‘‘সাংগ্রাই উৎসব’’ কী ও হাজং কারা?
ভূমিকা: মারমা বাংলাদেশের একটি আদিবাসী ও ক্ষুদ্র জাতিসত্তা। এদের অধিকাংশই বান্দরবানে বাস করে। এরা মঙ্গোলীয় বংশোদ্ভূত বৌদ্ধ ধর্মের। এদের প্রধান ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব বৌদ্ধ পূর্ণিমা, কঠিন চিবর দান, ওয়াহগ্যই এবং সাংগ্রাই। এদের মধ্যে সাংগ্রাই উৎসব অন্যতম।
সাংগ্রাই উৎসব: মারমাদের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানকে সাংগ্রাই বলে। মারমারা ধর্মীয় ক্যালেন্ডারের বছরের শেষের ২দিন আর নতুন বছরের প্রথম দিনসহ মোট ৩ দিনকে সাংগ্রাই হিসেবে পালন করে থাকে। সাংগ্রাইয়ের প্রধান আকর্ষণ পানি খেলা। এপ্রিলের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখ পানি খেলার মাধ্যমে তারা সাংগ্রাই উৎসব পালন করে। মারমারা একে 'ডি লং পোয়ে' বলে। তাদের কাছে সাংগ্রাই হলো পুরাতন বছরকে বিদায় করে দিয়ে নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়া। উৎসবের কিছুদিন আগে থেকেই নারীরা পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে থাকে। ঘরগুলো নতুন করে সাজায়। জুম থেকে চাউল নানারকমের পিঠার জন্য রেখে দেওয়া হয়। মারমা তরুণীরা দর্জিদের নিকট গিয়ে সুন্দর সুন্দর 'থামি' (মারমা মেয়েদের পোশাক) তৈরি করে নিয়ে আসে।
ফুলসাংগ্রাই হয় ১২ এপ্রিলের রাতে। শীতের পর বসন্তের আগমনে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়গুলোতে ছোঁয়া লাগে। ফলে পাহাড় দেখা যায় নানা ফুলের সমারোহে। সাংগ্রাইয়ের রাতে তরুণীরা ফুলগুলো দিয়ে তাদের বাড়িঘর সাজায়। 'সাংগ্রাই পারং' নামের সাদা ফুল এখানে জনপ্রিয়। গিন্নিরা সকালে সুতা দিয়ে ফুল সাজিয়ে পূজা করে। রাতে গিন্নিরা পিঠাও বানায়। বয়োজ্যেষ্ঠরা এদিন শিশুদেরকে মারমা ডাইনি 'ফ্রজুমা'-এর ভয়ের কেচ্ছা শুনায়।
সাংগ্রাইয়ের দিনে ১৩ তারিখে সাংগ্রাই হাট বসে। এখানে সাংগ্রাই উৎসবের সবকিছুই পাওয়া যায়। স্নানের পবিত্র পানি, নারকেল, চীনা কাগজ, মোমবাতি, আগরবাতি, নতুন জামা, প্লাস্টিকের খেলনা অস্ত্র প্রভৃতি সাংগ্রাই বাজারের অন্যতম আকর্ষণ। ১৫ এপ্রিল প্রধান সাংগ্রাই পালন করা হয়। এদিন পিঠা ও ভালো ভালো খাবার তারা বিহারে পাঠায়। এছাড়াও তরুণ-তরুণীরা বয়োজ্যেষ্ঠদের স্নান করায়। ফলে তারা সাংগ্রাই সেলামি পায়। এছাড়াও খাবার খেয়ে নতুন বছরের আশীর্বাদ নিয়ে আসে।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায়, প্রধান সাংগ্রাইতে বিহারের বুদ্ধের স্নানকৃত পানি রোগমুক্তির উদ্দেশ্যে মারমারা খেয়ে থাকে। এরপর ডি লং পোয়ে বা জলকেলি উৎসব শুরু হয়। মেয়েরা থামি আর ছেলেরা লুঙ্গি পড়ে সাংগ্রাই র্যালি করে। এছাড়াও বলি খেলা, দড়ি টানাটানি, তাং তাং খেলা ও মারমা ঐতিহ্যবাহী নৃত্য হয়ে থাকে।
হাজংদের সম্পর্কে যা জান সংক্ষেপে লেখ।
ভূমিকা: নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে একটি অন্যতম হলো হাজং। তাদের জীবনঝাপন পদ্ধতি, সংস্কৃতি, শিক্ষা সবকিছু ব্যতিক্রম। কারণ তাদের আর্থসামজিক অবস্থা খুবই বৈচিত্র্যপূর্ণ।
হাজং: হাজংদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় নিম্নে তুলে ধরা হলো-
১. বাসস্থান: হাজং সম্প্রদায়ের লোকেরা বাংলাদেশের ময়মনসিংহ অঞ্চলের গারো পাহাড়ের পাদদেশে সমতল এলাকা এবং সুনামগঞ্জ জেলার সমতল ভূমিতে বসবাস করে। এরা ভারতের মেঘালয়সহ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলেও বসবাস করছে।
২. ধর্ম: মূলত হাজংদের ওপর হিন্দুধর্মের প্রভাৱ বেশি। এরা বিভিন্ন পূজা পার্বণ পালন করে। এরা দেব-দেবীদের খুশি করার জন্য বিভিন্ন জীব উৎসর্গ করে। তারা হিন্দুধর্মের অনুসরণ করে এক প্রকার বলা যায়।
৩. উত্তরাধিকার উত্তরাধিকার সূত্রে হাজং পরিবারে ছেলেরা সকল সম্পত্তির মালিক। তবে পিতা ইচ্ছা করলে মেয়েকে সম্পত্তি দিতে পারে।
৪. ঘরবাড়ি: গারোদের মতো হাজংরা তাদের ঘর বাড়ি তৈরি করে। গ্রামীণ ঘরববাড়িগুলো সাধারণত বাঁশ ও টিনের তৈরি। তাছাড়া ধনীদের রয়েছে পাকা দালানকোঠা।
৫. অর্থনৈতিক কাঠামো: হাজংদের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব ভালো নয়। তাদের উৎপাদিত দ্রব্য বাইরে বিক্রি করে না। তবে বর্তমানে হাজংরা বিভিন্ন ব্যবসায় ও চাকরিতে নিয়োজিত হচ্ছে। তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা পূর্বের তুলনায় ভালো।
৬. পেশা: হাজংরা জুম চাষ করে। এছাড়া এরা বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত রয়েছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পেশা কাঠ ও ফলমূল সংগ্রহ, মাছ শিকার প্রভৃতি।
৭. খাদ্যদ্রব্য: ভাত, মাংস ও সবজি হাজংদের প্রধান খাদ্য। বর্তমানে তারা ছাগল, ফলমূল, শূকর প্রভৃতি খেয়ে থাকে। তারা নিজেদের মদ তৈরি করে তা পান করে।
৮. ভাষা ও সংস্কৃতি: হাজংরা নিজস্ব ভাষায় কথা বলে।তাদের ভাষায় রয়েছে কাছাড়ি, টিরোন্টি ও গারো ভাষার মিশ্রণ। । তাদের ভাষার নিজস্ব কোনো বর্ণ নেই।
৯. অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া: হাজংদের কেউ মারা গেলে তাকে পোড়ানো হয়। মৃত আত্মার শান্তির জন্য তারা বিভিন্ন অনুষ্ঠান করে থাকে।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায়, হাজংদের জীবন খুবই -বৈচিত্র্যময়। কিছু বৈশিষ্ট্য সকল আদিবাসীর মধ্যে লক্ষ করা গেলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা তাদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের - ভিত্তিতে জীবনযাপন করে।

No comments:
Post a Comment