মানুষের চেতনা তার সত্ত্বাকে নির্ধারণ করে না, বরঞ্চ সমাজের সত্ত্বা তার চেতনাকে নির্ধারণ করে ব্যাখ্যা কর

মানুষের চেতনা তার সত্ত্বাকে নির্ধারণ করে না, বরঞ্চ সমাজের সত্ত্বা তার চেতনাকে নির্ধারণ করে ব্যাখ্যা কর

মানুষের চেতনা নয়, সমাজের সত্ত্বাই নির্ধারণ করে চিন্তাভাবনা – মার্ক্সবাদী দৃষ্টিভঙ্গি"

 ভূমিকাঃ বস্তুবাদী ইতিহাস চর্চার দ্বিতীয় মৌলিকনীতি অনুসারে সমাজে প্রচলিত ধ্যানধারণাগুলোসহ সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোও সর্বদা চরম বিশ্লেষণে বৈষয়িক জীবনের শর্তাবলি দ্বারা নির্ধারিত হয়। অন্যভাবে বলতে গেলে সামাজিক প্রশ্নে বস্তুবাদের প্রয়োগ থেকে এ সিদ্ধান্ত আসে যে, সমাজের বৈষয়িক জীবন তার আত্মিক জীবনকে নির্ধারণ করে। বস্তুবাদ বলে বস্তু বা বাস্তব জগৎ হলো মুখ্য আর মন বা চিন্তা হলো গৌণ। বাস্তব জিনিসগুলোর অস্তিত্ব ও তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক যেগুলো সম্পর্কে আমাদের ধ্যান, ধারণার ওপর নির্ভর করে না, আমাদের মন এবং মনোগত ধ্যানধারণাগুলো বরং বাস্তব জিনিসগুলোর পূর্বতন অস্তিত্ব ও পারস্পরিক সম্পর্কের ওপর নির্ভরশীল, সমাজের ক্ষেত্রে এর প্রয়োগের অর্থ দাঁড়ায় এই যে, সমাজে প্রচলিত সমস্ত ধ্যানধারণার উৎস হলো সমাজের বৈষয়িক জীবন, উল্টোটা নয়।


মানুষের চেতনা তার সত্ত্বাকে নির্ধারণ করে না, বরঞ্চ তার সমাজের সত্ত্বা তার চেতনাকে নির্ধারণ করে মার্কসের এই ধারণার ব্যাখ্যা: মার্কস লিখেছেন, "মানুষের সত্তা তার চেতনা দ্বারা নির্ধারিত হয় না বরং ঠিক বিপরীতভাবে মানুষের সামাজিক সত্তাই নির্ধারিত করে তার চেতনাকে।"

মাকসের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে স্তালিন লিখেছেন। "সমাজের বাস্তব জীবন মানুষের ইচ্ছা অনিচ্ছার বাইরে স্বাধীন ও স্বয়ংক্রিয় এবং সমাজের আধাত্মিক জীবনে এই বাস্তব সত্যেরই প্রতিচ্ছবি। সুতরাং সমাজের আধ্যাত্মজীবন গঠনের উৎস, সামাজিক ধারণা ও মতবাদ, রাজনৈতিক মতবাদ ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের উৎপত্তির সন্ধান করতে হবে এবং ধারণা, মতবাদ, অভিমত ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে নয়, বরং সে জীবন ব্যবস্থা ও সমাজ সত্তার প্রতিচ্ছবি হলো ঐ ধারণা মতবাদ, অভিমত ইত্যাদি সমাজের সেই বাস্তব জীবন ব্যবস্থা এবং সমাজ সত্তার মধ্যেই তার সন্ধান করতে হবে।"

এই বক্তব্য থেকে এটাই বেরিয়ে আসে যে, ঐতিহাসিক ঘটনাবলির চূড়ান্ত কারণসমূহ মানুষের ধ্যানধারণার পরিবর্তনের মধ্যে পাওয়া যাবে না, পাওয়া যাবে বৈষয়িক জীবনের শর্তাবলির পরিবর্তনের মধ্যে।

এঙ্গেলস্ তাই বলেছেন, "ইতিহাস সম্পর্কে পুরনো সব দৃষ্টিভঙ্গিরই ভিত্তি ছিল এই ধারণা যে, মানুষের পরিবর্তনশীল চিন্তাধারার মধ্যেই সব ঐতিহাসিক পরিবর্তনের মূল কারণ খুঁজতে হবে। কিন্তু মানুষের মনে ধারণা আসে কোথা থেকে সে প্রশ্ন তোলা হয়নি। প্রতিটি ঐতিহাসিক পর্বের ধ্যান-ধারণা খুব সহজে ব্যাখ্যা করা যায় জীবনযাত্রার অর্থনৈতিক অবস্থা দিয়ে এবং সেগুলো নির্ধারিত হয় সেই পর্বের সামাজিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক দিয়ে।"

কাজেই "সমস্ত সামাজিক পরিবর্তন ও রাজনৈতিক বিপ্লবের শেষ কারণের সন্ধান করতে হবে মানুষের মস্তিষ্কে নয়, চিরন্তন সত্য ও ন্যায় নির্ণয় কোনো ব্যক্তির উন্নততর অন্তর্দৃষ্টির মধ্যে নয়, উৎপাদন পদ্ধতি ও বিনিময়ের ধরনের পরিবর্তনের মধ্যে। প্রচলিত সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো অনৈতিক ও অন্যায় যুক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে অযুক্তি এবং ন্যায় অন্যায় তা কেবল এটাই প্রমাণ করে যে উৎপাদন পদ্ধতিতে ও বিনিময়ের ধরনে অলক্ষ্যে এমন পরিবর্তন ঘটে গেছে যাতে পূর্বতন অর্থনৈতিক অবস্থার উপযোগী সমাজব্যবস্থাটা আর খাপ খাচ্ছে না।"


উদাহরণস্বরূপ আমাদের পূর্বপুরুষদের মনে সব মানুষই সমান এবং সকলেরই সমান অধিকার ভোগ করা উচিত এই ধারণার উদয় হয়েছিল বলেই তারা হীনতাব্যঞ্জক সামন্ততান্ত্রিক সম্পর্ক উচ্ছেদ করেছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করে কেন এই ধারণা এত প্রভাবশালী হয়ে পড়ল? শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যে হীনতাব্যঞ্জক সামন্ততান্ত্রিক সম্পর্ক ন্যায়সংগত ও যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছিল যে সম্পর্ক হঠাৎ কেন অন্যায় ও অযৌক্তিক বলে মনে হতে লাগল? এসব প্রশ্ন আমাদের ধ্যানধারণার জগৎ থেকে বৈষয়িক জীবন সংক্রান্ত শর্তাবলির জগতে নিয়ে যায়। বৈষয়িক ও আর্থিক জীবন পরিবর্তিত হচ্ছিল বলেই লোকে নতুন পথে চিন্তা করা শুরু করেছিল। প্রচলিত সামন্ততান্ত্রিক সম্পর্ক বিকাশমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে আর কোনোমতেই খাপ খাচ্ছিল না। অর্থনৈতিক কাজকর্মের আর সম্পর্কের বিকাশ নতুন। নতুন সামাজিক শক্তির জন্ম দিয়েছিল এবং তারাই সামন্ততন্ত্রকে উচ্ছেদ করে পুঁজিবাদের জমি প্রস্তুত করেছিল। আর সেই জন্যই বৈষয়িক জীবনের শর্তাবলির পরিবর্তনকে অনুসরণ করে ও প্রতিফলিত করে সামন্ততান্ত্রিক বৈষম্য বিরোধী অধিকারের সাম্য সংক্রান্ত ধারণার উদ্ভব ও প্রসার হয়েছিল।

আবার পুঁজিবাদ যখন একবার প্রতিষ্ঠিত হলো তখন হঠাৎ করে কেন সমাজতন্ত্র সম্পর্কে ও উৎপাদনের উপকরণের উপর সামাজিক মালিকানা সম্পর্কে ধারণা প্রভাবশালী হয়ে পড়ল।

শতাব্দীর পর শতাব্দী ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে কেবল ন্যায়সংগত ও যুক্তিযুক্ত বলেই নয় এমন কি সভ্য সমাজের আবশ্যিক ভিত্তি হিসেবেও গণ্য করা হয়েছিল। কিন্তু এখন একে ঠিক উল্টোটা অর্থাৎ অন্যায় অযৌক্তিক ও অত্যাচারী বলতে লাগল। এবারও নতুন আর্থিক পরিস্থিতি থেকেই এই নতুন চিন্তাধারার জন্য হয় এবং তার ফলেই সমাজতান্ত্রিক ধ্যানধারণা গভীর প্রভাব ফেলতে শুরু করে। পুঁজিবাদের অধীনে উৎপাদন ক্রমেই ব্যক্তিগত সম্পত্তি ভিত্তিক ব্যক্তিগত অধিকরণ ব্যবস্থা উৎপাদনের নয়া চরিত্রের সঙ্গে আর সংগতি রেখে চলতে পারছিল না।

সাধারণভাবে বলতে গেলে, যেহেতু ধ্যানধারণার উৎপত্তি এবং তাদের সামাজিক প্রভাবের উৎসেরও সবসময় ব্যাখ্যা দেওয়া প্রয়োজন সেহেতু সামাজিক পরিবর্তনসমূহের ব্যাখ্যা হিসেবে নয়া ধ্যানধারণার উদ্ভবকে যথেষ্ট বলে কখনোই গণ্য করা যায় না। আর অন্তিম বিশ্লেষণে তারও ব্যাখ্যা খুঁজতে হবে সমাজের বৈষয়িক জীবনের শর্তাবলির মধ্যে।

ফলে বিভিন্ন যুগে সমাজের বৈষয়িক জীবনের বিভিন্ন শর্তাবলির অনুসারী সম্পূর্ণ ভিন্ন ধ্যানধারণা প্রচলিত থাকে এবং বিভিন্ন শ্রেণির অভিমতের পার্থক্য শেষ বিচারে বৈষয়িক জীবনের শর্তাবলির পার্থক্য দিয়েই ব্যাখ্যা করতে হয়। মার্কস এঙ্গেলস প্রশ্ন তুলেছিলেন, "মানুষের বৈষয়িক অস্তিত্বের অবস্থা সামাজিক সম্পর্ক ও সমাজ জীবনের প্রতিটি পরিবর্তনের সঙ্গে তার ধারণা, মতামত ও বিশ্বাস এক কথায় মানুষের চেতনা যে বদলে যায় এ কথা বুঝতে কি গভীর অন্তর্দৃষ্টি লাগে?"


স্তালিন লিখেছেন, "মানুষ যদি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে ও ইচ্ছায় উদ্বুদ্ধ হয়ে থাকে তাহলে তার কারণ হলো এই যে, মানুষ তার প্রয়োজন চরিতার্থ করার জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উপায়ে প্রকৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে এবং সেই অনুযায়ী তার অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করেছে। এমন এক সময় ছিল যখন মানুষ সমষ্টিগতভাবে, আদিম সাম্যবাদের ভিত্তিতে প্রকৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে। সেই সময় তাদের সম্পত্তি ছিল সাম্যবাদী সম্পত্তি। পরবর্তীতে সম্পত্তি ব্যক্তিগত চরিত্র পরিগ্রহ করল, আর তাই মানুষের চেতনায় ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণা ব্যাপ্ত হলো। বর্তমানে যখন উৎপাদন আবার সামাজিক চরিত্র পরিগ্রহ করেছে এর ফলে সম্পত্তি শীঘ্রই সামাজিক চরিত্র পরিগ্রহ করবে এবং ঠিক এ কারণেই মানুষের চেতনা সমাজতন্ত্রের উদ্দেশ্য ক্রমশই সঞ্জীবিত হয়ে উঠেছে। প্রথমে বাস্তব অবস্থা বদলায় এবং তারপর মানুষের চিন্তা, তার অভ্যাস, রীতিনীতি ও

বিশ্ববীক্ষা অনুযায়ী বদলায়। সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামোই সব সময়ের জন্য সমাজের ভিত্তি যার ওপরে ও যাকে কেন্দ্র করে সামাজিক অভিমত ও প্রতিষ্ঠানগুলো বেড়ে ওঠে। অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন যে হচ্ছে নতুন অভিমত ও নতুন প্রতিষ্ঠানের উদ্ভব সর্বদা তারই প্রতিফলন।


উপসংহার: অতএব "সামাজিক ইতিহাসের বিভিন্ন যুগে আমরা বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান দেখতে পাই। আমরা দাস ব্যবস্থার সমাজ এক বিশেষ ধরনের সামাজিক ভাবধারা, দৃষ্টিভঙ্গি ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান দেখি আবার সামন্ত সমাজব্যবস্থায় অন্যরকম এবং সত্তা, জীবনযাত্রা পদ্ধতির যে ব্যবস্থা তদনুসারে সেই সমাজের চিন্তা, ভাবাদর্শ, রাজনৈতিক ধারণা ও প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে।"

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post