রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত ইবনে খালদুনের মতবাদ আলোচনা

 রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত ইবনে খালদুনের মতবাদ আলোচনা

পৃথিবীর সর্ববৃহৎ সংঘ হলো রাষ্ট্র এবং সর্বোচ্চ মানবতার প্রতীক। তবে এই রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়েছে কিভাবে? এই প্রশ্ন নিয়ে বিতর্ক হয়ে আসছে। বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত বিভিন্ন মতবাদ দেওয়া চেষ্টা করেছেন। সে রকমই একজন সমাজবিজ্ঞানী হলেন ইবনে খালদুন। তা মতবাদটি একটি উল্লেখযোগ্য মতবাদ।

রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত ইবনে খালদুনের মতবাদ আলোচনা



রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত ইবনে খালদুনের মতবাদঃ ইবনে খালদুনের মতবাদ অনেকটা বিবর্তনবাদের অনুরুপ। তিনি সর্বত্র বিভিন্ন স্তরকে বিভিন্নভাবে ভাগ করে রাষ্ট্রের উৎপত্তির ব্যাখ্যা দিয়েছেন। নিম্নে তার মতবাদের বর্ণণা করা হলো-
১। সময়কালঃ সভ্যতার সময়কাল নিয়ে ইবনে খালদুন আলোচনা করেছেন যে, সভ্যতার সময় কতটুকু হলে কতদুর পযন্ত বিস্তৃত হলে সে অবস্থায় তার পরিধি কত বড় হতে পারে ইত্যাদি বিষয় নিয়ে তিনি আলোচনা করেছেন। সময়কালের উপর ভিত্তি করে তিনি সভ্যতাকে কয়েকটি পর্বে ভাগ করেছেন।
(ক) ১ থেকে ৪০ বছর পযন্ত হচ্ছে সভ্যতার প্রথম পর্ব।এই পর্বে দলীয়  সংহতির প্রভাব থাকে। এই সময়ে রাষ্ট্রীয় সদস্যরা দেশপ্রেমে জাগ্রত হয়ে সভ্যতার উৎকর্ষ সাধনে মনযোগী হয়।
(খ) ৪১-৮০ বছর পযন্ত সভ্যতার ২য় পর্ব। এই পর্বে নগরীয় জীবনে সংহতির প্রভাব ছিলো। এই সময়ে নগরের সদস্যরা প্রবল আগ্রহে নগরের উৎকর্ষ সাধনের জন্য কাজ করে।
(গ) ৮১-১২০ এই সময়টা হলো নগর সভ্যতা শেষ পর্ব। অলসতার স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়ে তারা সংগতি শৃঙাখল নষ্ট করে ফেলে। ফলে রাষ্ট্র ধ্বংস হয়ে যায়। এভাবে চলার মাধ্যমে কিছুদিন পর আবার চক্রাকারভাবে সভ্যতার প্রথম থেকে শেষ পর্ব আসবে যাবে আর এভাবেই সভ্যতার উৎপত্তি ও বিন্যাস চলতে থাকে।
২। উন্নতির ভিত্তিতে আলোচনাঃ সভ্যতার উন্নতি অবন্নতির  উপর ভিত্তি করে ইবনে খালদুন সভ্যতাকে কয়েকভাগে ভাগ করেন।
(ক) সরল অবস্থাঃ সভ্যতার শুরুতে সরল অবস্থা বিরাজ করে। সবাই একই শ্রেণির মানুষ থাকে।
(খ) শ্রেণি বৈষম্যঃ ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণা যখন প্রবল হতে থাকে তখন তাদের মধ্যে সম্পদ কারো বাড়তে থাকে আবার কারো কমতে থাকে। এই সময়ে চরম শ্রেণি বৈষম্য সৃষ্টি হয়।
(গ) অভিজাত শ্রেণি শোষক শ্রেণিঃ শ্রেণি বৈষম্যর ফলে অভিজাত শ্রেণি সৃষ্টি হয়। তারা মানুষকে শোষণ করা শুরু করে। এই অবস্থা যখন অসহনীয় হয়ে উঠে তখন সবাই মিলে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে। ্এই ব্যবস্থা থেকেই রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়।
৩। সভ্যতার বিবর্তন পর্বঃ সভ্যতার উৎপত্তির জন্য ইবনে খালদুন বিবর্তনকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেন রাষ্ট্র বা সভ্যতার মত এত বৃহৎ কোনো জিনিস একদিনে সৃষ্টি হতে পারে না। এটা দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ফল।
৪। চক্রাকার পর্যায়ঃ চক্রাকার পর্যায়ে সভ্যতাকে কয়েকটি স্তর পার করতে হয়। যেগুলো নিম্নরুপ-
(ক) সংহতির পর্বঃ সংহতির পর্ব দিয়ে রাষ্ট্র বা সভ্যতার যাত্রা শুরু হয়। মানুষে মানুষে যখন সবাই মিলে একসাথে সংহতি প্রকাশ করে তখন রাষ্ট্র নামক সংস্থা গড়ে উঠে।
(খ) শান্তি পর্বঃ সংহতি পর্ব দ্বারা রাষ্ট্র সৃষ্টি হওয়ার পর আসে শান্তি পর্ব। শুরুতে মানুষ অনাবিল সুখ শান্তিতে বসবাস করে। অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করে থাকে ও সমান সুযোগ সুবিধা ভোগ করতে থাকে। কিন্তু এ অবস্থা বেশিদিন থাকে না।
(গ) শোষণ পর্বঃ শান্তির পর্বের সমাপ্তি ঘটে শুরু হয় শোষণ পর্ব। এই শোসণ পর্ব এসে আর কোন সমান সুযোগ সুবিধা থাকে না।না থাকে কোন স্বাধীনতা। সবলরা দূর্বলদের উপর অত্যাচার শুরু করে। শোষণ করে তারা ফুলে ফেফে উঠে। এই অবস্থায় সমাজে নৈরাজ্য বিরাজ করে। মানুষের জীবন দূর্বিসহ হয়ে উঠে।সুখ শান্তি বিনষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু এ অবস্থাও অবিরত চলতে পারে না এক সময় শেষ হয়।
(ঘ) পতন পর্বঃ শোষণ পর্ব যখন অতি মাত্রায় চলতে থাকে তখন মানুষ অসহায়হীন হয়ে পড়ে। তারা প্রতিবাদ শুরু করে নায্য অধিকার চায়। এভাবে যুদ্ধ বিগ্রোহের সৃষ্টি হয়। ফলে সভ্যতার পতন হয়। পরবর্তীতে আবার শুরু হয় সংহতির পর্ব, শান্তি পর্ব, শোষণ পর্ব, পতন পর্ব। এভাবে চক্রাকারে চলতে থাকে।
ইবনে খালদুন রাষ্ট্রে উৎপত্তি সংক্রান্ত যে তত্ত্ব দিয়েছেন তা অনেকটাই গ্রহণযোগ্য।
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post