সাম্রাজ্যবাদ বলতে কী বুঝ? মার্কস ও এঙ্গেলস সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে যা বলেছেন তা ব্যাখ্যা কর।
ভূমিকা: লেনিন কর্তৃক সামাজ্যবাদ প্রত্যয়ের বিশ্লেষণকে পুঁজিবাদের মার্কসীয় অধ্যয়নে নিঃসন্দেহে একটি নব দিগন্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সাথে সাথে এই বিশ্লেষণটি শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলনের কার্যক্রমকে উৎসাহিত করতে ও পরিচালিত করতে শানিত হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে বলে ধারণা করা হয়। কার্ল মার্কস তাঁর 'Das Capital' গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে পুঁজিবাদের পরিবর্তিত রূপ সম্পর্কে কতকগুলো গভীর মন্তব্য করেছেন যেগুলোকে পরবর্তীতে মার্কসবাদীরা সামাজ্যবাদ তত্ত্ব গঠনের প্রারম্ভিক সূত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন।
সাম্রাজ্যবাদ (Imperialism)
'Imperialism' সাম্রাজ্যবাদের ইংরেজি প্রতিশব্দ এসেছে রোমান শব্দ 'Imperium' থেকে। 'Imperium' শব্দটি নেপোলিয়ন সর্বপ্রথম তাঁর অনুগামীদের শনাক্ত করার জন্য ফ্রান্সে উনবিংশ শতাব্দীর তিনের দশকে প্রয়োগ করা হয়। Imperium শব্দটির অর্থ 'সামরিক অধিনায়কত্ব' যা কোনো বাধানিষেধ মানে না। " সাম্রাজ্যবাদের প্রতিক্রিয়া ও প্রভাব সম্পর্কে বিংশ শতকের মানুষ সচেতন ছিল। বিশ্বশান্তি এবং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা সাম্রাজ্যবাদের দ্বারা বার বার বিপর্যস্ত হয়েছে। সুতরাং সাম্রাজ্যবাদ হচ্ছে বিদেশি শাসন ও অত্যাচারের বিভিন্ন রূপ যা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, মূল্যবোধ ও স্বায়ত্তশাসন নীতিকে যথাযথভাবে মর্যাদা দিতে অস্বীকার করে। এক বিশাল আয়তন বিশিষ্ট রাষ্ট্রকে বোঝায় সাম্রাজ্যবাদ। ঐ রাষ্ট্র একটি কেন্দ্রীয় ইচ্ছার দ্বারা পরিচালিত এ এবং নির্দিষ্ট জাতীয় গোষ্ঠী নিয়ে গঠিত
প্রমাণ্য সংজ্ঞা: বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সাম্রাজ্যবাদের সংজ্ঞায় তাদের স্ব-স্ব মতামত প্রদান করেছেন। নিচে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সংজ্ঞা প্রদান করা হলো:
অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারি (Oxford English Dictionary) সাম্রাজ্যবাদের সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছে এভাবে, Imperialism is the principle of spirit of empire, aduocacy of what are held to be imperial interests. অর্থাৎ "সাম্রাজ্যবাদ হচ্ছে সাম্রাজ্যের নীতি বা চেতনা, যা সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের প্রতি সমর্থন যোগায়।"
সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে সর্বাধিক বাস্তবসম্মত সংজ্ঞা দিয়েছেন চার্লস হজেস (Charles Hodges) তাঁর মতে, "A projection externally or indirectly of the alien political, economical or cultural power of one nation into the internal cite of another people It involves the imposition of control open of convert, direct or indirect of one people by another." অর্থাৎ, কোনো জাতির অভ্যন্তরীণ জীবনযাত্রার মধ্যে বিদেশি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা সংস্কৃতির ক্ষমতার প্রত্যক্ষভাবেই হোক বা পরোক্ষভাবেই হোক, বাণিজ্য প্রতিষ্ঠা লাভকেই সাম্রাজ্যবাদ বলে।সাম্রাজ্যবাদ বলতে এক জাতির উপর অন্য জাতির প্রকাশ্য বা সুপ্ত, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ আরোপকে বুঝায়।
মরিস জুলিয়াস বন (Moris Julias Bon) বলেছেন, "Imperialism is a policy aims at creating organizing and maintaining an empire that it is a state of vast size composed of various more or less distant national units and subject to a single centralized will." অর্থাৎ, সাম্রাজ্যবাদ বলতে এমন এক রাষ্ট্রীয় নীতিকে বুঝায়, যার উদ্দেশ্য হচ্ছে কোনো সাম্রাজ্য সৃষ্টি, সংগঠন এবং সংরক্ষণ করা। সাম্রাজ্য একটি বিরাট আয়তন বিশিষ্ট এলাকা নিয়ে গঠিত হয়, যেখানে কতকগুলো কমবেশি বিভিন্ন ধরনের জনসমষ্টি বিদ্যমান থাকে। এগুলো একক এবং এককেন্দ্রিক সরকারের ইচ্ছাধীন শাসিত হয়।
ভি. আই. লেনিন (V. I. Lenin) তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ 'Imperialism: The Highest Stage Monopoly Capitalism'-এ বলেন, "পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মৌলিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বিকাশ ও তাদের প্রত্যক্ষ অস্তিত্বের জন্য সাম্রাজ্যবাদের উদ্ভব ঘটে।"
পামার ও পারকিন্স (Plamer and Parkins) বলেছেন, "Imperialism can not be defined in general accepted way. It means different thing to different people."
অ্যান্ড্রু ওয়েবস্টার (Anderw Webster)-এর মতে "একটি দেশ নিজের স্বার্থে অন্য দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিনাশ বা সংকুচিত করে তার উপর নিজের প্রভুত্ব ও কর্তৃত্ব যখন স্থাপন করে, তখন সাম্রাজ্যবাদের উদ্ভব হয়।"
পার্কার টি. মুন (Parker T. Moon) তাঁর 'Imperialism - and world politics' গ্রন্থে বলেন, "Imperialism means domination of Non-European native teaches by totally minimal European nation." অর্থাৎ, অ-ইউরোপভুক্ত স্থানীয় জনগণের উপর সম্পূর্ণ বৈসাদৃশ ইউরোপীয় জাতিগুলো যে প্রভুত্ব বজায় রাখে তাকে সাম্রাজ্যবাদ বলে।
চার্লস এ বেয়ার্ড (Charles A Beard) সাম্রাজ্যবাদের সংজ্ঞায় বলেন, "সাম্রাজ্যবাদ হলো কোনো রাষ্ট্র কর্তৃক অন্য রাষ্ট্রের - ভূখণ্ড দখল এবং দখলকৃত ভূখণ্ডে নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা।"
হ্যানস ডালদার (Hance Dalther)-এর মতে, - "সাম্রাজ্যবাদে শব্দটির মাধ্যমে কয়েকটি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অন্য - কয়েকটি রাষ্ট্রের আগ্রাসী আচরণকে বোঝানো হয়। সাধারণভাবে - অধীনস্থ রাজনৈতিক সমাজের উপর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা এবং পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্ঠাকে সাম্রাজ্যবাদ বলে।"
এইচ. জে. মরগেনথু (H. J. Morgenthau)-এর ভাষায়, "A tendency of the expansion of states power beyond its border." অর্থাৎ, কোনো রাষ্ট্র কর্তৃক নিজের সীমানার বাইরে অন্য রাষ্ট্রের উপর ক্ষমতা প্রসারের প্রচেষ্টাকে সাম্রাজ্যবাদ বলে।
মার্কস ও এঙ্গেলস- সাম্রাজ্যবাদ তত্ত্ব (Marx and Engels - Theory of Imperialism)
কার্ল মার্কস ও তাঁর অনুসারীদের মতে, সাম্রাজ্যবাদ নিছক "বলয় বিস্তারের ধারা" (trend toward expansion) বা “বৈদেশিক ভূমিদখল" (Conquest of foreign lands) নয়। যদিও অধিকাংশ রাজনৈতিক বিজ্ঞানী এবং সমাজবিজ্ঞানী সাম্রাজ্যবাদ বলতে তাই মনে করেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোর বড় বড় বুর্জোয়াদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে যে সাধারণ পরিবর্তন সূচিত হয় তাকে সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য 'সাম্রাজ্যবাদ' (Imperialism) শব্দটি ব্যবহার করা হয়। এ পরিবর্তনগুলো বুর্জোয়াদের মৌল কাঠামোর পরিবর্তনের সাথে অত্যন্ত নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত। এ সম্পর্কে E. German বলেন, "The word is used in a much more precise sense to describe the general changes which occured in the political, economic and social activity of the big bourgeoisie of the advanced capitalist countries, beginning in the last quarter of the 19th these bourgeoisies." অর্থাৎ, সাম্রাজ্যবাদ প্রত্যয়টি ব্যবহৃত হয়েছে সুনির্দিষ্টভাবে উনবিংশ শতকের শেষার্ধের, পুঁজিবাদী সমাজে বড় বড় বুর্জোয়াদের কর্মকাণ্ডের সাধারণ পরিবর্তন বুঝাতে যার ফলে সমাজে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সাধারণ পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। এই পরিবর্তনগুলো বুর্জোয়া শ্রণির মৌলিক কাঠামোর পরিবর্তনের সাথে সম্পর্কিত।
মার্কস তাড়াতাড়ি মারা যাওয়ার কারণে তিনি এ পরিবর্তনগুলো ব্যাখ্যা করতে পারেননি। প্রাথমিক নিদর্শনগুলো ছাড়া বেশি কিছু তিনি দেখেননি, এতদসত্ত্বেও মার্কস তাঁর শেষ লেখাগুলোতে এমন কিছু গভীর মন্তব্য রেখে গেছেন। পরবর্তীতে। তাঁর অনুসারীরা সেগুলোকে সাম্রাজ্যবাদ তত্ত্ব বিনির্মাণের সূচনা। পর্ব হিসেবে ব্যবহার করেছেন। মার্কসীয় সাম্রাজ্যবাদ তত্ত্ব বিনির্মাণে যার নামটি সবার আগে আসে তিনি হলেন এঙ্গেলস। এঙ্গেলস এর ধারণা ও মতাদর্শ ব্যতীত মার্কসীয় সাম্রাজ্যবাদ তত্ত্ব অসম্পূর্ণ।
সীমিত দায়দায়িত্বের বড় বড় কোম্পানিগুলো দ্রুত বিকাশকে অধ্যয়ন করতে গিয়ে মার্কস তাঁর 'Das Capital' গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডের ২৩নং অনুচ্ছেদে উল্লেখ করেন যে, মুষ্টিমেয় পুঁজিপতিদের আগ্রাসনে অধিকাংশ পুঁজিপতিরা হারিয়ে যাওয়ার যে নতুন রূপটি দৃশ্যমান হচ্ছে এসব কোম্পানি তারই প্রতিনিধিত্ব করছে। মার্কস-এর ভাষায়, "These companies represent a new form of the expropriation of mass of capitalists by a small handful of capitalists." অর্থাৎ, এই কোম্পানিগুলো মুষ্টিমেয় পুঁজিপতিদের দ্বারা পুঁজিপতিদের একটা নতুন ধরনের বাজেয়াপ্তকরণ নির্দেশ করে।
তিনি আরো বলেন, "In this expropriation the legal owner loses his function as entrepreneur and abandons his role in the process of production and his position of command over the productive forces and the labour force." অর্থাৎ, এই বাজেয়াপ্তকরণ প্রক্রিয়ায় পুঁজির আইনগতভাবে বৈধ মালিক উদ্যোক্তা হিসেবে তার কার্যক্রম হারায় এবং সাথে সাথে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় তার ভূমিকা এবং উৎপাদন শক্তি ও শ্রম শক্তির উপর তার যে নিয়ন্ত্রণমূলক অবস্থান ছিল তাও হারায়।
এমনকি ব্যক্তিগত সম্পত্তিও নিরুদ্ধ হচ্ছে। তবে এটি নিরুদ্ধ হচ্ছে সামষ্টিক মালিকানার অনুকূলে নয় বরং মুষ্টিমেয় পুঁজিপতির ব্যক্তিগত মালিকানার অনুকূলে। Marx তাঁর - "Capital' গ্রন্থে মুনাফার হার হ্রাসের বিপরীতধর্মী ধারা বর্ণনা করতে গিয়ে অনুন্নত দেশগুলোতে পুঁজির রপ্তানির গুরুত্ব বর্ণনা করেন। তিনি তার ধারণাটিকে আরো কিছুটা সাধারণীকরণ করে বলেন, " a capitalist society must continuously extend its base, its area of exploitation." অর্থাৎ, পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইতে গিয়ে ধনতান্ত্রিক সমাজকে অবশ্যই প্রতিনিয়ত এর মৌল কাঠামো ও শোষণের পরিধি বৃদ্ধি করতে হবে।
মার্কসের এই মন্তব্যের সাথে Engels আরো বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে অন্যান্য কাঠামোগত প্রপঞ্চগুলোর উপর দৃষ্টি দিয়েছেন যেগুলোর উপর সাম্রাজ্যবাদের অন্যান্য তাত্ত্বিকগণ গুরুত্বারোপ করেছেন। Engels-এর ভাষায়, "From the beginning of the industrial revolution until the 1870's. England exercised practically an industrial monopoly over the world market. Thanks to that monopoly in the second half of the 19th century the German, French and American competition made in roads into this English monopoly and inaugurated a period of sharp class struggle in Great Britain." অর্থাৎ, শিল্পবিপ্লবের শুরু থেকে ১৮৭০-এর দশক পর্যন্ত ইংল্যান্ড বিশ্ববাজারের উপর একচ্ছত্র শিল্পের আধিপত্য চর্চা করেছিল। এ ধরনের একচ্ছত্র আধিপত্যের জন্য ধন্যবাদ। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের সময় ক্রাফট ইউনিয়নের উদ্ভব ঘটে, ইংরেজ পুঁজিবাদ শ্রমিক শ্রেণির একটি অংশকে গুরুত্বপূর্ণ অনুমোদন প্রদান করে। কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে জার্মান, ফরাসি এবং আমেরিকানরা ইংরেজদের একচেটিয়া আধিপত্যে অনুপ্রবেশ করে এবং এটি গ্রেট বিটেনে তীব্র শ্রেণিসংগ্রামের একটি পর্যায়ের সূচনা করে।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা পরিশেষে বলা যায় যে, মার্কস ও এঙ্গেলস-এর সাম্রাজ্যবাদ তত্ত্বের মূলকথা, হলো, পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় শ্রমিক শোষণ ও শ্রেণিসংগ্রাম যখন তীব্রতর রূপ ধারণ করে তখন সাম্রাজ্যবাদের সূচনা ঘটে। বস্তুত মার্কস ও এঙ্গেলস ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে বুর্জোয়া শ্রেণির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের সুনির্দিষ্ট পরিবর্তন বলতে সাম্রাজ্যবাদ প্রত্যয়টি ব্যবহার করেছেন এবং এই পরিবর্তন মার্কস ও তার অনুসারীরা যে তাত্ত্বিক কাঠামোর মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেছেন তাকে মার্কসীয় সাম্রাজ্যবাদ তত্ত্ব বলা হয়। পুঁজিবাদী সমাজ, বুর্জোয়া শ্রেণির সুনির্দিষ্ট সাধারণ পরিবর্তন, একটা একচেটিয়া বিশ্ববাজার, শ্রেণিসংগ্রাম প্রভৃতি বিষয়গুলো মার্কস ও এঙ্গেলস-এর সাম্রাজ্যবাদ তত্ত্বের মৌলিক বিষয়সমূহ।