ভিলফ্রেডো প্যারেটো ছিলেন ফ্যাসিবাদের চিন্তার জনক"- ব্যাখ্যা কর

ভিলফ্রেডো প্যারেটো ছিলেন ফ্যাসিবাদের চিন্তার জনক"- ব্যাখ্যা কর

ভিলফ্রেডো প্যারেটো ছিলেন ফ্যাসিবাদের চিন্তার জনক"- ব্যাখ্যা কর।

অথবা, ভিলফ্রেডো প্যারেটোর রাজনৈতিক মতবাদ মূল্যায়ন কর।

ভূমিকা: ভিলফ্রেডো প্যারেটো ১৮৪৮ সালে প্যারিসে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ছিলেন মারচেজ র‍্যাকল প্যারেটো এবং মা মেরী মেটিনার। প্যারেটো প্যারিস এবং টিউরীনে লেখাপড়া করেন। তিনি ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে গ্রাজুয়েট ডিগ্রি লাভ করার পর ব্যবসা শুরু করেন। পরবর্তীকালে তিনি ইতালির রোমে রেলওয়ে কোম্পানির চাকরিতে যোগ দিন। এরপর তিনি ১৮৮৪ সালে সোসাইটি ফেরিয়ার দ্য ইতালিয়া নামক একটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করেন। ১৮৮২ খ্রি. তাঁর বাবা এবং ১৮৮৯ খ্রি. তার মা মারা যাওয়ার পর তিনি নতুন জীবনের অন্বেষায় ঝুঁকে পড়েন। চাকরি থেকে তিনি ইস্তফা দিলেন। তারপর তিনি একজন দরিদ্র রাশিয়ান মেয়ের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবন্ধ হন।

ভিলফ্রেডো প্যারেটো ছিলেন ফ্যাসিবাদের চিন্তার জনক"- ব্যাখ্যা কর


১৮৯৩ খ্রি. প্যারেটো তাঁর বন্ধু মাফিও পেস্টালিওনীর সহযোগিতায় লুসান বিশ্ববিদ্যালয়ে পলিটিক্যাল ইকোনমির অধ্যাপক ওয়ালরাস কর্তৃক প্রবর্তিত 'ইকুইলিব্রিয়াম সিস্টেম' সম্বন্ধে আগ্রহী হয়ে পড়েন এবং ক্রমশই অগণতান্ত্রিক চিন্তাধারা এবং বিশ্বাসে ঝুঁকে পড়েন।

ভিলফ্রেডো প্যারেটোর রাজনৈতিক মতবাদ

ভিলফ্রেডো প্যারেটো মূলত একজন সমাজবিজ্ঞানী। তা সত্ত্বেও রাষ্ট্র দর্শনে তাঁর অবদান মোটেই ছোট করে দেখার অবকাশ নেই। নিম্নে তার রাজনৈতিক মতবাদ আলোচনা করা হলো।

১. প্যারেটোর সমাজতত্ত্ব: প্যারেটোর সমাজতত্ত্ব মূলত যুক্তি পরীক্ষণ পদ্ধতি বা মেথডের উপর নির্ভরশীল। এ পদ্ধতির মূল সূত্র হলো পরীক্ষণ এবং যুক্তির আশ্রয়ে সমাজ বিশ্লেষণ।

২. এলিট শ্রেণির আবর্তন: রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানে এলিটের আবর্তনবাদ প্যারেটোর অন্যতম প্রধান অবদান। একটি সমাজ বা সম্প্রদায় এলিটদের একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর দ্বারা শাসিত হয়ে থাকে। তবে তিনি একথাও বলেছেন যে, ক্ষুদ্র এলিট গোষ্ঠীর দ্বারা শাসিত হলেও একটি দেশে সে এলিট গোষ্ঠী স্থায়ীভাবে শাসনকার্যে বহাল থাকতে পারে না এবং তারা অশাসনকারী এলিটের দ্বারা অপসারিত হয়।

৩. এলিট এবং নন এলিট: প্যারেটো বলেছেন, "মানুষের এবং সকল প্রাণীর সহজাত ধরনের সকল আচরণই কেবলমাত্র তাদের অস্তিত্বের প্রয়োজনে করে থাকে। এসব আচরণের কোন যৌক্তিক ভিত্তি নেই। সমাজে প্রতিটি ক্ষেত্রে দুই ধরনের যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি পাওয়া যায়। তিনি উচ্চতর যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে এলিট এবং নিতর যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে নন এলিট নামে অবহিত করেছেন।"

৪. মানুষের শ্রেণিবিভাগ: ডিলফ্রেডো প্যারেটো সমাজবিজ্ঞানে সর্বপ্রথম এলিট বা সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর ক্ষমতার কথা আবিষ্কার করেন। তিনি দেখান যে, সমাজের মানুষ দুই শ্রেণিতে বিভক্ত। একটা হলো এলিট বা প্রভাবশালী সংখ্যালঘু গোষ্ঠী অন্যটি হলো জনসাধারণ।

৫. যোগ্যতার দিক দিয়ে সব মানুষ সমান নয়: আসলে প্যারেটোর তত্ত্ব ধারা অনুপ্রাণিত হয়েই মুসোলিনী ডায় ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রদর্শনের গোড়াপত্তন করেন। প্যারেটোর রাষ্ট্রদর্শনের মূল কথা হলো যে, মানুষমাত্রই অযুক্তিবাদী এবং সকল মানুষই যোগ্যতা ও প্রতিভার দিক দিয়ে সমান নয়।

৬. গণতন্ত্র অধাতন শাসনব্যবস্থা: গণতন্ত্র অবাস্তব শাসনব্যবস্থা এই কথাটির মধ্যেই প্যারেটোর ফ্যাসিবাদের ধারণা বিদ্যমান। প্যারেটো তাঁর রাষ্ট্রদর্শন আলোচনায় 'সারকুলেশন অব দি এলিট' সম্পর্কে যেসব তত্ত্ব ও মতবাদ প্রচার হয়েছেন সেগুলো খুব মূল্যবান এবং সেকালের রাষ্ট্রদর্শনকে গোড়াপত্তন করে। প্যারেটোর রাষ্ট্রদর্শনকে সমৃদ্ধ করার পক্ষে খুবই সহায়ক।

৭. যুক্তি পরীক্ষণ পদ্ধতি: প্যারেটো তাঁর সমাজতন্ত্রের বিশ্লেষণে সাধারণভাবে যে পদ্ধতি অনুসরণ করেন তাকে যুক্তি পরীক্ষণ পদ্ধতি বলা হয়। তিনি মানুষের কর্মকাণ্ডকে যৌক্তিক ও অযৌক্তিক বলে ভাগ করেন। তিনি বলেছেন, "যে মানুষ প্রথমে অযৌক্তিকভাবে একটা কাজ শুরু করে, পরে সেটাকে যৌক্তিক বলে প্রমাণ করার চেষ্টা চালায়।"

৮. ক্ষমতা কয়েকজন লোকের যাতে কেন্দ্রীভূত থাকবে: সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে প্যারেটোই প্রথম দেখিয়েছেন যে, যে কোন সমাজেই হোক, ক্ষমতা কয়েকজনের মধ্যে কেন্দ্রীভূত থাকবে যাতে ক্ষমতাধারী সংখ্যালঘু গোষ্ঠী ক্ষমতালিষ্ণু সংখ্যালঘু গোষ্ঠী কর্তৃক ক্ষমতাচ্যুত হলেও ক্ষমতা আবার সংখ্যালঘুর হয়েই কেন্দ্রীভূত হবে।

৯. এলিট শ্রেণি: সমাজে প্রায়ই দেখা যায় যে, কিছু লোক সবল আর কিছু লোক দূর্বল, কিছু লোক জ্ঞানী আর কিছু লোক নির্বোধ। বিশেষ কোন ক্ষেত্রে যে গ্রুপটি সবচেয়ে বেশি যোগ্যতার অধিকারী সেটিই হচ্ছে সেক্ষেত্রের এলিট শ্রেণি। এ এলিট শ্রেণিই উক্ত ক্ষেত্রটিকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।

১০. প্যারেটোর এলিটতত্ত্ব: প্যারেটোর মতে, মানবসমাজের মধ্যে বিশেষ গ্রুপ বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে পারদর্শী। মানবসমাজে দুইজন লোক কিংবা মানুষের দুটি গোষ্ঠী কোনদিন সর্বতোভাবে সমান হতে পারে না।

১১. গণতন্ত্র ধনিকতন্ত্রের নামান্তর: সমাজে প্রত্যেক স্তরে একটি প্রভাবশালী চক্র বা এলিট থাকে। এদের অপেক্ষাকৃত উচ্চ শ্রেণিতে স্থান লাভের প্রবণতা থাকে। একটি দেশের শাসনব্যবস্থা যতই গণতান্ত্রিক চরিত্রবিশিষ্ট হোক না কেন, তা বাস্তবিক পক্ষে বিত্তবান ব্যক্তিদের কিংবা তাদের সমর্থনপুষ্ট লোকজন দ্বারা গঠিত নয়। এ প্রকৃতি শাসনব্যবস্থাকে গণতন্ত্র না বলে ধনিকতন্ত্র বলাই যুক্তিযুক্ত।

১২. এলিট গোষ্ঠীর সময়কাল: প্রথম শ্রেণির এলিটগণ যখন ক্ষমতায় থাকে তখন এমন একটি গতিহীন ও স্বাসরুদ্ধকর অবস্থার সৃষ্টি হয় যায় ফলে এলিটদের স্বতঃস্ফূর্ত আবর্তন শুরু হয়ে যায়। অষ্টাদশ শতাব্দীর ফরাসি বিপ্লবের সময় ফ্রান্সে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। এলিট গোষ্ঠীকে তিন শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন। সনাতন এলিট শ্রেণি, উদার গণতান্ত্রিক এলিট শ্রেণি এবং ফ্যাসিস্ট নাজী এলিট শ্রেণি।

১৩। রাষ্ট্র ও বিপ্লব: ম্যাকিয়াভেলী তার প্রিন্সকে যে শৃগালের মত ধূর্ত এবং সিংহের ন্যায় শক্তিশালী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তা প্যারেটোর কথার অনুরূপ। প্যারেটো মনে করেন যে, শাসক চক্র বহির্ভূত প্রভাবশালী ব্যক্তিরা সাধারণত মর্যাদা বা ক্ষমতার লোভে বিদ্রোহাত্মক কার্যকলাপে লিপ্ত হয়।

উপসংহার: পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, প্যারেটো ছিলেন আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত একজন রাষ্ট্রদার্শনিক। তাই তিনি শিক্ষিত লোকদের সমন্বয়ে গঠিত এলিট শ্রেণির শাসন প্রতিষ্ঠার পক্ষে যুক্তি প্রদান করেন। দেখা যায় যে, শাসক শ্রেণির মধ্যে এক প্রকার রেসিডিউস হ্রাস পায়। হ্রাসপ্রাপ্ত রেসিডিউস সম্পন্ন এলিট শ্রেণি ক্ষমতাচ্যুত হন। এ কথা বলতে পারি যে, আদর্শ শাসনব্যবস্থা তখনই প্রবর্তিত হবে যখন শাসক শ্রেণির মধ্যে প্রথম প্রকার ও দ্বিতীয় প্রকার রেসিডিউসের সুষ্ঠু সমন্বয় সাধন হবে কিন্তু যাস্তবিক পক্ষে তা হয় না।

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post