মার্কসীয় সমাজবিজ্ঞান কি? মার্কসবাদ কী? মার্কসবাদ একটি বিশ্ব বিক্ষণ ব্যাখ্যা কর

মার্কসীয় সমাজবিজ্ঞান কি? মার্কসবাদ কী? মার্কসবাদ একটি বিশ্ব বিক্ষণ ব্যাখ্যা কর

মার্কসীয় সমাজবিজ্ঞান ও মার্কসবাদ কী?

অথবা, মার্কসীয় সমাজবিজ্ঞানের সংজ্ঞা দাও।


ভূমিকাঃ  সমাজতত্ত্বের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব হলেন কার্ল মার্কস (Karl Marx)। বিগত এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে তাঁর দর্শন ও শিক্ষা চিন্তার জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এ সময়টাতে অনেক চিন্তাবিদ ও মনীষী কার্ল মার্কসের তত্ত্বের প্রতি সমর্থন প্রদান করেছেন, আবার অনেক সমাজতাত্ত্বিক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মার্কসের বক্তব্যকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তবে মার্কসের তত্ত্ব পৃথিবীর শোষণ মুক্তির ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় দলিল। মার্কস সমাজ বিকাশের যে নতুন বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেছেন তা সমাজবিজ্ঞানের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তিনি শুধু সমাজ বিকাশের বৈজ্ঞানিক সূত্র ও মানুষ কর্তৃক মানুষের শোষণের আলোচনায় সীমাবদ্ধ ছিলেন না বরং তিনি কীভাবে জনগণের দারিদ্র্য ও শোষণের অবসান ঘটবে। তারও পথনির্দেশ করেছেন। মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী কার্ল মার্কসের অবদান সমাজবিজ্ঞানে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা বুঝাতে তিনি মার্কসকে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে গ্যালিলিওর অবস্থানের সমতুল্য হিসেবে সমাজচিন্তার বিজ্ঞানে তাকে প্রতিস্থাপনের কথা বলেছেন।


মার্কসীয় সমাজবিজ্ঞান (Marxist Sociology): মার্কস যদিও কোনো সমাজতত্ত্ব রচনা করতে চাননি, তবে অর্থব্যবস্থার সমালোচনার মধ্য দিয়ে মার্কসীয় সমাজতত্ত্বের সৃষ্টি হয়। মার্কসীয় সমাজতত্ত্ব বলতে সাধারণত সমাজতত্ত্বের সেই শাখাকে বুঝায় যা মার্কসবাদ নিয়ে বস্তুনিষ্ঠভাবে পর্যালোচনা করে। অর্থাৎ সমাজবিজ্ঞানের যে শাখায় মার্কসবাদ নিয়ে আলোচনা করা হয় তাকে মার্কসীয় সমাজবিজ্ঞান বলে।


বিকাশের পর্বগুলো নিম্নরূপ: মার্কসীয় সমাজবিজ্ঞানের উৎপত্তি ও বিকাশ ঘটেছে মূলত কয়েকটি পর্বের মাধ্যমে। এই পর্বগুলো মার্কসীয় সমাজবিজ্ঞান বুঝতে বিশেষভাবে সহায়তা করে। মার্কসীয় সমাজবিজ্ঞান


ক. উন্মেষ পর্ব,

খ. সুবর্ণযুগ (উনিশ শতকের শেষ হতে ১৯১৪ পর্যন্ত),

গ. গোঁড়া মার্কসীয় সমাজতত্ত্ব পর্ব (১৯১৪-১৯১৭),

ঘ. অন্ধকারাচ্ছন্ন পর্ব (১৯৩০ - ১৯৫০),

৬. মার্কসীয় সমাজতত্ত্বের পুনর্জাগরণ পর্ব (১৯৫০)।

মার্কসীয় সমাজবিজ্ঞানের উন্মেষ পর্ব থেকে শুরু করে পুনর্জাগরণের পর্যন্ত বিভিন্নভাবে বিভিন্ন আঙ্গিকে মার্কসবাদ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। এই আলোচনার ও মার্কের তত্ত্ব নিয়ে বিশ্লেষণের ফলাফল হিসেবে মার্কসীয় সমাজবিজ্ঞানের উৎপত্তি ও বিকাশ ঘটেছে।


প্রামাণ্য সংজ্ঞা: মার্কসীয় সমাজবিজ্ঞান সম্পর্কে বিভিন্ন মনীয়ী ও সার্শনিক তাদের গুরুত্বপূর্ণ মতামত প্রকাশ করেছেন। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি সংজ্ঞা উপস্থাপন করা হলো।


Ashley  Crossman এর মতে, "Marxist sociology blends Marxism and sociology, focusing of karl marx's  concern with political economy and the power of capitalism to shape social life and in particular, various forms of social oppression. অর্থাৎ, মার্কণীয় সমাজবিজ্ঞান মার্কসবাদ ও সমাজবিজ্ঞানের সমন্বসাধন করে কার্ল  মার্কসের পলিটিক্যাল ইকোনমি (Political economy) এবং সমাজ গঠনে এবং সামাজিক শোষণের ক্ষেত্রে ধনতন্ত্রের শক্তি সম্বন্ধীয় বিষয়গুলোর প্রতি দৃষ্টিপাত করে।


মার্কসীয় সমাজতত্ত্ব সম্পর্কে Korsch বলেন, "The hard core of Marxist social analysis consists in the studies of forms of economic, structure and change and of classes, class consciousness and conflicts, tried to specific circumstance according to the principle of historical specificity," অর্থাৎ, মার্কসবাদের মূল আলোচনা নিহিত রয়েছে অর্থনীতি, কাঠামো ও পরিবর্তন এবং শ্রেণিসমূহ, শ্রেণি সচেতনতা এবং সংঘর্ষ, ঐতিহাসিক নীতির আলোকে বিশেষ অবস্থার বর্ণনার মধ্যে নিহিত রয়েছে।


উপসংহার: আলোচনার পরিশেষে বলা যায় যে, মার্কসীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজবিজ্ঞানের অধ্যয়ন হলো মার্কসীয় সমাজবিজ্ঞান। শোষক ও শোষিত শ্রেণির মধ্যে তীরূপ দ্বন্দ্ব বিরাজমান এবং সমাজব্যবস্থাতে এর প্রভাব নিয়ে মার্কসীয় সমাজবিজ্ঞানের বিকাশ ও পথচলা। বর্তমানে সমাজবিজ্ঞানের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো এই মার্কসীয় সমাজবিজ্ঞান। সমাজে বিরাজমান শ্রেণি শোষণ বুঝতে সমাজবিজ্ঞানের এ ধারণাটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।



মার্কসবাদ বলতে কী বুঝ?

অথবা, মার্ক্সবাদ একটি বিশ্ব বিক্ষণ-ব্যাখ্যা কর।

ভূমিকা: পৃথিবীর শোষণ মুক্তির ইতিহাসে

মার্কস আজো অবিস্মরণীয়। তিনি শুধু তাত্ত্বিকই ছিলেন তিনি স্বয়ং বহু শ্রমিক আন্দোলনের অংশীদার ছিলেন। মার্কসকে পৃথিবীর গণআন্দোলনের প্রেরণাদাতা বলে গণ্য করা যায়। তিনি তাঁর তত্ত্বে প্রথম আন্তর্জাতিক সংখ্যার মধ্য দিয়ে সমগ্র পৃথিবীর শ্রমিক শ্রেণিকে শোষণ মুক্তির আন্দোলনে শামিল করার জন্য প্রয়াসী হন।


মাকর্সবাদ (Marxism): মার্কস তাঁর ধ্যানধারণা ও শিক্ষামালা যে সুসংহত তত্ত্বে গড়ে তোলেন, তাই মার্কসবাদ (Marsxism) নামে খ্যাত। লেনিনের ভাষায়, 'মার্কসবাদ হলো মার্কবাদের এর দৃষ্টিভঙ্গি ও শিক্ষামালা।" (Marxism is the system of the views and teaching of marx.)


এমিল বার্নস তাঁর 'What is Marxism' পুস্তিকায় বলেন, মার্কসবাদ হলো আমাদের এ জৎতের এবং তারই অংশ মানবসমাজ সম্পর্কে সাধারণত তত্ত্ব। এর নামকরণ করা হয়েছে কার্ল মার্কসের নামানুসারে। মার্কস গ্রেডারিক এঙ্গেলস এর সাথে মার্জন এ তরফে অপান্তরিত করেন।


উনবিংশ শতাব্দীর চল্লিশের দশকে মার্কসবাদের উদ্ভব হয়। মানুষের চিন্তার ইতিহাসে এক অভিনব যুগ সন্ধিক্ষণে মার্কসবাদের চিন্তার ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ অবদান তাকে স্বীকার করে নিয়ে জন্ম। মানর যা কিছু প্রতি মার্কস মার্কসবাদের মূল প্রবতা কিন্তু তার এই তত্ত্ব সৃষ্টিতে বহু তাত্ত্বিকগণের সহযোগিতা রয়েছে। যেমন- ফ্রেডারিক এঙ্গেলস, লেনিন, স্টালিন এবং মাও সেতুং এর নাম বিশেষভাবে স্মরণীয়। মার্কসবাদ হলো একটি সমাজদর্শন।


মার্কসবাদের আবির্ভাবের পিছনে যেমন শিল্পবিপ্লব ও শিল্পবিপ্লব জগৎ, আর্থসামাজিক পরিবেশ দায়ী। ঠিক তেমনিভাবে প্রাকৃতিক ও বৈজ্ঞানিক পরিবেশের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।


ইতিহাসে বিশেষ করে অষ্টাদশ শতকের ফ্রালে মধ্যযুগীয় মার্কসীয় দর্শন একটি বস্তুবাদী দর্শন। আধুনিক ইউরোপের ধ্যানধারণা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যে কঠোর সংগ্রাম আরম্ভব হয় সেখানে বস্তুবাদকে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের শিক্ষার সাথে সমাজস্যপূর্ণ দর্শনতাপ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। মার্কস নিজেকেই কেবল অষ্টাদশ শতকের বস্তুবাদের মাধ্যে আবদ্ধ রাখেননি, তিনি তাকে আরো উচ্চতরে উন্নীত করেন।


উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, মার্কসবাদ নিছক একটা তত্ত্ব নয়। এটি কার্যের পথপ্রদর্শক। এটি একটি গতিশীল ধারা, যা নতুন নতুন অভিজ্ঞতা দ্বারা সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। মার্কসের দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ তত্ত্বটি মানবসমাজের পরিবর্তন ও অগ্রগতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এ তত্ত্বটি জগতের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রয়োগ ঘটানো যায়।

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post