আদিম সমাজে ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিল না, সমাজব্যবস্থা ছিল সাম্যবাদী উক্তিটি ব্যাখ্যা কর

আদিম সমাজে ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিল না, সমাজব্যবস্থা ছিল সাম্যবাদী উক্তিটি ব্যাখ্যা কর

আদিম সমাজব্যবস্থার স্বরূপ আলোচনা কর।

আদিম সমাজব্যবস্থার শ্রেণি, সমাজ ও উৎপাদন ব্যবস্থা সম্পর্কিত ধারণার ব্যাখ্যা কর।

ভূমিকাঃ "আদিম সমাজে ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিল না, সমাজব্যবস্থা ছিল সাম্যবাদী।"-এ উক্তিটি আলোচনা করার পূর্বে আমাদের জানতে হবে ব্যক্তিগত মালিকানা এবং সাম্যবাদ বলতে কী বুঝায়। এগুলো আলোচনা করে এ আলোচনা থেকে উক্তিটির যথার্থতা পর্যালোচনা করতে হবে। ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিকানা বলতে কোনো বস্তুকে ভোগ ও হস্তান্তরের একক অধিকার বুঝায় এবং সাম্যবাদ বলতে বুঝায় কোনো বস্তুতে সম্প্রদায়গত অধিকার অর্থাৎ সমান অধিকার। সম্পত্তি হলো কোনো কিছুর মালিকানা যা ব্যক্তি উত্তরাধিকারসূত্রে বা অন্যান্য সূত্রে লাভ করে এবং যার উপর ব্যক্তির নিরঙ্কুশ অধিকার থাকে। সমাজবিজ্ঞানী এবং নৃবিজ্ঞানীদের মতে, সম্পত্তি হলো এমন একটি ব্যবস্থা, যা দ্বারা 'সম্পদের মালিকানা হস্তান্তর কার্যকে বুঝায়। আদিম সমাজে মানুষের জীবনধারণের জন্য যা প্রয়োজন হতো সবই তাদের সম্পত্তির আওতাভুক্ত ছিল। আদিম সমাজে সম্পত্তির নির্দিষ্ট কোনো রূপ ছিল না।

আদিম সমাজের সম্পত্তির মালিকানা (Ownership of property in primitive society): আদিম সমাজের মানুষ যা কিছু ব্যবহার করত তাই ছিল তাদের সম্পত্তি। তবে সমাজ বিকাশের প্রাথমিক পর্যায়ে প্রস্তর নির্মিতি হাতিয়ার ছিল তাদের প্রধান সম্পত্তি। তারপর পশু, কলকারখানা সম্পত্তিতে পরিণত হয়। আদিম সমাজে সম্পত্তির মালিকানা নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে মতবাদ রয়েছে। তার মধ্যে তিনটি মতবাদ বেশি প্রচলিত। যেমন- ১. মার্কসীয় মতবাদ; ২. অমার্কসীয় মতবাদ; ৩. মধ্যপন্থি মতবাদ।


১. মার্কসীয় মতবাদ: মার্কসীয় মতবাদের প্রবক্তা হলেন এল. এইচ মর্গান (L. H. Morgan)। মার্কসবাদীদের মতে, আদিম সমাজে সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানা ছিল না; সমাজব্যবস্থা ছিল সাম্যবাদী। এদের উৎপাদন ও যন্ত্রপাতির কারণে সমাজে সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। আদিম মানুষের জীবন ছিল যাযাবর প্রকৃতির। খাদ্য উৎপাদন করতে জানত না বলে তারা দলবদ্ধভাবে বসবাস করত, দলবদ্ধভাবে খাদ্যসংগ্রহ ও আহার করত। তাই ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভব হয় নি। সুতরাং আদিম সমাজে সম্পত্তির যৌথ মালিকানা ছিল।

২. অমার্কসীয় মতবাদ: এ মতবাদের প্রবক্তাদের মতে, আদিম সমাজে বস্তুতে যৌথ ও ব্যক্তিগত মালিকানা ছিল। উদাহরণস্বরূপ তারা দক্ষিণ আফ্রিকার টয়েলার দ্বীপপুঞ্জের আদিবাসীদের কথা বলেন। তারা দেখেছেন যে এ সমাজে কোন ব্যক্তি মারা গেলে তার ব্যবহৃত তীর ধনুক এবং অন্যান্য জিনিসপত্র মৃত ব্যক্তির সাথে সমাহিত করা হতো। কারণ এসব বস্তুর মালিক অন্য কেউ নয় সে নিজেই।

৩. মধ্যপন্থি মতবাদ: এ মতবাদের প্রবক্তা হলেন টি. বি. বটোমোর (T. B. Bottomore)। ম্যালিনোস্কি ও বটোমোরের মতে, 'আদিম সমাজে জীবনধারণের জন্য যেসব সম্পতির প্রয়োজন হতো তার তিন ধরনের মালিকানা বিদ্যামন ছিল। যেমন-

ক. এক শ্রেণির অদিম উপজাতির মধ্যে বণ্টন সাম্যবাদী প্রথায় নির্ধারিত হতো।

খ. এক শ্রেণির মধ্যে বণ্টন ব্যক্তিগত।

গ. এক শ্রেণির মধ্যে কোনো কোনো বস্তুতে যৌথ এবং কোনোটাতে ব্যক্তিগত মালিকানা বিদ্যমান ছিল।


সাম্যবাদী মতবাদ: সাম্যবাদী বিবর্তনবাদীদের মতে, আদিম সমাজে বাক্তিগত নয়, যৌথ মালিকানায় সাম্যবাদ প্রচলিত ছিল। আদিম সমাজ ছিল শ্রেণিহীন। সহযোগিতা ও সংহতির মাধ্যমে তারা একত্রে খাদ্যসল্লাহ করে সবার মাঝে তা সমভাবে বণ্টন করে দিত। তাদের জীবন ছিল হয় ভুরিভোজ না হয় উপবাস। তাই পরস্পর নির্ভরশীল এ সমাজের সম্পত্তিতে দলগত যৌথ অধিকার ছিল এটাই সাম্যবাদ। কিন্তু লোট এর তীব্র সমালোচনা করে বলেন, "আদিম শিকার যুগে শিকারের সময় শিকারীর জিনিস যার আগে চোখে পড়বে সেই ঐ জিনিসের মালিক হবে।" এ থেকে ব্যক্তিগত মালিকানার প্রমাণ মেলে। তাই আদিম সমাজে সম্পত্তির মালিকানা সম্পর্কে বিভিন্ন নৃবিজ্ঞানী বিভিন্ন মতামত দেন। নিচে তা আলোচনা করা হলো।


১. লৌঈ: তিনি আদিম সমাজে সম্পত্তির বিভিন্ন মালিকানা দেখিয়েছেন। তার মতে, এদের ভিতর পতিত জমি, রাস্তাঘাট ও পুকুর ইত্যাদিতে সামাজিক মালিকানা থাকলেও মাঠঘাট, ঘরবাড়ি, পশু ইত্যাদিতে পারিবারিক মালিকানা ছিল। তার মতে, কোনো কিছুতে সাম্যবাদ, কিছুতে ব্যক্তিগত মালিকানা ছিল। তাই তিনি আদিম সমাজের সম্পত্তিকে যৌথ সংহতিবাদ বলেন।


২. জিন্সবার্গ: জিন্সবার্গের মতে, আদিম সমাজের কোনো কোনো ক্ষেত্রে সম্পত্তিতে ব্যক্তিমালিকানা ছিল। যেমন কোনো ব্যক্তির ব্যবহৃত তীর, ধনুক, পোশাক পরিচ্ছদ, অলংকার একমাত্র তারই মালিকানাধীন ছিল।


৩. র‍্যাডক্লিফ ব্রাউন: তিনিও ব্যক্তিগত মালিকানার সপক্ষে যুক্তি দেন। উদাহরণস্বরূপ তিনি আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের লোকদের কথা বলেন। যেমন-কোনো ব্যক্তি একটি নৌকা তৈরির গাছ জঙ্গলে দেখে এসে তার প্রতিবেশীর সাথে তা আলাপ করলে গাছটি তার বলে বিবেচিত হবে। সে কখনো অনেকদিন পর্যন্ত ব্যবহার না করলেও কেউ তার বিনা অনুমতিতে গাছে হাত দিতে। পারবে না। এক্ষেত্রে ব্যক্তিগত মালিকানার প্রমাণ পাওয়া যায়।


৪. ফ্রাঞ্জ বোয়াস: বোয়াসের মতে, এমন কোনো সমাজ নেই, যেখানে ব্যক্তিগত মালিকানা অনুপস্থিত। বোয়াসের মতে, ঐ সমাজে মানুষ তার তৈরি হাতিয়ার ও বাসনপত্র যা বাবহার করত তা তার সম্পত্তি। এটি সে কাউকে দিতে পারে বা ধ্বাংস করতে পারে। কাজেই আদিম সমাজে ব্যক্তিগত মালিকানা বিদ্যমান ছিল।


৫. গোন্ডেল উঈগার: গোল্ডেন উইগারের মতে, ব্যক্তিগত সম্পত্তি মানুষের উৎপত্তির ইতিহাসের ন্যায়। তাই বস্তুগত এমনকি অবস্তুগত সম্পত্তি যেমন- সংগীত, মৃৎশিল্প, জাদুবিদ্যা ইত্যাদি।


৬. মর্গান: মর্গানের মতে, আদিম সমাজের প্রাথমিক পর্যায়ে সম্পত্তির ধারণা তেমন ছিল না। তাই তার মতে, আদিম সমাজে। ব্যক্তিগত মালিকানা প্রকট ছিল না। কিন্তু সমাজ ও সংস্কৃতি যতই আসর হতে লাগল, সম্পত্তির পরিমাণ ততই বৃদ্ধি পেতে থাকল। তিনি পরিবার প্রথার বিভিন্নতার সাথে বাক্তিগত মালিকানার কথা বলেন। তাই তিনি বলেন, একক পরিবারে বাক্তিগত এবং দলগত বা যৌথ পরিবারে দলগত মালিকানা ছিল। বিখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী ও অর্থনীতিবিদ কার্ল মার্কস আদিম সমাজ সম্পর্কে বলেন, "আদিম সমাজে ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিল না, সমাজব্যবস্থা ছিল সাম্যবাদী" মার্কস কোন আদিম সমাজকে সাম্যবাদী সমাজ বালেছেন তা জানাতে হলে আমাদেরকে আদিম সমাজের অর্থনীতি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে।


৭. স্টোর্ন: স্টোর্নের মতে, খাদ্যসংগ্রহের যুগে উদ্বৃত্ত উৎপাদন ব্যক্তিগত মালিকানার সূত্রপাত হয়। হতো না। ব্যবসায় বাজার চলত এক ধরনের প্রথা উপঢৌকনের বিনিময়ে। তাই পশু শিকার, ভূমি, জলাশয় ইত্যাদি সাম্প্রদায়িক মালিকানায় ছিল। যে কেউ তা ব্যবহার করতে পারত। পরবর্তীতে এসব কৃষ্টি অর্থনীতি পর্বে উৎপাদনের ফলে, কৃষিজমি চাষের ফলে


উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, আদিম সমাজে সাম্যবাী মালিকানা বেশি থাকলেও তার সাথে গোষ্ঠীগত, যৌথ, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত মালিকানার উপস্থিতি ছিল। আদিম সমাজের লোকেরা সবধরনের মালিকানাকে আংশিকভাবে গ্রহণ করলেও পুরোপুরি গ্রহণ করে নি। আমাদের আলোচ্য উক্তি আদিম সমাজে ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিল না, সমাজব্যবস্থা ছিল সাম্যবাদী: এটা পুরোপুরি মেনে নেওয়া না গেলেও আদিম সমাজে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাম্যবাদী আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত মালিকানা গ্রহণ করেছে বলে এটাই প্রমাণ হয়। আদিম সমাজ ছিল সাম্যবাদী ধারণায় উদ্ভূত।

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post