সাম্রাজ্যবাদের উদ্ভব ও বিকাশের কারণ
ভূমিকাঃ সাম্রাজ্যবাদের উদ্ভব ও বিকাশের অনেক কারণ রয়েছে। তন্মধ্যে নিম্নিলিখিত কারণসমূহ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। যেমন-
১. অর্থনৈতিক সুবিধা অর্জন (Acquired of economical opportunities) : অর্থনৈতিক বাণিজ্যিক সুবিধা লাভ, কাঁচামাল ও উৎপাদিত পণ্যের বাজারের চাহিদা সাম্রাজ্যবাদের উৎসরূপে কাজ করেছে। সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠার পিছনে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি কাজ করেছে সেটি হলো অর্থনৈতিক সুযোগ সুবিধা অর্জন। এ বিষয়টি অষ্টাদশ, ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে সাম্রাজ্যবাদ প্রসারে প্রত্যক্ষ প্রেরণা যুগিয়েছিল।
২. ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য প্রসারণ (To extending colonial empire) : ইউরোপের উন্নত দেশসমূহকে সাম্রাজ্য বিস্তারে উৎসাহিত করেছিল শিল্পবিপ্লব ও অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের প্রসার। জাতীর মর্যাদা এবং আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রতীকে পরিণত হয়েছিল ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের প্রসার। ঐ সময়েই ইউরোপের সাম্রাজ্যাবাদী শাসনের অধীনস্থ হয় আফ্রিকার বিস্তীর্ণ অংশ। এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন অংশেও ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য প্রসারিত হয়।
৩. সভ্যতা বিকাশে (To develop civilization): বিশ্বের অনুন্নত অঞ্চলে সভ্যতার আলো পৌছে দিতে যথেষ্ট সাহায্য করেছে সাম্রাজ্যবাদ। সাম্রাজ্যবাদ যার ফলে ব্যাপক সমর্থন লাভ করেছে। সাম্রাজ্যবাদের বিস্তারে ফলে খুব দ্রুত উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। তাছাড়া বিভিন্ন কবি, সাহিত্যিক, লেখক, রাজনীতিবিদ সাম্রাজ্যবাদের জয়গান গেয়েছেন। বিশ্বের সর্বত্র এভাবে সাম্রাজ্যবাদের প্রসার ঘটেছে। উন্নয়নশীল দেশগুলো উত্তরোত্তর উন্নতির দিকে ধাবিত হয়েছে।
৪. নতুন বাজার সন্ধানে (To find new market): উৎপাদিত পণ্যের নতুন বাজারের সন্ধান এবং শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ও শক্তি সংগ্রহের জন্য শিল্পসমৃদ্ধ আস্ত র্জাতিক প্রতিযোগিতার আসরে অবতীর্ণ হয়। প্রতিটি রাষ্ট্র নিজের অর্থনেতিক স্থবিরতার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে নিজের বস্তুগত অধিকার বজায় এবং নতুন ভূখণ্ড দখলের জন্য সচেষ্ট হয়ে ওঠে। বিংশ শতকের শুরুতে পৃথিবীর অর্ধেক ভাগ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির করতলগত হয়।
৫. সামরিক কারণ (Military cause): সামরিক স্বাধীনতা অর্জন সাম্রাজ্যবাদের উদ্ভব ও বিকাশের অন্যতম কারণ। নিজের স্বার্থ ও যুদ্ধের প্রয়োজনে সকল সাম্রাজ্যবাদী শক্তি সাম্রাজ্যভুক্ত জনবলকে ব্যবহার করেছে। মধ্যপ্রাচ্যে ইংরেজদের সামরিক প্রাধান্য বজায় রাখার জন্য ইংরেজ সরকারকে ভারতীয় এবং নেপালি গুর্খা বাহিনীর উপর নির্ভর করতে হয়েছিল। এভাবেই সাম্রাজ্যবাদী শক্তি কোনো উপনিবেশের অধিবাসীদের নিয়ে গঠিত সেনাবাহিনীকে অন্য উপনিবেশের জনসাধারণের জন্য ব্যবহার করেছে।
৬. পুঁজি রপ্তানি (Capital export): পুঁজি রপ্তানি সাম্রাজ্যবাদ উদ্ভব ও বিকাশের অন্যতম কারণ। পুঁজিবাদের একচেটিয়া পর্যায়ে বা সাম্রাজ্যবাদের যুদ্ধে আর্থিক পুঁজির মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় পুঁজি রপ্তানি। এ উদ্দেশ্যে পুঁজি রপ্তানির মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদ অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য গড়ে তোলে।
৭. উদ্বৃত্ত জনগণকে পুনর্বাসিত করার জন্য (For rehabilitate to surplus people): নিজ দেশের উদ্বৃত্ত জনগণকে অন্য অংশে পুনর্বাসিত করার প্রচেষ্টা থেকে সাম্রাজ্যবাদের উদ্ভব হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। কিন্তু এ মতকে অনেকেই অস্বীকার করেছেন। যুক্তিস্বরূপ তারা বলেছেন, এ ফ্রান্সের উদ্বৃত্ত জনসংখ্যা না থাকা সত্ত্বেও ফরাসি সাম্রাজ্যের প্রসার ঘটেছিল। জার্মানি তার জনসংখ্যার সামান্য অংশকে সাম্রাজ্যে বসবাস করার জন্য ব্যবহার করেছিল।
৮. রাজনৈতিক অধিকার গ্রহণ (Reciept of political right): রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য সাম্রাজ্যবাদী কর্তৃত্ব অধিকৃত এলাকার জনগণের উপর নির্যাতন চালায় এবং অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে হত্যা করে। অন্যের রাষ্ট্র দখল করে। নিজেদের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা এবং ঐ দেশের অর্থনৈতিক অধিকার হরণ করা সাম্রাজ্যবাদ উদ্ভব ও বিকাশের অন্যতম প্রধান কারণ।
৯. ধর্মের ভূমিকা (Rule of religion): সাম্রাজ্যবাদের প্রসারে ধর্মপ্রচারের ইন্ধন যুগিয়েছে। ফরাসি ও পর্তুগিজ ধর্মযাজকেরা তাদের স্ব-স্ব দেশের সাম্রাজ্য বিস্তারের ক্ষেত্রে একটি স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। প্রকৃতপক্ষে, ধর্মীয় প্রচারের অন্ত রালে তারা সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থকে বজায় রাখার চেষ্টা করেছেন।
১০. সার্বিক দিক নিয়ন্ত্রণ (Control of whole side): সাম্রাজ্যবাদী শক্তির স্বার্থরক্ষার্থে সাম্রাজ্যবাদী দেশ তার অধিকৃত এলাকার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে। সাম্রাজ্যবাদের উদ্ভব ও বিকাশের অন্যতম একটি কারণ এটি এবং আরেকটি কারণ হলো সংশ্লিষ্ট এ এলাকার জনগণকে অবহেলা করা।
১১. মহাজনি মূলধনের সৃষ্টি (Creatiions of owner's capital): সাম্রাজ্যবাদ বিকাশের অন্যতম কারণ মহাজনি মূলধনের সৃষ্টি। অর্থাৎ, শিল্পের কেন্দ্রীভূত পুঁজির সাথে ব্যাংকের পুঁজির মিলন হয় এবং তাতে করে এ মহাজনি মূলধনের সৃষ্টি হয়। এসব মহাজনি মূলধনের মালিকানা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির হাতেই থাকে।
১২. অন্য রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ (Control of other state): অন্য রাষ্ট্রকে দখল করে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে এনে বিভিন্ন রকমের সুযোগসুবিধা লাভ করাও একটি অন্যতম কারণ। অন্যের রাষ্ট্র দখল বিরাট এলাকা জুড়েও হতে পারে আবার ক্ষুদ্র এলাকা জুড়েও হতে পারে।
সাম্রাজ্যবাদের শ্রেণিবিভাগ (Classification of imperialism)
সাম্রাজ্যবাদের দু'টি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। যথা: পুরাতন সাম্রাজ্যবাদ এবং নতুন সাম্রাজ্যবাদ। তবে সাম্রাজ্যবাদের এ শ্রেণিবিভাগ তিনটি স্তর বা পর্যায়ে আলোচনা করা যেতে পারে যা নিম্নরূপ-
প্রথম স্তর (First stage): ষোড়শ শতাব্দীর শুরু থেকে ১৭৬৩ সাল পর্যন্ত। এ স্তরে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বণিক বৃত্তির (Mercantilism) জাতীয় রাষ্ট্রের উদ্ভব এবং ধর্মীয় মতদ্বৈততা ও খ্রিস্টান মিশনারিদের কর্মকাণ্ডের প্রসার ঘটে। ইউরোপীয় শক্তিসমূহের কাছে এর ফলে এরা বিশ্বের দ্বারা উন্মুক্ত হয়। ব্রিটেনেই সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসেবে বেশি লাভবান হয়। যুদ্ধবিগ্রহ ও ঔপনিবেশ স্থাপনের মাধ্যমে পৃথিবীর অনেক অঞ্চল বিদেশি শাসন ও শোষণের অধীনস্থ হয়।
দ্বিতীয় স্তর (Second Stage): ১৭৩৬ সাল থেকে ১৮৭০ সাল পর্যন্ত। এ স্তরে শিল্প বিপ্লব, অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যের প্রসার ইউরোপের উন্নত দেশগুলোতে সাম্রাজ্য বিস্তারে উৎসাহিত করে। সাম্রাজ্যের প্রসারকে জাতীয় মর্যাদা ও আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রভাবক মনে করা হয়।
তৃতীয় স্তর (Third stage): ১৮৭০ সাল থেকে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত। এ স্তরের প্রথমার্ধে আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে অতি দ্রুত সাম্রাজ্যবাদের প্রসার ঘটতে থাকে। মূলত শিল্পসমৃদ্ধ পশ্চিমা দেশগুলো স্বীয় অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষার্থে বিশ্বের বিভিন্ন এলাকায় অধিকার রক্ষার জন্য তৎপর হয়ে ওঠে। বিশ্বের অনেক রাষ্ট্র বিংশ শতাব্দীর সাম্রাজ্যবাদী শক্তির করতলগত হয়।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সাম্রাজ্যবাদী দেশসমূহের মধ্যে গ্রেট ব্রিটেন, স্পেন, পর্তুগাল, জার্মানি, ফ্রান্স, জাপান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস-এর নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। উনবিংশ শতাব্দীর শেষে পৃথিবীর অর্ধেক ভূখণ্ড এদের অধীনে ছিল। গ্রেট ব্রিটেনের ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যই ছিল বৃহত্তম। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বর্তমান প্রেক্ষাপটে বড় শক্তিগুলো একটি দেশ দখল করে সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটাতে পারে না বটে তবে নতুন আঙ্গিকে আধিপত্য বিস্তৃত হচ্ছে।