বিচ্ছিন্নতাবোধ উদ্ভব এর কারণসমূহ
ভূমিকাঃ বিচ্ছিন্নতাবোধের উদ্ভবের কারণ হিসেবে মার্কস যেসব কারণ উল্লেখ করেছেন সেগুলো নিচে আলোচনা করা হলো:
১. শ্রম, উৎপাদন ও শ্রমিকের সম্পর্ক: মানুষ প্রতিনিয়ত নিজ কাজে ব্যস্ত থাকে। কাজের মাধ্যমেই ব্যক্তিসত্তার বা প্রতিভার বিকাশ হয়। মার্কস বলেন, সভ্যতার চাবিকাঠি হলো শ্রম। পুঁজিবাদী সমাজে শ্রমিকরা উৎপাদন প্রক্রিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অথচ তাদের ন্যায্য অর্থনৈতিক সুযোগ সুবিধা প্রদানের পরিবর্তে অমানবিক শোষণ করা হয়। তাছাড়া উৎপাদিত পণ্যের মধ্যে শ্রমিক তার আত্মত্মপরিচয় খুঁজে পায় না। ফলে শ্রমের সকল পণ্য উৎপাদিত তার কাছে ভিন্ন সত্তা এবং অপরিচিত মনে হয়। অর্থাৎ পণ্যের সাথে শ্রমিকের কোনো সম্পর্ক থাকে না। ফলে তার মনে বিচ্ছিন্নতাবোধের জন্ম হয়।
২. বস্তুগত উৎপাদনে মানুষের আগ্রহ: সমাজের প্রতিটি উৎপাদন কাজে নিয়োজিত মানুষ বস্তুগত উৎপাদনে বেশি আগ্রহী। মানুষের চাহিদার শেষ নেই। মানুষ যে অবস্থানে আছে তা নিয়ে সে-সন্তুষ্ট নয়। ফলে মানুষ তার চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে বস্তুগত অবস্থার ন উন্নতি ঘটায়। এই প্রক্রিয়ার সাথে মানুষের মনস্তাত্ত্বিক গঠনের পরিবর্তন ন হয়। যখন ব্যক্তি তার উৎপাদিত পণ্য নিজে ব্যবহার করতে পারে না কিংবা সেই পণ্যের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা তার যাতে থাকে না তখনই ব্যক্তির মনে বিচ্ছিন্নতাবোধের জন্ম হয়।
৩. ক্রমাগত নিয়ন্ত্রণহীন উৎপাদন প্রক্রিয়া মানুষ ক্রমান্বয়ে উৎপাদন প্রক্রিয়া থেকে নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে। পুঁজিবাদী সমাজে মানুষ তার নিজের শ্রমের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারছে না। কেননা এ সমাজে মানুষ প্রায় সকল কাজেই যন্ত্র ব্যবহার করে। প্রাক পুঁজিবাদী সমাজে মানুষ প্রায় সকল কাজেই যন্ত্র ব্যবহার করে। প্রাক পুঁজিবাদী সমাজে মানুষ যন্ত্রই মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে। এতে করে শ্রমিকের মানবিক সন্তুষ্টি থাকে না। এ কারণেই শ্রমিকের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবোধের জন্ম হয়।
৪. উৎপাদন সংগঠনের প্রকৃতি: পুঁজিবাদী সমাজে প্রাথমিক পর্যায়ে উৎপাদন সংগঠনটি সরল ছিল। কিন্তু আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজে প্রযুক্তির উন্নতির ফলে সমাজে সহযোগিতা ব্যাপক পরিসরে ব্যাপ্তি লাভ করছে। যেমন একটি কারখানায় এখন হাজার হাজার শ্রমিক কাজ করে। ফলে সেখানে শ্রমবিভাজন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। এই শ্রমবিভাজনটা হয় শিক্ষা, জ্ঞান, দক্ষতা, বিশেষীকরণের ভিত্তিতে। সমাজে শ্রমবিভাজন বেড়ে যাবার ফলে মানুষ বিভক্ত হয়ে পড়ে। ফলে সমাজের মানুষের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবোধ জন্ম নেয়। - যেমন- পূর্বে একজন শ্রমিক সারাদিন পরিশ্রম করে ১০টি জুতা তৈরি করতো কিন্তু শ্রমবিভাজনের ফলে একটি কারখানাতে দিনে - হাজার হাজার জুতা তৈরি করা হচ্ছে। ফলে ঐ শ্রমিকের মনে বিচ্ছিন্নতাবোধের জন্ম নিচ্ছে।
৫. পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় মানুষের পূর্ণাঙ্গ বিকাশে বাধা: - মার্কসের মতে, "মানুষ পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে বিকশিত হবে এবং সমাজ সেই অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে দেবে। কিন্তু আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজ মানুষকে পূর্ণাঙ্গ হিসেবে বিকাশ প্রাপ্ত হতে বাধা দেয়, উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটি কারখানায় একজন এ শ্রমিকের একটি বিশেষ কাজ করতে হয় বিধায় তার প্রতিভার পূর্ণ । বিকাশ ঘটে না। এ জন্য শ্রমিকের মনে বিচ্ছিন্নতাবোধ জন্ম নেয়।
৬. শ্রমিকের ক্ষমতাহীনতা: শ্রমিকের ক্ষমতাহীনতার কারণেও শ্রমিকরা উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় ব্যক্তিমালিকানায় পণ্য উৎপাদিত হয়। অন্যভাবে বলা যায় উৎপাদনের উপকরণের মালিক সমাজের ৭ উৎপাদন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে। কোন কারখানায় কি পরিমাণ উৎপাদন হবে, শ্রমিকদের মজুরি কত হবে, বাজারে কতখানি পণ্য ব সরবরাহ করা হবে ইত্যাদি বিষয়াদি মালিক শ্রেণির দ্বারা নির্ধারিত হয়ে থাকে। উৎপাদন প্রক্রিয়া সম্পর্কে শ্রমিকদের কোনো কিছু বলার সুযোগ থাকে না। শ্রমিক শ্রেণির মতামতের কোনো মূল্য ল মালিক শ্রেণির কাছে না থাকায় নিজ স্বার্থবিরোধী উৎপাদন ব্যবস্থা ' থেকে শ্রমিকরা নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন বলে মনে করে। ফলে বিচ্ছিন্নতাবোধের জন্ম হয়।
৭. শ্রমিকের উপর অমানবিক শোষণ: সমাজে শ্রমিকদের টিউপর অমানবিক শোষণের ফলে তারা শুধু উৎপাদন ব্যবস্থা থেকেই বিচ্ছিন্ন হয় না, বরং উৎপাদিত দ্রব্য থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। কারণ শ্রমিক যে পণ্য উৎপাদন করে ঐ পণ্যের মালিক সে নয়। কেননা সামান্য মজুরির বিনিময়ে শ্রমিক তার শ্রম মালিকের কাছে বিক্রি করে। ফলে সে তার শ্রম হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। শ্রমিকের উপর পুঁজিপতিদের অমানবিক শোষণ শ্রম ও শ্রমিকের বিচ্ছিন্নতাকে স্থায়ী রুপদান করে এবং এর থেকে বিচ্ছিন্নতাবোধের উদ্ভব হয়।
৮. অর্থনৈতিক বিচ্ছিন্নতাবোধ: মার্কস বলেন, অর্থনৈতিক বিচ্ছিন্নতাবোধই সকল বিচ্ছিন্নতার কারণ। পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিশ্লেষণ মতে, বিচ্ছিন্নতাবোধের মূল কারণ হলো অর্থনৈতিক শোষণ। পুঁজিবাদী সমাজে শ্রম শোষণের ফলে শ্রমিক যে পরিমাণ। উৎপাদন করে সেই হারে পারিশ্রমিক পায় না। ফলে শ্রমিকের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবোধ জন্ম নেয়।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, মার্কসের বিচ্ছিন্নতাবোধের উদ্ভবে যে কারণগুলো কথা তার আলোচনায় বলেছেন তার মূল অনুষঙ্গগুলো হলো শ্রম, শ্রমিক, পুঁজিপতি, হ শ্রেণি শোষণ, জটিল উৎপাদন ব্যবস্থা, শ্রমিক শোষণ ইত্যাদি। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় এসব উপাদানগুলো সম্মিলিতভাবে বাস এককভাবে শ্রম, শ্রমিক ও উৎপাদন ব্যবস্থার মধ্যে উ বিচ্ছিন্নতাবোধের উদ্ভব ঘটে। বিচ্ছিন্নতাবোধ উদ্ভবের কারণ হিসেবে মার্কস যে কারণগুলো দেখিয়েছেন তা বর্তমান বি প্রেক্ষাপটেও উপযোগী। তাই এ সম্পর্কে মার্কসের ধারণা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়। আর বিচ্ছিন্নতাবোধ ও এর উদ্ভবের কারণ সমাজবিজ্ঞানের অধ্যয়নে গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়।