বিচ্ছিন্নতাবোধের সংজ্ঞা দাও। বিচ্ছিন্নতাবোধের শ্রেণিবিভাগ আলোচনা কর।
অথবা, বিচ্ছিন্নতাবোধ বলতে কী বুঝ? বিচ্ছিন্নতাবোধ কত প্রকার ও কী কী? আলোচনা কর।
ভূমিকাঃ সাম্প্রতিককালে সমাজবিজ্ঞান অধ্যয়নে একটি বহুল পরিচিত শব্দ হলো বিচ্ছিন্নতাবোধ। অনেক পাশ্চাত্য দার্শনিকই বিচ্ছিন্নতাবোধ প্রত্যয়টি ব্যাখ্যা করেছেন। তবে কার্ল মার্কসকে সমাজবিজ্ঞানের বিচ্ছিন্নতাবোধের জনক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সমাজবিজ্ঞানের অনুসন্ধানে মার্কস স্টেমস্কোপের মাতা বিচ্ছিন্নতাবোধ শব্দটি ব্যবহার করেন। মার্কস পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় শ্রমিকদের মধ্যেই বিচ্ছিন্নতাবোধ প্রত্যক্ষ করেন। তাঁর বিচ্ছিন্নতাবোধের ধারণাটি অক্ষমতার সাথে সম্পৃক্ত কেননা পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় শ্রমিকরা মনে করেন যে, এ সমাজব্যবস্থায় শ্রমিক তার জৈবিক ক্রিয়া ব্যতীত আর কোনভাবেই নিজেকে স্বাধীন মনে করে না। বিচ্ছিন্নতাবোধ আলোচনার ক্ষেত্রে মার্কস বিচ্ছিন্ন শ্রমের শ্রেণিবিভাগ করেন যা বিচ্ছিন্নতাবোধের প্রকারভেদেরই নামান্তর।
বিচ্ছিন্নতাবোধের ধারণা ও সংজ্ঞাঃ সাধারণভাবে বিচ্ছিন্নতাবোধ ব্যাখ্যা করতে হলে এমন একটি সামাজিক মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা বুঝাতে হয় যার ফলে সামাজিক মানুষ তার সামাজিক অস্তিত্বের কিছু ক্ষেত্র থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন অনুভব করে। অনাভাবে, বিচ্ছিন্নতাবোধ বলতে একটি প্রক্রিয়াকে বুঝায় যার মাধ্যমে একজন মানুষ তার নিজস্ব সত্তা এবং একই অন্য মানুষ থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়। সাথে
প্রামাণ্য সংজ্ঞা: বিচ্ছিন্নতাবোধকে বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী ও মনীষীগণ বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। বিচ্ছিন্নতাবোধের কয়েকটি সংজ্ঞা নিম্নে তুলে ধরা হলো।
মার্কসবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে, 'বিচ্ছিন্নতাবোধ হলো একটি ক্রিয়া যার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠান অথবা সমাজের কিছু বিষয় থেকে বিচ্ছিন্ন হয় বা বিচ্ছিন্ন থাকে।"
বিচ্ছিন্নতাবোধ সম্পর্কে Mitchel বলেন, "Alienation is a socio-psychological condition of the individual which involves his entrangement from certain aspect of his social existence (1979) অর্থাৎ বিচ্ছিন্নতাবোধ হলো ব্যক্তির একটি সামাজিক মানসিক অবস্থা যা তার সামাজিক অস্তিত্বের বিভিন্ন দিক থেকে তাকে পৃথক বা বিচ্ছিন্ন করে।
মনোয়ারের মতে, বিচ্ছিন্নতাবোধ হলো-
1. The action of estranging of state of estrangemeni/বিচ্ছিন্নতার ক্রিয়া বা বিচ্ছিন্নতার অবস্থা।
2. The action of transfering ownership to mother/এক ব্যক্তি থেকে অপর ব্যক্তিতে মালিকান। পরিবর্তনের ক্রিয়া।
3. Divention of anything to differunt purpose/বিভিন্ন উদ্দেশ্যে কোনো কিছুর বহুমুখিতাকরণ।
4. The state of being alienated বিচ্ছিন্নকরণের অবস্থা।
5. Loss of derangement of mental faculties, insanity মানসিক অবস্থার উন্নান অবস্থা বা বিশৃঙ্খলা।
বিচ্ছিন্নতাবোধের ধারণার মূল অর্থ হলো নিজেকে বিচ্ছিন্ন ভাবা বা পরিবেশ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন প্রবাসী করে রাখা ও অপরের কাছে দায়িত্ব হারিয়ে ফেলা। (মনোয়ার,১৯৮৩:৪৬)
বিচ্ছিন্নতাবোধ সম্পর্কে মার্কসের ধারণা সম্পর্কে বলতে গিয়ে অ্যারন বলেন, 'In Marxism, including the writings of young Marx, the process of alienation instead of being process which is philosophically or a sociological proces by means of which men or metaphysically nevitable, become the expression of cicbecool (Aron 1991 148) societies construct collective organizations in which they became lost. (Aron-1991:148)
পরিশেষে বলা যায় বিচ্ছিন্নতাবোধ হলো এমন প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে ব্যক্তি শুধু যে তার নিজস্ব সত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয় তা নয় বরং সে অন্য একজন মানুষের থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়। মানুষের সত্তা ও মানুযের মধ্যকার পার্থক্য অনুধাবনের ক্ষেত্রে সমাজবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা হলো বিচ্ছিন্নতা যা অতান্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রত্যয়।
বিচ্ছিন্নতাবোধের প্রকারভেদ (Types of alienation): মার্কস তাঁর The Economic and Philosophical Manuscript (1844) গ্রন্থে বিচ্ছিন্নতাবোধ ও শ্রমের শ্রেণিবিভাগ সম্পর্কে আলোচনা করেন। মার্কসের মতে, বিচ্ছিন্নতাবোধ প্রত্যয়টি কোনো মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার নয়। এটি একটি সামাজিক ব্যাগায়। পুঁজিবাদী সমাজের বৈষম্য ও শোষণের ফলশ্রুতি হিসেবে সমাজে বিচ্ছিন্নতাবোধ দেখা যায়। পুঁজিবাদী বিকাশের সাথে সাথে বিচ্ছিন্নতাবোধের ব্যাপ্তি বাড়তে থাকে এবং সমাজের একটি শ্রেণি এই বিচ্ছিন্নতাবোধ দ্বারা আক্রান্ত হয়। পুঁজিবাদী সমাজকে মার্কন বিচ্ছিন্নতাবোধ দ্বারা ব্যাখ্যা করেন। তাঁর মতে, বিচ্ছিন্নতাবোধের সাথে শ্রমিক শ্রেণির সম্পর্ক রয়েছে। এ জন্য এই তত্ত্বকে Theory of Alienated Labour বলা হয়ে থাকে।
মার্কসের বিচ্ছিন্ন শ্রম মূলত তিন প্রকারের। যথা ১. উৎপাদিত যন্ত্র হতে শ্রমিকের বিচ্ছিন্নতা, ২. উৎপাদন কর্মকাণ্ড হতে শ্রমিকের বিচ্ছিন্নতা এবং ৩. অন্যান্য মানুষের সাথে বিচ্ছিন্নতা।
১. উৎপাদিত যত হতে উৎপাদনকারীর বিচ্ছিন্নতা (Labour is alienated from his product) শ্রমিক মজুরির বিনিময়ে উৎপাদন করে। আর পুঁজিপতিরা শ্রমিকের উৎপাদন থেকেই মুনাফা করে সম্পদের পাহাড় গাড় তোলে। তাই শ্রমিক যত বেশি উৎপাদন করে পুঁজিপতির পুঁজি তত বেশি বাড়তে থাকে। একই সাথে শ্রমিক নিজে পুঁজির শক্তির কাছে অক্ষম হয়ে গড়ে। পুঁজিপতি যত ধনী হতে থাকবে শ্রমিক ততই গরিব হতে থাকবে। এ প্রক্রিয়ার স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখা যায় যে, শ্রমিক যা উৎপাদন করে তা তার কাছে একটি অপরিচিত বস্তু হিসেবে দেখা দেয়। শ্রমিকের কাছে শ্রম ফলল একটি ভিন্ন সত্তা অর্থাৎ অপরিচিত বস্তু। এই গণ্য একটি সার্বাতীম শক্তি। এর সাথে সে শ্রমিকের কোনো যোগ নেই। এভাবে শ্রমিক তার উৎপাদিত বস্তু হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। উৎপাদিত বস্তু হতে শ্রমিকের বিচ্ছিন্নতাকে বিচ্ছিন্নতাবোধ্যেই একটি প্রকার হিসেবে বিবেচ্য।
২. উৎপাদন কার্মকান্ড হতে শ্রমিকের বিচ্ছিন্নতা (labour is alienated from productive activities): উৎপাদিত বস্তু হতে বিচ্ছিন্নবোধের ফলে শ্রমিক উৎপাদন কার্য থেকেও নিজেকে বিচ্ছিন্ন মনে করে। কেননা উৎপাদিত বস্তু হচ্ছে উৎপাদন কার্যেরই ফসল । শ্রমিক যখন নিজেকে উৎপাদনের সাথে পরিচিত মনে করতে পারে না, তখন স্বভাবতই উৎপাদন কার্যের সাথেও শ্রমিক তার একান্ত অনুভব করে না। এর কয়েকটি কারণ রয়েছে, সেগুলো হলো-
প্রথমত, শ্রম শ্রমিকের কাছে একটা বাইরের জিনিস অর্থাৎ শ্রমের মধ্যে শ্রমিক কখনও আপন সত্তাকে অনুভব করতে পারে না। তাই তাঁর কাছে শ্রমকে বাইরের জিনিস বলেই মনে হয়।
দ্বিতীয়ত, মার্কসের মতে, এ ধরনের অনুভূতির মূল কারণ হলো পুঁজিপতির জন্য শ্রমিকের বাধ্যতামূলক শ্রম। শ্রমিকেরা খেয়ে বেঁচে থাকার কাজ করে এবং কাজ করতে বাধ্য হয়। কেননা এছাড়া শ্রমিকের আর কোনো উপায় নেই। পুঁজিবাদী সমাজে উৎপাদনের উৎসসমূহের মালিক হলো পুঁজিপতি। আর তাই শ্রমিক সে সমাজে কেবল শ্রম বিক্রি করে জীবনধারণ করতে পারে। শ্রমিকরা অর্থনৈতিক দিক থেকে সমাজের সর্বনিম্ন স্তরে অবস্থান করে। তাই মার্কস এদেরকে বলেছেন সর্বহারা।
তৃতীয়ত, শ্রমকে শ্রমিকের কাছে বাহ্যিক মনে হবার কারণ, শ্রম তার নিজস্ব কিছু। শ্রম দ্বারা উৎপাদিত পণ্যের সকল সুবিধা এ মালিক শ্রেনি একাই ভোগ করে। তাই শ্রমিকরা শ্রমকে বাইরের বস্তু বলে মনে করে থাকে।
৩. অন্যান্য মানুষের সাথে বিচ্ছিন্নতা (Labour is allenated from his fellow group): বিচ্ছিন্ন শ্রমের তৃতীয় ভাগ হলো এটি যেখানে মানুষ অন্য মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এ ধরনের বিচ্ছিন্নতার সূত্রপাত হয় উৎপাদিত বস্তুর ভোগ এবং মালিকানা হতে। এই ভোগ এবং মালিকানার ফলে পুঁজিপতি শ্রমিককে নিয়ন্ত্রণ করে। এই ভোগ এবং শোষণ থেকেই এ ধরনের বিচ্ছিন্নতার সূত্রপাত ঘটে।
মার্কসীয়দের মতে এই বিচ্ছিন্ন শ্রমের সামাজিক ঘটনা ঘটে তিন ভাবে। সেগুলো হলো।
ক. পুঁজি শক্তিও উৎপাদন এবং উৎপাদিত পণ্যের উপর রাজত্ব।
খ. সামাজিক শ্রম বিভক্তির বিরোধীরূপে।
গ. শ্রমিকের উপর স্বাধ্যতামূলক এবং সামাজিকভাবে স্বীকৃত প্রমের আদিপত্য।
উপসংহারঃ উপর্যুক্ত আলোচনার পরিশেষে বলা যায়, বিচ্ছিন্নতাবোদ সম্পর্কে ভালোচনা করতে গেলে মার্কসের মতসাদ সর্বাগ্রে বিদেয়িত। বিচ্ছিন্নতাবোধ সম্পর্কে মার্কসীয় মতবাদ মূলত শ্রমের বিচ্ছিন্নতা। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার নিরিখে মার্কস প্রমের যে বিচ্ছিন্নতা দেখিয়েছেন তা সমাজবিজ্ঞানের প্রত্যয় নিচ্ছিন্নতাবোধ যুদান গেয়ে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। মার্কস প্রম ও শ্রমিকের মধ্যকার বিচ্ছিন্নতা এবং এক্ষেত্রে পুঁজিপতিদের ভূমিকা বর্ণণা করেছেন।