বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবনী

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবনী

সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবনী

ভূমিকা: বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যিনি বাংলা সাহিত্যে “সাহিত্যসম্রাট” নামে খ্যাত, ছিলেন প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, কবি, সাংবাদিক এবং এক দক্ষ সরকারি কর্মকর্তা। বাংলা উপন্যাসের প্রথম সার্থক রচয়িতা হিসেবে আখ্যায়িত, তিনি বাংলা ভাষায় গদ্য সাহিত্যের আধুনিক বুকডেল গড়ে তুলেছেন ।


শৈশব ও পারিবারিক জীবন

জন্ম ও পরিবার:  ২৬ জুন (বিভিন্ন সূত্রে ২৬ বা ২৭ জুন) ১৮৩৮ সালে তিনি উত্তর ২৪ পরগনার নৈহাটিতে–কাঁঠালপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মেদিনীপুরে ডেপুটি কালেক্টরের দায়িত্বে কর্মরত। তিনি পরিবারের তৃতীয় সন্তান, এবং তাঁর দুই ভাই পূর্ণচন্দ্র ও সঞ্জীবচন্দ্রও সাহিত্যরুচির অধিকারী ছিলেন ।


প্রাথমিক শিক্ষা ও মেধাপাঁচ বছরের মধ্যে তিনি বাংলা বর্ণমালা আত্মস্থ করেছিলেন বলে জানা যায়, এবং পাঠশালায় না গিয়ে গৃহশিক্ষক থেকে শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে তৎকালীন শিক্ষাব্যবস্থায় দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। মেদিনীপুরে ইংরেজি স্কুলে ভর্তি হন জন এফ. টিড-এর পরামর্শে, যেখানে তিনি খুব শিগগিরই নিজের মেধা প্রমাণ করেন। পরবর্তীতে সিনক্লেয়ার-এর অধীনে দেড় বছর উচ্চমানের ইংরেজি শিক্ষা লাভ করেন ।


১৮৪৯ সালে তিনি কাঁঠালপাড়ায় ফিরে এসে বাংলা ও সংস্কৃত ভাষায় শ্রীরাম ন্যায়বাগীশের কাছে ও মহাভারত শ্রবণে পণ্ডিত হলধর তর্কচূড়ামণির পড়াশোনা করেন, যা তার গদ্য-শৈলীতে গভীর প্রভাব ফেলে ।


শিক্ষা ও মেধার বিকাশ

কলেজ জীবন ও প্রথম প্রকাশনা ১৮৪৯ সালে তিনি হুগলী মহসিন কলেজে ভর্তি হন; সেখানে তিনি ১৮৫৩ সালে জুনিয়র স্কলারশিপ পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন এবং মাসিক আট টাকা বৃত্তি লাভ করেন । কলেজে পড়ার সময় সংবাদ প্রভাকর ও সংবাদ সাধুরঞ্জন পত্রিকায় কবিতা ও গদ্য লিখে জনপ্রিয়তা পান । ১৮৫৬ সালে সিনিয়র বৃত্তি পরীক্ষায় বিশেষ কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন, এবং এখান থেকেই পদ্য গ্রন্থ ‘ললিতা তথা মানস’ প্রকাশিত হয়, যা তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ।

উচ্চ স্তরের শিক্ষা ও সরকারি চাকরি ১৮৫৬ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে আইন বিভাগে ভর্তি হন। ১৮৫৭ সালে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন এবং ১৮৫৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম ব্যাচে স্নাতক সমপন্ন করেন । ১৮৬৯ সালে আইন (LLB) ডিগ্রিও লাভ করেন। সরকারি কাজে যোগ দেন, প্রথমে যশোরে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট এবং পরবর্তীতে ডেপুটি কালেক্টর হিসেবে কর্মরত ছিলেন, অবসর নেন ১৮৯১ সালে ।


দাম্পত্য জীবন: 

প্রথম বিয়ে ১৮৪৯ সালে, ষোল–সতের বছর বয়সে, নারায়ণপুর গ্রামের একটি ছোট মেয়ের (মোহিনীদেবী) সঙ্গে হয়; কিন্তু তিনি তীক্ষ্ণভাবে মারা যান ১৮৫৯ সালে। এরপর ১৮৬০ সালের জুন মাসে রাজলক্ষ্মী দেবীর সঙ্গে পুনরায় বিয়ে সম্পন্ন হয় । তাদের কোনও পুত্র ছিল না, তিন কন্যা: শরৎকুমারী, নীলাজকুমারী ও উৎপলকুমারী।

সাহিত্য জীবনের অগ্রযাত্রা এবং রসায়ন

কাব্য থেকে গদ্য ও প্রথম উপন্যাস

তিনি শুরুতে কবিতা লিখছিলেন (“সংবাদ প্রভাকর” প্রভৃতি পত্রিকায় প্রকাশিত), এরপর ইংরেজিতে “Rajmohan's Wife” উপন্যাস লিখেন যা ১৮৬৪-এ প্রকাশিত হয়। ১৮৬৫ সালে তাঁর প্রথম বাংলা উপন্যাস ‘দুর্গেশনন্দিনী’ প্রকাশ পায়; এটি বাংলা ভাষায় প্রথম সার্থক উপন্যাস হিসেবে বিবেচিত হয় ।


অন্যান্য উপন্যাস ও প্রবন্ধতার পরের উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলির মধ্যে রয়েছে – কপালকুণ্ডলা (১৮৬৬), মৃণালিনী (১৮৬৯), বিষবৃক্ষ (১৮৭৩), ইন্দিরা (১৮৭৩), যুগলাঙ্গুরীয়া (১৮৭৪), চন্দ্রশেখর (১৮৭৫), রজনী (১৮৭৭), কৃষ্ণকান্তের উইল (১৮৭৮), রাজসিংহ (১৮৮২), আনন্দমঠ (১৮৮২), দেবী চৌধুরাণী (১৮৮৪), সীতারাম (১৮৮৭) 

প্রবন্ধের মধ্যে উল্লেখযোগ্য: *লোকরহস্য, বিজ্ঞানরহস্য, কমলাকান্তের দপ্তর, বিবিধ সমালোচনা, সাম্য, কৃষ্ণচরিত্র, বিবিধ প্রবন্ধ (১ম ও ২য় খন্ড), ধর্মতত্ত্ব, শ্রীমদ্ভাগবতগীতা* ইত্যাদি ।


আনন্দমঠ’ ও 'বন্দে মাতরম'

১৮৮২ সালে প্রকাশিত *আনন্দমঠ* উপন্যাসে প্রকাশিত *‘বন্দে মাতরম’* গানটি পরবর্তীতে ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতীকী স্লোগান ও ভারতীয় জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গ্রহণ করা হয় ।

'দেবী চৌধুরাণী’ অকুন্তিত প্রতীক'

১৮৮৪ সালে প্রকাশিত ‘দেবী চৌধুরাণী’ উপন্যাসে একজন শক্তিশালী নারী নেতার মাধ্যমে সংগ্রাম ও জাতীয়তাবাদ বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করার কারণে এটি নিষিদ্ধও হয়েছিল; স্বাধীনতা পর এটির বিধিনিষেধ উঠে যায় ।


শেষ জীবন বা অবসানকেন্দ্র

১৮৯১ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেন; আগ্রহী ছিলেন উচ্চশিক্ষা ও সাহিত্যচর্চায় অব্যাহত রাখতে। মহাপুরুষ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মৃত্যুর পর, তিনি Society for Higher Training প্রতিষ্ঠা করেন ও তার সাহিত্য শাখার সভাপতি হন। ১৮৯২ সালে “রায় বাহাদুর” খেতাব পান এবং ১৮৯৪ সালে “Companion of the Most Eminent Order of the Indian Empire” (CIE) খেতাবে ভূষিত হন।

পরলোকগমন: সার্কুলারি রোগ (ব্যথাপিড ও বহুমূত্র সমস্যা)–এর অবনতির ফলে ৮ এপ্রিল ১৮৯৪ সালে কলকাতায় তিনি পরলোকগমন করেন ।


উপসংহার ও সাহিত্যিক গুরুত্ব: এক কথায়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যের এক অগ্রদূত, যিনি কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ, তত্ত্বচর্চা সবখাতে অনবদ্য ভুমিকা রেখেছেন। তার সাহিত্যচর্চার গুরুত্ব দেখতে পাওয়া যায়—প্রথম বাংলা উপন্যাস, বাংলা গদ্যভাষার আদর্শ, ঐতিহাসিক ও সামাজিক চেতনার উন্মেষ, জাতীয় চেতনায় “বন্দে মাতরম”–এর উপস্থিতি এবং নারীর ক্ষমতায়নের প্রতীক “দেবী চৌধুরাণী” তে। সরকারি চাকরি ও লেখালেখির সংঘাতময় জীবনে তিনি অসাধারণ দূরদৃষ্টি, প্রাণ ও মেধা দিয়ে বাংলা ভাষাকে আধুনিকতার পথে রূপান্তরিত করেছেন। এই কারণে বাংলা সাহিত্যে নিষ্প্রয়োজনীয়ভাবে বৈশিষ্ট্যবাহী ও অনন্য, এবং আজও তিনি “সাহিত্য সম্রাট” নামে স্মরণীয় ।

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post