের প্রকৃত বিশ্লেষণ করা যেতে পারে।আন্তর্জাতিক আইনের লক্ষ্য হলো আন্তর্জাতিক শান্তি ও শৃংখলা রক্ষা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা। নিম্নে আন্তর্জাতিক আইনের প্রকৃতি বর্ণণা করা হলো-
স্পক্ষে যুক্তিঃ আন্তর্জাতিক আইনের প্রকৃতি বিশ্লেষণে দেখা যায় কোনো কোনো দার্শনিক এক আইন বলে অখ্যায়িত করেছেন। তারা আন্তর্জাতিক আইনকে প্রকৃত আইন বলে আখ্যায়িত করেছেন।
১। প্রথাভিত্তিকঃ আন্তর্জাতিক আইনকে আইন বলার যুক্তি এটা প্রথম প্রথাভিত্তিক।ওপেনহেম সহ অনেক আইনবিদদের অভিমত হলো আন্তর্জাতিক আইন প্রথা ও রীতিনীতির ভিত্তিতে রচিত। এ আইন সাধারণ আইনের মতো প্রথাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। তাদের মতে সর্বভৌম আদেশই আইন হতে পারে না। প্রচলিত প্রথা ও রীতিনীতির ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক আইনের সৃষ্টি হয়।
২। বিশ্বসংস্থার স্বীকৃতিঃ বিশ্বসংস্থায় স্বীকৃতির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আইন গড়ে উঠে। এ মতবাদের সমর্থকদের মতে সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের সমর্থনের অভাবে এ আইনকে আইনের মর্যাদা প্রদান না করা অযোক্তিক। সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের আদেশ না থাকলেও এর পেছনে বিশ্বসংস্থার অনুমোদন রয়েছে। বিশ্বসংস্থাসমূহ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিশ্ব বলয়ের রাষ্ট্রসমূহ ‍ নিয়ে।
৩। শ্রদ্ধাবোধঃ আন্তর্জাতিক আইন এর প্রতি বিশ্ব রাষ্ট্রসমূহের শ্রদ্ধা ও আনুগত্য রয়েছে। বর্তমান বিশ্বের কোন রাষ্ট্রই প্রকাশ্য আন্তর্জাতিক বলায়ে সংঘর্ষের কথা স্বীকার করে না। তারা আন্তর্জাতিক বিধিবিধানের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে থাকে।
৪। পরিবর্তনশীলতাঃ পরিবর্তনশীলতা আন্তর্জাতিক আইনকে সাধারণ আইন হিসেবে চিহৃিত করে। সাধারণ আইন পরিবর্তনশীল। পরিবর্তিত অবস্থার সাথে সঙ্গতি রেখে আইনের পরিবর্তন করা হয়।সমর্থকদের মতে জাতীয় আইনের মতো আন্তর্জাতিক আইনও বিবর্তনের ধারায় পরিবরতনশীল।
৫। রাষ্ট্রসমূহের সম্পর্ক নির্ধারণঃ আন্তর্জাতিক আইনের মাধ্যমে রাষ্ট্র সমূহের মধ্য যোগাযোগ রক্ষা করা হয়। সাধারণ আইনের দ্বারা ব্যক্তিবর্গের সম্পর্ক নির্ধারণ করা হয়। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রসমূহের পারস্পরিক সম্পর্ক রক্ষা ও নিয়ন্ত্রণ এর জন্য আন্তর্জাতিক আইনের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।
৬। বলবৎযোগ্যঃ আন্তর্জাতিক আইন বলবৎযোগ্য। এ আইন প্রয়োগযোগ্য বিধায় এটি সাধারণ আইনের মর্যাদায় অভিষিক্ত। এ আইনের বিরোধী মন্তব্য হলো এটি বলবৎযোগ্য নয়।
৭। বিশ্ব জনমতের প্রতিফলনঃ আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি বিশ্ব জনমতের সম্মতি রয়েছে।সাধারণত মনে হয় শাস্তির ভয়ে এ আইন মান্য করা হয় না।মান্য করা হয় জনমতের ভয়ে। সাধারণ আইন মান্য করার একটি কারণ হলো জনমতের সম্মতি।
৮। বিপক্ষে মুক্তিঃ কোনো কোনো আইন বিশরদ আন্তর্জাতিক আইনকে সাদারণ আইন বলতে নারাজ। এ মতবাদের পক্ষে সমর্থন যুগিয়েছেন Austin ও Holland। তারা আন্তর্জাতিক আইনের বিপক্ষে কতিপয় যুক্তি দিয়েছেন।
৯। সার্বভৌম আদেশ নয়ঃ আন্তর্জাতিক আইন সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের আদেশ নয়। এটি আন্তর্জাতিক আইনকে সাধারণ আইন না বলার প্রথম যুক্তি। তাদের মতে সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের আদেশই আইন। কিন্তু আন্তর্জাতিক আইনের পিছনে সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের কোনো সমর্থন নেই।
১০। বাধ্যবাধকতাহীনঃ Austin ও Holland সহ অনেকে মনে করেন যে, আন্তর্জাতিক আইনের কোন বাধ্যবাধকতা নেই। আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলতে কোন রাষ্ট্র বাধ্য নয়।
১১। অনির্দিষ্টতাঃ অনির্দিষ্টতা এ আইনের একটি অন্যতম দূর্বলতা। আন্তর্জাতিক আইনে কোন নির্দিষ্টতা নেই। অবস্থা ও স্বার্থ বিচারে এ আইন প্রয়োগযোগ্য। এ আইনকে কেউ কেই সৌজন্যমূলক আইন বলে আখ্যায়িত করেছেন।
পরিশেষে বলা যায় যে, আন্তর্জাতিক আইনের পারস্পরিক বিরোধিতার মূল কারণ হলো দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য। বর্তমান পেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক আইন সাধারণ আইনের মর্যাদাভূক্ত। কেননা এ আইনের অনুকুলে ব্যাপক ও বলিষ্ঠ বিশ্ব জনমত গড়ে উঠেছে। তাছাড়া আন্তর্জাতিক আইনের পিছনে সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের আদেশ না থাকলেও বিশ্বসংস্থা জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে এ আইন পরিচালিত। আন্তর্জাতিক আইনকে আইন বলা যুক্তিযুক্ত।

Comments

Popular posts from this blog

জনসংখ্যা সমস্যা কি? উন্নয়ণশীল দেশগুলিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণসমুহ লিখ?

রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত মতবাদ অলোচনা কর?

শিল্প বিপ্লব কি? সমাজবিজ্ঞান উদ্ভব ও বিকাশে শিল্প বিপ্লব ও ফরাসি বিপ্লবের ভূমিকা