উপনিবেশবাদের সংজ্ঞা ও নব্য উপনিবেশবাদের বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা।
ভূমিকাঃ যে কোন উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের শাসিত, শোষিত, বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর ভূমিকা নগণ্য। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে উন্নয়নশীল রাষ্ট্র হচ্ছে শোষণ ও নির্যাতনের উর্বর মঞ্চ। তৃতীয় বিশ্ব উন্নয়নশীল রাষ্ট্র সমূহের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় জাতীয় পর্যায়ে একদিকে রয়েছে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার অব্যবহিত তৎপরতা অপরদিকে রয়েছে সমাজের এলিট গোষ্ঠী ও প্রান্তসীমায় অবস্থান করছে উপেক্ষিত শাসিত, শোষিত জনগোষ্ঠী। আর শোষণ ও নির্যাতনের থাবা চলছে উন্নত দেশসমূহ যেমন ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, রাশিয়া প্রভৃতি দেশ। তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্র সমূহে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করছে। এ কেন্দ্র প্রান্ত সম্পর্কে তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রসমুহে উপনিবেশবাদের সুস্পষ্ট অভিব্যক্তি।
উপনিবেশবাদ (Colonialism)
উন্নয়ন অনুন্নয়নের দ্বান্দ্বিক 'সম্পর্কের ইতিহাসের দ্বিতীয় পর্ব ধরা যায় ও উপনিবেশবাদকে। বর্ধিত ভৌগোলিক দায়দায়িত্ব বা বিজয়ের মাধ্যমে অর্জন করা হয়েছে এ যুগের প্রধান বৈশিষ্ট্য। ইউরোপীয় শিল্প দ্রব্যের জন্য নিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যবস্থার প্রত্যাশা উপনিবেশবাদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য। ধীরে ধীরে বা প্রথমদিকে অনিচ্ছুকভাবে অপেক্ষাকৃত অসংগঠিত বাণিজ্যিক শোষণকে প্রতিস্থাপিত করে মাতৃভূমির প্রয়োজনের সাথে উপনিবেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক সংগঠনকে সংগতিপূর্ণ করার জন্য পরিলক্ষিত প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়। এসব অনুন্নত এলাকাগুলোকে অগ্রসর করতে গিয়ে পাশ্চাত্যকে তাদের প্রযুক্তি, উৎপাদন পদ্ধতি, সামাজিক সংগঠন, সাংস্কৃতিক প্রলক্ষণ, রাজনৈতিক ও আইন ব্যবস্থা স্থানান্তরিত করতে হয়েছে। মার্কসবাদী তত্ত্বের আলোকে বলা যায় যে, এটি করতে গিয়ে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদ এসব ঔপনিবেশিক এলাকাকে আরও অনুন্নত করে। এ ধরনের প্রসারণ ইউরোপীয়দের বসতির কাছে কেন্দ্রীভূত হতে থাকার ফলে ঔপনিবেশিক ও উপনিবেশোত্তর সমাজের দ্বৈততা। সংক্ষেপে বলা যায় যে, পাশ্চাত্য সভ্যতা এজেন্ট হিসেবে কাজ করে।
বুৎপত্তিগত অর্থে উপনিবেশবাদ
উপনিবেশ শব্দটির মূল অর্থ 'মানবসমাজের একটি স্থানান্তরিত অংশ'। ল্যাটিন শব্দ কলোনিয়া (Colonia) থেকে ইংরেজি Colony বা উপনিবেশ শব্দটির উৎপত্তি হয়। এছাড়া রাজনৈতিক দিক দিয়ে বিচার করলে উপনিবেশের অর্থ হয়: ক. দেশের সীমান্তের বাইরে কোনো রাষ্ট্রে বসতি স্থাপন এবং খ. রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো একটি ভূখণ্ড। তবে বর্তমানে উপর্যুক্ত দুটোর মধ্যে দ্বিতীয়টি বেশি প্রযোজ্য।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিভিন্ন লেখক বিভিন্নভাবে উপনিবেশবাদের সংজ্ঞা প্রদান করেন। নিচে তাঁদের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সংজ্ঞা প্রদান করা হলো।
কে.এ. হবসন (K.A. Hobson) তাঁর ''Imperialism A Study' গ্রন্থে ঔপনিবেশিকতার আলোচনা প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন যে, "Colonialism is the best sense, is a natural overflow of nationality; its test is the power of colonists to transplant the civilization they represent to the new natural and social environment is which they find themselves." অর্থাৎ উপনিবেশবাদ হলো জাতীয়তাবাদের এক বহিঃসম্প্রসারণ; উপনিবেশবাদীরা যে নতুন প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশ উপনিবেশ স্থাপন করে সেখানে তাদের নিজস্ব সভ্যতাকে অনুপ্রবিষ্ট করার যে ক্ষমতা তাদের রয়েছে, তাই উপনিবেশবাদ নির্ধারণের মানদণ্ড।
আন্দ্রে গুন্ডার ফ্রাঙ্ক (A.G. Frank) বলেছেন "উপনিবেশবাদ হলো বিভিন্ন জনপদের মধ্যে আধিপত্যের জোরালো সম্পর্ক।"
'Encyclopedia of Science' গ্রন্থে উপনিবেশবাদের দুটি অর্থ উল্লেখ করা হয়েছে-
১. দেশীয় সীমান্তের বাইরে অপর কোনো রাষ্ট্রীয় সীমানায় বসতি স্থাপন এবং
২. রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো একটি ভূখণ্ড যা উক্ত রাষ্ট্রের সাথে আনুগত্য প্রকাশ করে।
রুপার্ট এমারসন (Rupert Emerson)-এর মতে,
"উপনিবেশবাদ হলো কোনো বিদেশি জনসাধারণের উপর দীর্ঘ সময় ধরে শাসন প্রতিষ্ঠা এবং তা বজার রাখার ব্যবস্থা।"
ই. এম. উইনসলো (E.M. Winslow)-এর মতে,"Colonialism means and occupation of virgin territory in which conflict was incidental or even unnecessary and subordinate to the desire of Europeans of find a new place to live." অর্থাৎ, উপনিবেশ বলতে এমন কোনো ভূখণ্ড অধিকার করাকে বুঝায় যেখানে বসবাসের নতুন স্থান লাভ করাই ছিল ইউরোপীয়দের ইচ্ছা এবং যেখানে দ্বন্দ্ব বিরোধ ইচ্ছারই আনুষঙ্গিক এমনটি অপ্রয়োজনীয় ঘটনা ছিল এবং সেখানেও দ্বন্দ্ব বিরোধ ইচ্ছার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
টাউনসেন্ড (Townsend) ও পিক (Peak)-এর মতে, "উপনিবেশবাদ বলতে এক বিশেষ ধরনের শোষণকেই বুঝায়"।
উপসংহার : উপর্যুক্ত সংজ্ঞাগুলোর আলোকে ঔপনিবেশকতা বলতে বুঝায় কোনো অঞ্চলের মানুষের উপর সাম্রাজ্যবাদী নীতি অনুসরণকারী অন্য কোনো সার্বভৌম রাষ্ট্রের শাসন। তবে এ ধারণা সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে পরিবর্তিত হচ্ছে।
নব্য উপনিবেশবাদের সাতটি বৈশিষ্ট্য তুলে ধর।
নব্য উপনিবেশবাদ এবং উপনিবেশবাদ মূলত একই অর্থে ব্যবহৃত হয়। উপনিবেশবাদের নতুন রূপকে নব্য উপনিবেশবাদ বলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ঔপনিবেশিক শাসনে ধস নামে। নব্য উপনিবেশবাদে পূর্ববর্তী উপনিবেশবাদের সকল শোষণ প্রক্রিয়া ভিন্ন কৌশলে উপস্থাপন করা হয় মাত্র। নিজেদের প্রভাব প্রতিপত্তি ধরে রাখার জন্য ঔপনিবেশিক শক্তিসমূহ উপনিবেশবাদ গড়ে তোলে।
নব্য উপনিবেশবাদের সাতটি বৈশিষ্ট্য: তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহ ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণ থেকে এখনো মুক্ত হতে পারেনি। তৃতীয় বিশ্ব বর্তমানে উন্নত বিশ্বের উপর বিভিন্নভাবে নির্ভরশীল। নব্য উপনিবেশবাদ তার পুরাতন নীতির কোনো পরির্বতন করেনি, কতকগুলো কৌশল পরিবর্তন করেছে মাত্র। ফলে উপনিবেশবাদের থাবা থেকে তৃতীয় বিশ্ব মুক্ত হতে পারছে না। নব্য উপনিবেশবাদের সাতটি বৈশিষ্ট্য নিচে আলোচনা করা হলো:
১. অর্থনৈতিক শোষণ প্রক্রিয়া: পূর্বে যেখানে উপনিবেশিক শক্তিসমূহ সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে তৃতীয় বিশ্বকে শোষণ করতো বর্তমানে সেখানে শোষণ প্রক্রিয়া অর্থনৈতিক কেন্দ্রীভূত হয়েছে। নব্য উপনিবেশবাদের অর্থনৈতিক শোষণ ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণ ও পরিকল্পনা প্রণয়নে তৃতীয় বিশ্ব বহুলভাবে ঔপনিবেশিক শক্তির উপর নির্ভরশীল। উন্নত বিশ্বের উপর অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতার যবনিকা তৃতীয় বিশ্বে কখনো ঘটেনি। তৃতীয় বিশ্বের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রসমূহ বিভিন্নভাবে অর্থনৈতিক শোষণ অব্যাহত রাখে।
২. আর্থিক সহায়তা ও ঋণ প্রদান: বিভিন্ন ক্ষেত্রে তৃতীয় বিশ্বের ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র আর্থিক সাহায্য এবং ঋণ প্রদান করে। ঋণগ্রহণের সময় তৃতায় বিশ্ব কঠিন শর্তে আবদ্ধ হয়ে পড়ে, যা থেকে তারা কখনো মুক্ত হতে পারে না। যেসব দেশ এ সহায়তা ও ঋণ গ্রহণ করে তারা ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে কোনো কথা বলতে পারে না। এভাবে কৌশলগতভাবে নব্য উপনিবেশবাদে শোষণ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে।
৩. খাদ্য সাহায্য প্রদান: তৃতীয় বিশ্বে ব্যাপক দারিদ্র্যের কারণে উন্নত বিশ্বের খাদ্য সাহায্য গ্রহণ করতে হয়। বিশ্বে প্রতিবছর চার লাখ মানুষ অনাহারে এবং অর্ধাহারে মৃত্যুবরণ করে। খাদ্য সাহায্য গ্রহণের বিনিময়ে সরকারকে প্রতিকূল শর্তে চুক্তিবদ্ধ হতে হয়। এছাড়া উন্নত বিশ্ব খাদ্য সাহায্যের নামে সাধারণ জনগণের সহানুভূতি লাভের সুযোগ গ্রহণ করে।
৪. মুক্ত বাজার অর্থনীতি: সমগ্র বিশ্বে মুক্ত বাজার
অর্থনীতির প্রচলন করেছে নব্য উপনিবেশবাদীরা তাদের উৎপাদিত পণ্যের অবাধ সরবরাহের লক্ষ্যে। এতে তৃতীয় বিশ্বের উৎপাদিত পণ্যের বাজার নষ্ট হয় এবং উন্নত বিশ্বের উৎপাদিত পণ্য সে বাজার দখল করে। পরবর্তীতে তাদের মাঝে বাজার সৃষ্টির হীন উদ্দেশ্য সাধন করা হয়।
৫. পণ্য সাহায্য: তৃতীয় বিশ্বে বিভিন্ন ধরনের পণ্য সাহায্য প্রদান করে উন্নত বিশ্ব। সেসব পণ্যের প্রতি মানুষের আকর্ষণ সৃষ্টি করে পরবর্তীতে তাদের মাঝে বাজার সৃষ্টির হীন উদ্দেশ্য সাধন করা হয়।
৬. প্রকল্প সাহায্য: উন্নত বিশ্ব তৃতীয় বিশ্বে প্রকল্প সাহায্যের নামে উন্নয়ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে। প্রকল্প সাহায্য প্রদানের বিনিময়ে তারা তৃতীয় বিশ্বকে কঠিন শর্তে আবদ্ধ করে। এর মধ্য দিয়ে উপনিবেশবাদের মূল লক্ষ্য অর্থনৈতিক শোষণ অব্যাহত রাখা হয়। প্রকল্প সাহায্যের মাধ্যমে তারা নিজেদের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি বজায় রাখার সুযোগ পায়।
৭. বহুজাতিক সংস্থা: বহুজাতিক সংস্থা গড়ে তোলার মাধ্যমে ঔপনিবেশিক শক্তিসমূহ নিজেদেরকে আরও শক্তিশালী ভিত্তির উপর দাঁড় করার এবং তৃতীয় বিশ্বকে বেশি করে শোষণের সুযোগ লাভ করে।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায়, নব্য উপনিবেশবাদের মূলত কৌশলগতভাবে তৃতীয় বিশ্বের উপর শোষণ ও কর্তৃত্ব বজায় রাখা হয়। এর মধ্য দিয়ে তৃতীয় বিশ্বে ক্রমান্বয়ে উন্নত বিশ্বের উপর নির্ভরশীল হয়ে উঠছে এবং নিজস্ব শক্তি ও সামর্থ্যকে হ্রাস করে তুলছে। নব্য উপনিবেশবাদ হলো এক ধরনের নতুন পরিস্থিতি যেখানে নতুন কৌশলের মাধ্যমে পূর্বের সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, নিজের আধিপত্য ও শোষণ অব্যাহত রাখার চেষ্টা করে।