উপাত্ত শ্রেণিকবদ্ধকরণের অসুবিধাসমূহ লিখ
ভূমিকা: উপাত্ত বিশ্লেষণ ও উপস্থাপনের ক্ষেত্রে শ্রেণিকরণ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। বহুবিধ, বৃহৎ বা বিশৃঙ্খল তথ্যকে সহজবোধ্য ও সংক্ষিপ্ত করার লক্ষ্যেই শ্রেণিবিন্যাস করা হয়। শ্রেণিকরণের সাহায্যে উপাত্ত সারিবদ্ধ, সুসংগঠিত ও তুলনাযোগ্য হয়ে ওঠে এটি সত্য। কিন্তু এর পাশাপাশি বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য অসুবিধা, সীমাবদ্ধতা ও ঝুঁকিও রয়েছে, যা অনেক সময় বিশ্লেষণের গুণগত মানকে প্রভাবিত করতে পারে।
উপাত্ত শ্রেণিকবদ্ধকরণ অসুবিধা
নিচে উপাত্ত শ্রেণিকবদ্ধকরণের অসুবিধাগুলো বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো।
১. উপাত্তের স্বাতন্ত্র্য নষ্ট হয়ে যায়
শ্রেণিকরণের সবচেয়ে বড় অসুবিধা হলো অপরিশ্রুত বা মূল তথ্যের ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যগুলো হারিয়ে যায়। ধরা যাক, ১৮, ১৯, ২১, ২২, ২৩ বছর বয়সের পাঁচজন ব্যক্তিকে “১৮–২৫” বছরের একটি বড় শ্রেণিতে রাখা হলো। ফলে প্রত্যেক উপাত্তের নির্দিষ্ট মান আর আলাদা করে জানা যায় না। ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যের এই বিলোপ অনেক সময় গবেষণার সূক্ষ্মতা নষ্ট করে দেয়।
২. শ্রেণিসীমা নির্বাচন জটিল ও ভুলের সম্ভাবনা বেশি
শ্রেণি তৈরির সময়ে শ্রেণিসীমা ঠিক করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভুল শ্রেণিসীমা ব্যবহার করলে পুরো তথ্যই বিকৃত হয়ে পড়তে পারে। যেমন: বয়স ০–৫, ৫–১০ করলে ৫ বছর কোন শ্রেণিতে পড়বে এই দ্বিধা তথ্যকে বিভ্রান্ত করে। শ্রেণিসীমার ভিন্নতা অনুযায়ী বিশ্লেষণের ফলও ভিন্ন হতে পারে, যা সাধারণত অনভিজ্ঞ পরিসংখ্যানবিদদের ক্ষেত্রে বড় সমস্যা সৃষ্টি করে।
৩. নমনীয়তার অভাব
শ্রেণিকরণ করা হলে পরে তথ্য যোগ বা পরিবর্তন করা কঠিন হয়ে পড়ে। ধরুন, কোনো শ্রেণিতে অতিরিক্ত তথ্য যুক্ত হতে চাইলো কিন্তু সেই শ্রেণি আবার ভেঙে সাজাতে হচ্ছে এতে সময় ও শ্রম দুটোই বেশি লাগে। একবার শ্রেণিকরণ করা হলে নতুন উপাত্ত সংযোজনের ক্ষেত্রে তাই নমনীয়তা কমে যায়।
৪. শ্রেণিব্যবধান নির্ধারণে ত্রুটির সম্ভাবনা
শ্রেণিব্যবধান (class interval) খুব ছোট হলে শ্রেণির সংখ্যা বেড়ে যায়, আবার খুব বড় হলে তথ্যের সূক্ষ্মতা হারিয়ে যায়। উপযুক্ত শ্রেণিব্যবধান নির্বাচন না হলে তথ্যের প্রকৃতি বোঝা কঠিন হয়। ভুল শ্রেণিব্যবধানের কারণে গ্রাফ, গড়, মধ্যমা ইত্যাদি পরিমাপও ভুল হতে পারে।
৫. তথ্য বিকৃত হবার সম্ভাবনা
শ্রেণিকরণে তথ্যকে কৃত্রিমভাবে একত্রে সাজানো হয়, যা অনেক সময় প্রকৃত চিত্রকে বিকৃত করে। যেমন, কোনো কোম্পানির কর্মীদের বেতন ১০,০০০ টাকা থেকে ১,০০,০০০ টাকা পর্যন্ত হলে ১০,০০০–৩০,০০০, ৩০,০০০–৫০,০০০ শ্রেণি তৈরি করলে উচ্চ আয়ের কর্মীদের অবস্থা ও পার্থক্য স্পষ্ট বোঝা যায় না। ফলে তথ্যের বৈচিত্র্য ও বাস্তবতা উভয়ই আড়াল হয়ে যেতে পারে।
৬. বিশ্লেষণের গভীরতা কমে যায়
শ্রেণিকরণের মাধ্যমে তথ্যের একটি সারসংক্ষেপ পাওয়া যায় ঠিকই, কিন্তু গভীর বিশ্লেষণের সুযোগ কমে যায়। যেমন, পরীক্ষার নম্বর ৫০–৬০ শ্রেণিতে কত জন ফেল করেছে বা পাস করেছে এগুলো জানা যায় না। শ্রেণিকরণের কারণে তথ্যের বিশ্লেষণ ক্ষমতা অনেক ক্ষেত্রেই সীমিত হয়ে পড়ে।
৭. উপাত্তের সঠিক প্রবণতা ধরা কঠিন হয়
বেশি শ্রেণি করা হলে প্রবণতা বা প্যাটার্ন ধরা যায় না, আবার কম শ্রেণি করলে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায় না। অনেক সময় শ্রেণিকরণের ফলে আসল গতিধারাটি স্পষ্ট হয় না। তাই তথ্যের প্রকৃত ট্রেন্ড সনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে।
৮. সময় ও শ্রম বেশি লাগে
একটি তথ্যসারিকে শ্রেণিকবদ্ধ করতে হলে পরিসর নির্ণয়, শ্রেণি সংখ্যা ঠিক করা, শ্রেণিসীমা ও শ্রেণিব্যবধান নির্ধারণ, ট্যালিচিহ্ন, ফ্রিকোয়েন্সি গণনা ইত্যাদি একাধিক ধাপ অনুসরণ করতে হয়। এগুলো সময়সাপেক্ষ এবং সঠিকভাবে না করলে পুরো তথ্য ভুল হতে পারে।
৯. তথ্যের তুলনাযোগ্যতা সবসময় সুনিশ্চিত হয় না
ভিন্ন ভিন্ন গবেষক একই তথ্যকে আলাদা শ্রেণিতে বিভক্ত করতে পারেন। যেমন, কেউ আয়কে ০–১০,০০০; ১০,০০০–২০,০০০ করতে পারেন, আবার কেউ ০–১৫,০০০; ১৫,০০০–৩০,০০০ করতে পারেন। ফলে এ ধরনের শ্রেণিকরণের কারণে তথ্যের তুলনা সবসময় সঠিক বা মানানসই হয় না।
উপসংহার: পরিসংখ্যানে উপাত্ত শ্রেণিকরণ তথ্যকে সহজ, সারসংক্ষেপ ও বোধগম্য করার একটি কার্যকর পদ্ধতি হলেও এর বেশ কিছু অসুবিধা রয়েছে। ব্যক্তিগত তথ্যের স্বাতন্ত্র্য বিলোপ, শ্রেণি নির্বাচনে জটিলতা, তথ্য বিকৃতি, বিশ্লেষণের গভীরতা কমে যাওয়া এসব কারণে শ্রেণিকরণ কখনো ভুল সিদ্ধান্তের দিকে নিয়ে যেতে পারে। তাই শ্রেণিকরণ একটি প্রয়োজনীয় হলেও অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে সম্পন্ন করার বিষয়।

No comments:
Post a Comment