লিঙ্গভিত্তিক অসমতা বলতে কী বুঝ?
ভূমিকা: পৃথিবীতে এমন কোনো সমাজ নেই যেখানে নারী পুরুষের মধ্যে পার্থক্য নেই। পৃথিবীর সব সমাজেই নারী পুরুষের মাঝে পার্থক্য বিদ্যমান। এ পার্থক্য কিংবা বৈষম্যমূলক আচরণের কারণ কী এবং যৌক্তিকতা কতটুকু সেটা বিশ্লেষণের অপেক্ষা রাখে। নারী-পুরুষের প্রতি সমাজের বৈষম্যমূলক আচরণ কী উদ্দেশ্য প্রণোদিত? স্বাভাবিকভাবে নারী পুরুষের মাঝে বিদ্যমান কিছু মৌলিক পার্থক্যের কারণে অনিচ্ছাকৃতভাবে সমাজে বৈষম্যমূলক আচরণ সৃষ্টি হয়েছে
বিভিন্ন সমাজ স্থানীয় আর্থসামাজিক ও পরিবেশগত অবস্থার ভিত্তিতে নারী পুরুষকে বিভিন্নভাবে মূল্যায়িত করে এসেছে। অর্থাৎ সর্বক্ষেত্রেই নারী পুরুষের মাঝে বৈষম্য বিদ্যমান। সাধারণ এ বৈষম্য বা লিঙ্গভিত্তিক এ অসমতাকেই লিঙ্গভিত্তিক অসমতা বলে।
লিঙ্গভিত্তিক অসমতা: লিঙ্গভিত্তিক অসমতা বলতে নারী পুরুষের মাঝে বিদ্যমান বৈষম্যকে বুঝানো হয়। অর্থাৎ বিদ্যমান সমাজব্যবস্থায় নারী পুরুষের মাঝে যে বৈষম্যমূলক আচরণ প্রকাশ পায় তাকে লিঙ্গভিত্তিক অসমতা বলে। আর লিঙ্গভিত্তিক অসমতায় নারী-পুরুষের মাঝে এ বৈষম্যমূলক আচরণের ব্যাপারে জীববিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান ও নৃবিজ্ঞানে আমরা সুদৃঢ় প্রমাণ পেয়ে থাকি। বস্তুত, সহজ কথায় অতীত ইতিহাস এবং বর্তমান প্রচলিত সমাজব্যবস্থায় আমাদের চোখে সহজেই এ বিষয়টি অনুমিত হয়। মোটকথা নারী পুরুষের মাঝে বিদ্যমান বৈষম্যকেই লিঙ্গভিত্তিক অসমতা বলে। অনেক সময় ধর্মীয় কারণেও নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য বেড়ে যায়। ধর্মের দোহাই দিয়ে অনেকে নারীদেরকে ঘরে বন্দি রাখতে চায়। ফলে নারীরা নানা বৈষম্যের শিকার হয়। বিশেষ করে আরব দেশগুলোতে এ ধরনের বৈষম্য লক্ষ করা যায়। সমাজবিজ্ঞানী কলিন্স বলেছেন, "লিঙ্গভিত্তিক অসমতা দুটি বিষয়ের উপর প্রতিষ্ঠিত। যথা:-
১. মানুষের মধ্যে যৌন তৃপ্তির তাড়না বেশ প্রবল। যদিও অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে যৌন তাড়না রয়েছে, তথাপি তা সীমিত সময়ের জন্য। সব জীবের মধ্যে মানুষ যৌন আচরণের দিকে থেকে অনন্য ও অনুপম।
২. গড়পরতা হিসেবে নারীর তুলনায় পুরুষেরা দৈহিক আকার আকৃতিতে বড় এবং তারাই অধিক শক্তিশালী। নারী গর্ভধারণ করে এবং সন্তানের যত্ন নেয় বিধায় তারা দৈহিক দিক থেকে বেশ অরক্ষিত (Vulnerable) অবস্থায় থাকে।" আর এ থেকে দেখা যায় যে, সকল সমাজে পুরুষেরা নারীর এ অরক্ষিত (Vulnerable) অবস্থার সুযোগ গ্রহণ করে। অর্থাৎ পুরুষেরা নারীর উপর্যুক্ত দুর্বলতার সুযোগ নেয়; নারীর উপর প্রভুত্ব করে এবং প্রভুত্ব বা খবরদারি করার মতো আদর্শ বা মূল্যবোধ তৈরি করে। বস্তুত মানবসমাজের এ ধারণা থেকে লিঙ্গভিত্তিক অসমতা সৃষ্টি হয়েছে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় দেখা যায় তারাই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। পরিবারের সদস্যরা পুরুষদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হন।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে একথা বলতে পারি যে, নারী-পুরুষের মাঝে চলমান বৈষম্যই হলো লিঙ্গভিত্তিক অসমতা। এদেশে সাধারণত পুরুষশাসিত সমাজ প্রচলিত। আমাদের সমাজে অর্থনৈতিক যোগ্যতা, দক্ষতা, শারীরিক ক্ষমতা প্রভৃতি দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে নারীকে পুরুষের তুলনায় অক্ষম বা তুচ্ছ মনে করা হয়। তবে বর্তমানে নারীরা সর্বক্ষেত্রে তাদের অবদান রাখার ক্ষেত্রে বদ্ধপরিকর।
সামাজিক অসমতা ও সামাজিক স্তরবিন্যাসের মধ্যে কী পার্থক্য বিদ্যমান?
ভূমিকা: আধুনিক সমাজবিজ্ঞানীগণ সামাজিক স্তরবিন্যাসকে সামাজিক অসমতার একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এ কারণেই তারা সামাজিক অসমতার বিভিন্ন দিক আলোচনার পাশাপাশি সামাজিক স্তরবিন্যাস সম্পর্কেও আলোচনা করেছেন। কারণ সামাজিক স্তরবিন্যাস হচ্ছে সামাজিক অসমতার একটি কাঠামোবদ্ধ ব্যবস্থা। অন্যকথায় স্তন রবিন্যাস হচ্ছে অসমতার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ। তাই বলা যায় সামাজিক স্তরবিন্যাসের সাথেই সামাজিক অসমতার অবস্থান।
সামাজিক অসমতা ও স্তরবিন্যাসের মধ্যে পার্থক্যসমূহ:-
নীচে সামাজিক অসমতা ও স্তরবিন্যাসের মধ্যে পার্থক্যগুলো আলোচনা করা হলো।
১. সংজ্ঞাগত পার্থক্য: আর্থসামাজিক রাজনৈতিক ও অন্যান্য দুর্লভ উপাদানের অসম বণ্টনের কারণে সৃষ্ট অসমতাই হলো সামাজিক অসমতা। Fairchild-এর মতে, "পারিবারিক ঐতিহ্য, সামাজিক রীতিনীতি, আচার-অনুষ্ঠান, সম্পদ, আয়, ঐতিহ্য শিক্ষা, রাজনৈতিক ক্ষমতা ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে একটি সাদৃশ্যপূর্ণ সমাজে সামাজিক মর্যাদার ক্ষেত্রে সৃষ্ট পার্থক্য হলো সামাজিক অসমতা।" অন্যদিকে, সামাজিক স্তরবিন্যাস হলো এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে বিভিন্ন আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধার ভিত্তিতে সমাজে বিদ্যমান জনসংখ্যা বিভিন্ন স্তরে বিভক্ত। Dressler-এর মতে, "সামাজিক স্তরবিন্যাস হলো এমন একটি ব্যবস্থা যার মাধ্যমে ব্যক্তিদেরকে বিভিন্ন স্তর, মান, মর্যাদা ও সম্মানে বিভক্ত করা হয়।"
২. নিয়ম ও কাঠামোগত পার্থক্য: সামাজিক অসমতা নিয়ম ও কাঠামো নির্ভর নয়। এটি কাঙ্ক্ষিত বিষয়বস্তুকে ব্যক্তির *বা গোষ্ঠীর অসম অধিকারকে বুঝায়। বুঝায় কাঙ্ক্ষিত বিষয় বস্তুর সামাজিক স্তরবিন্যাস অটল ও স্থির রূপ পরিগ্রহ করে। এজন্য স্ত রবিন্যাস ও অসমতার মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করতে গিয়ে Kriesberg (ক্রিসবার্গ) বলেন, সামাজিক স্তরবিন্যাস হলো অসমতার এমন একটি অটল এবং স্থির ব্যবস্থা যা নিয়ম ও কাঠামো নির্ভরে গড়ে উঠে।" (Social stratification refers to the persistent pattern of a system of inequality based on rules and structures.)
৩. ক্ষেত্রগত: সমাজবিজ্ঞানী Smalsar তাঁর The Components in Inequality Webers Statement' শিরোনামে Wealth, Prestige এবং Power সম্পর্কে আলোচনা করে দেখিয়েছেন কীভাবে ঐসব উপাদান সামাজিক অসমতাকে প্রভাবিত করে। অন্যদিকে Runciman তাঁর 'The three Dimensions of Social Inequality' শিরোনামে এক প্রবন্ধে Class, Status এবং Power সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিয়েছেন এবং ঐগুলো যে অসমতার দিক বা ক্ষেত্র তা নির্দেশ দিয়েছেন। ৪. ধরনগত: অবশ্য বলার অপেক্ষা রাখে না যে সামাজিক অসমতা একটি ব্যাপক বিষয়। অন্যদিকে অসমতারই একটি বিশেষ ক্ষেত্র ও প্রত্যয় হচ্ছে সামাজিক স্তরবিন্যাস।
৫. প্রাতিষ্ঠানিক দিক: বস্তুত অসমতার প্রাতিষ্ঠানিক দিকটিকেই সামাজিক স্তরবিন্যাস বলা হয়। তার স্তরবিন্যাসের প্রাতিষ্ঠানিক দিক রয়েছে। অন্যদিকে, অসমতার তা নেই; বরং প্রাতিষ্ঠানিক অসমতা বিশ্লেষণে স্তরবিন্যাস পদটিকেই ব্যবহার করা হয়। এ সম্পর্কে Kriesberg বলেছেন, "We use the term (stratification) to discuss institutionalized inequality."
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে বলা যায় যে, সামাজিক অসমতা ও সামাজিক স্তরবিন্যাস একটি অপরটির অবিচ্ছেদ্য অংশ। সামাজিক অসমতা ব্যতীত সামাজিক স্তরবিন্যাস পরিলক্ষিত হয় না। সামাজিক অসমতা ও স্তরবিন্যাস প্রত্যয় দুটি সম্পৃক্ত ও সমগোত্রীয়। সামাজিক অসমতার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক উপাদানকে প্রাধান্য দেওয়া হয় যেখানে অসমতার মাত্রাগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। স্তরবিন্যাসের ক্ষেত্রে অসমতার উপাদানগুলো গুরুত্বপূর্ণ হলেও স্থায়িত্ব ও সামাজিক স্বীকৃতি, কাঠামোবদ্ধতা, প্রাতিষ্ঠানিক গুরুত্ব বেশি মাত্রায় প্রণিধানযোগ্য। পরিশেষে বলা যায় প্রত্যয় দুটি সমগোত্রীয়। এদের মধ্যে মাত্রাগত পার্থক্য থাকলেও মৌলিক পার্থক্য খুবই কম।