সামন্তপ্রথা কী? ইউরোপীয় ও ভারতীয় সামন্তপ্রথার সাদৃশ্য ও বৈশাদৃশ্যগুলো আলোচনা কর।

সামন্তপ্রথার সংজ্ঞা দাও। ভারতীয় সামন্তপ্রথা কীভাবে ইউরোপীয়দের থেকে আলাদা তা আলোচনা কর।

ভূমিকাঃ পরিবর্তনশীলতা মানবসমাজের ধর্ম।বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী, নৃবিজ্ঞানী, সমাজের ক্রমবিবর্তনকে বিভিন্নভাবে ভাগ করেছেন। আর এ সামন্ততন্ত্রও কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সমাজ ও সভ্যতার বিকাশের হাত ধরেই সামন্ততন্ত্রের উৎপত্তি। সমাজবিকাশের একটা বিশেষ স্তরে ইউরোপে এক স্বতন্ত্র ধরনের আর্থসামাজিক এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থার আবির্ভাব ঘটে, যাকে বলা হয় সামন্তপ্রথা।

সামন্তপ্রথা কী? ইউরোপীয় ও ভারতীয় সামন্তপ্রথার সাদৃশ্য ও বৈশাদৃশ্য


সামন্তপ্রথা (Feudalism)

নবম শতকে পশ্চিম ইউরোপে কৃষি অর্থনীতির ভিত্তিতে যে সমাজ, সংস্কৃতি, প্রথা ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো গড়ে ওঠে তাকেই সামন্তপ্রথা নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। অন্যভাবে বলা যায় যে, মধ্যযুগে ইউরোপীয় ভূস্বামীগণ কর্তৃক চাষাবাদের জন্য বিশেষ শর্ত সাময়িক বা স্থায়ীভাবে ভূমিহীনদের মধ্যে ভূমি বন্দোবস্ত দেয়া প্রথাকে সামন্ততন্ত্র বলা হয়। এ নীতি অনুসারে যিনি ভূস্বামী তিনি লর্ড ও যারা বন্দোবস্ত নিলেন তারা হচ্ছে ভেসাল।


ইউরোপীয় সামন্তপ্রথা

ইউরোপীয় সামন্তপ্রথায় ভূমি মালিকানাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধরনের শ্রেণি সম্পর্কের সূচনা হয়, যাকে ভূমি বণ্টন ও রাজনৈতিক ক্ষমতার বিন্যাস হিসেবে ধরা হতো। শ্রেণিগুলো নিম্নরূপ ছিল।

রাজা> কাউন্ট >ব্যারন >ব্যারোনেট >ডিসকাউন্ট >নাইট। এখানে রাজাই সকল ভূমি ও ক্ষমতার উৎস। সামন্তপ্রথায় ভূমিদাসরা দাসদের চেয়ে অনেক স্বাধীন এবং কিছু অধিকার এ ভোগ করত। বিভিন্ন ধরনের মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণির উদ্ভব ও হয়েছিল। যেমন- একজন ভূস্বামী রাজার কাছ থেকে জমি এ পাচ্ছেন। তিনি নিজের জন্য কিছু রেখে বাকিটা অন্যদের মাঝে বণ্টন করতেন। এভাবে সামন্ত সমাজ ভূমিভিত্তিক উঁচু নিচু বিভিন্ন আস্তরে বিভক্ত ছিল। ইউরোপীয় সামন্তপ্রথার আরেক ধরনের আর্থসামাজিক বা উৎপাদন ব্যবস্থার নাম পাওয়া যায় তা হচ্ছে ম্যানর ব্যবস্থা। ম্যানর ব্যবস্থায় ম্যানর প্রধানের তত্ত্বাবধানে প্রজারা উৎপাদন কাজে নিয়োজিত হয় এবং এভাবে এক নতুন স্বনির্ভর সমাজের পত্তন করে।


ভারতীয় সামন্তপ্রথা

প্রকৃতপক্ষে ভূমি ব্যবস্থা, জলবায়ু, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রকৃতি, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো প্রভৃতি কারণে ভারতে ইউরোপের চেয়ে স্বতন্ত্র সামন্তপ্রথার পত্তন ঘটে। ভারতীয় সামন্তপ্রথার ভূমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা ছিল না। এ সমাজের শাসনক্ষমতা শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকারে উপর ন্যস্ত ছিল। জটিল আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা এখানে গড়ে ওঠেছিল। সম্পত্তিতে ব্যক্তিগত মালিকানা না থাকায় এখানে মালিকানার ভিত্তিতে কোনো অভিজাত শ্রেণি গড়ে ওঠেনি। সম্পত্তিতে ব্যক্তিগত মালিকানার পরিবর্তে রাষ্ট্রীয় মালিকানা ছিল তাই তিনি দান বা বেচাকেনা করতে পারতেন না। শুধু খাজনা আদায়ের অধিকার ছিল। তাদের নির্দিষ্ট এলাকায় খাজনা আদায়ের - অধিকার ছিল, তবে জমির বা সম্পত্তির মালিক হতে পারবেন না, না বরং রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতেন। ভূমিকে তিন ভাগে ভাগ করা হতো এবং এর ভিত্তিতে খাজনা আদায় করা হতো। ভূমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা না থাকায় প্রাচ্যের সামন্ততন্ত্র পুঁজিবাদের জন্ম দিতে ব্যর্থ হয়েছে। ভারতীয় সামন্তপ্রথার তিনটি শ্রেণির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। যথা-

১. কৃষক শ্রেণি,

২. খাজনা আদায়কারী শ্রেণি এবং

৩. রাষ্ট্র রাজা যারা প্রতিনিধিকারী।

ভারতীয় সামন্তপ্রথায় কোনো ম্যানর প্রথা গড়ে ওঠেনি এবং মৌলিক ভিত্তি ছিল স্বনির্ভর গ্রাম সম্প্রদায়, বর্ণনাশ্রম ইত্যাদি।


ইউরোপীয় এবং ভারতীয় সামন্ততন্ত্রের সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য আলোচনা

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সামন্ততন্ত্রের কিছু মিল থাকলেও সুস্পষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান। Max Weber, Karl Marx, উইটফোগেল এদের মতে, প্রাচ্যে সামন্ততন্ত্র পূর্ণ বিকশিত হতে পারেনি। ডি.ডি. কোসাম্বি বলেন, তিনটি বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে প্রাচ্যের সামন্ততন্ত্রকে পাশ্চাত্যের সামন্ততন্ত্র থেকে আলাদা করা যায়। যথা:

১. দাস প্রথা প্রসার,

২. গিল্ডের অনুপস্থিতি এবং

৩. সংগঠিত গির্জার প্রভাব।

আবার ম্যানর প্রথার উপর ভিত্তি করেও পার্থক্য নির্ণয় করা যায়। নিম্নে এ দু সমাজের সামন্ততন্ত্রের তুলনামূলক আলোচনা করা হলো:


১. রাজার ক্ষমতা: ইউরোপীয় সামন্তপ্রথার রাজা তার অধীনস্থ সকল ব্যক্তির এবং সকল জিনিসের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু ভারতে রাজা জমির মালিক ছিলেন না, বরং রাজা রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতেন। ইউরোপীয় রাজার তুলনায় ভারতীয় সামন্ততন্ত্র রাজা বেশি ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন কারণ ইউরোপীয় সামন্ততন্ত্রের রাজা সম্ভ্রান্ত রাজন্যের মতো।


২. দাসপ্রথা: ইউরোপ ও ভারতের দাসপ্রথার মধ্যে বিস্তর পার্থক্য ছিল। ইউরোপে দাসরা উৎপাদন যন্ত্রের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতো। তাদের শ্রমকে পুঁজি করেই উৎপাদন কার্যক্রম চলত। কিন্তু প্রাচ্যে দাসকে শুধু গৃহস্থালির কাজে ব্যবহার করা হতো। পাশ্চাত্যের মতো প্রাতিষ্ঠানিক দাসপ্রথা প্রাচ্যে ছিল না। ইউরোপে সামন্তপ্রভু ছাড়া আর কেউ দাস রাখতে পারতো না কিন্তু প্রাচ্যে বিত্তবানরাও দাস রাখতো।


৩. পুরোহিত শ্রেণি: ভারত এবং ইউরোপ উভয় সমাজেই পুরোহিতরা সম্ভ্রান্ত এবং অভিজাত শ্রেণির বলে গণ্য ছিল। ইউরোপের গির্জার অধীনে অনেক জমি ছিল। প্রাচ্যে ধর্মীয় কোনো প্রতিষ্ঠানের সাথে রাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব সংঘাতের সৃষ্টি হয়নি। কিন্তু পাশ্চাত্যে চার্চ বনাম রাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছিল। সমাজে পুরোহিতদের অনেক ক্ষমতা ছিল। মাঝে মাঝে রাজাকেও তাদের কাছে বশ্যতা স্বীকার করতে হতো।


৪. মালিকানার উপস্থিতি: ভারতে জমি কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত হতো। ভারতীয় সামন্ততন্ত্রে ব্যক্তিগত মালিকানা ছিল না। জমিদারগণ কেবল একটা এলাকার খাজনা আদায় করার অধিকার পেতেন। তাই উৎপাদন ব্যবস্থার উন্নতি হয়নি। অন্যদিকে ইউরোপে ব্যক্তিগত মালিকানা ছিলনা এবং শাসনব্যবস্থা নিজেদের মধ্যে থাকায় উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং উন্নয়ন লাভ করে।


৫. পুঁজিবাদ: অধ্যাপক নাজমুল করিম বলেন,

"European feudalism gave birth to capitalism, while Indian feudalism of its own accord failed to do so."

ভারতের স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম, কঠোর বর্ণাশ্রম, ভূমিতে ব্যক্তিগত মালিকানার অনুপস্থিতি, বাজার ব্যবস্থা সীমাবদ্ধতা, সীমিত মুদ্রা ব্যবস্থা ইত্যাদি কারণে ভারতের সামন্ততন্ত্রে পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটাতে পারেনি কিন্তু ইউরোপীয় সামন্ততন্ত্রের পতনের মাধ্যমে পুঁজিবাদের জন্ম হয়।


৬. পরিবার ও বর্ণপ্রথা: ভারতীয় সমাজ কাঠামোর উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো যৌথ পরিবার ব্যবস্থা। কিন্তু পাশ্চাত্যে একক পরিবার ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। আবার ভারতে কঠোর বর্ণপ্রথা প্রচলিত ছিল, যার দ্বারা ব্যক্তির পেশা, মর্যাদা ইত্যাদি নির্ধারিত হতো। যার জন্যে ভারতে ব্যবসায় বাণিজ্য পুঁজিবাদ ইত্যাদির বিকাশ ঘটাতে পারেনি। কিন্তু পাশ্চাত্যে এ ধরনের রীতি প্রচলিত ছিল না।


৭. বণিক শ্রেণি: ইউরোপে ব্যবসায়ী শ্রেণির সৃষ্টি হয়েছিল। তারা রাষ্ট্রীয় আইন কানুন দ্বারা পরিচালিত গিল্ড প্রথার । ব্যবসায় করতো। এ জন্যই ইউরোপীয় সামন্ততন্ত্র পুঁজিবাদের । জন্ম দিতে পেরেছিল। কিন্তু জাতিবর্ণ প্রথার দ্বারা পেশা নির্ধারিত হওয়ায় ভারতীয় সামন্ততন্ত্রে বণিক শ্রেণির সৃষ্টি হয়নি।


৮. গ্রামীণ সম্প্রদায়: ইউরোপ ও ভারতীয় সামন্ততন্ত্রের । পার্থক্যের প্রধান কারণ হলো ভারতীয় স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম সম্প্রদায়। ভারতীয় গ্রামীণ সম্প্রদায়ের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল এর স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনীতি। গ্রামের চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন হতো। তাই - উৎপাদিত দ্রব্য পণ্যে পরিণত হয়নি। অন্যদিকে, পাশ্চাত্যে অর্থনীতির মূল ভিত্তি ছিল ম্যানর। অধ্যাপক নাজমুল করিম বলেন, "ভারতীয় গ্রামীণ সম্প্রদায়ের চেয়ে ইউরোপীয় ম্যানর - ব্যবস্থা অনেক বেশি দুর্বল এবং অনেক কম স্থিতিশীল সংগঠন।"


৯. পানিসেচ ব্যবস্থা: কৃষি ছিল ভারতের অর্থনীতির মূল ভিত্তি। আর কৃষি পানিসেচের উপর নির্ভর করতো যা - কেন্দ্রীয়ভাবে রাষ্ট্র কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হতো। যার ফলে এখানে জাটিল - আমলাতন্ত্রের উদ্ভব হয় কিন্তু ইউরোপে কোনো ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় - নিয়ন্ত্রণ না থাকায় এরূপ আমলাতন্ত্রের বিকাশ ঘটেনি। উইটফোগেল প্রাচ্য সমাজব্যবস্থাকে পানি নির্ভর সমাজ, শাসনব্যবস্থাকে আমলাতন্ত্র এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে স্বৈরতন্ত্র বলে - অভিহিত করেছেন।


১০. শহরের বিকাশ: প্রাক ব্রিটিশ যুগে ভারতবর্ষের শহরগুলো ছিল মূলত সামন্ত শাসকদের আবাসস্থল। প্রশাসনিক কর্মস্থল, সামরিক ভিত্তি, তীর্থস্থান, বাণিজ্যিক কারণে প্রাচ্যে শহর গড়ে উঠেছিল। কিন্তু পাশ্চাত্যে ব্যবসায়ী সংঘ, ব্যবসায়, হস্তশিল্প এসব কারণে শহরের পত্তন হয়েছিল। আর শহরগুলো ব্যবসায় বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল বলে গণ্য হতো।


১১. কৃষক শ্রেণি: ইউরোপ ও ভারতের অর্থনীতিতে কৃষক । শ্রেণি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতো। ইউরোপে কৃষক শ্রেণি ভূমিদাস নামে পরিচিত ছিল। তারা বংশানুক্রমিক ভূমি চাষ ।এছাড়াও অন্যান্য কাজ করে দিতে বাধ্য ছিলেন। কিন্তু ভারতের তাদেরকে শুধু গ্রাম পঞ্চায়েত কে কর দিতে হতো।

১২. শ্রমিক শ্রেণি: ভারতবর্ষের শ্রমিকদেরকে জমি দেওয়া হতো না, তারা রাজস্ব বিভাগের নিম্নতম কর্মচারী ছিল। কিন্তু ইউরোপে শ্রমিকরা চাষযোগ্য জমি পেত।


উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, ইউরোপীয় ও ভারতীয় সামন্ততন্তের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য বিদ্যমান। মূলত প্রধান কারণ হলো ভৌগোলিক অবস্থানগত পার্থক্য। ভারতে ব্যক্তিমালিকানার অনুপস্থিতি, রাষ্ট্রভিত্তিক পানি সেচ এবং এর উপর ভিত্তি করে আমলাতন্ত্র, স্বনির্ভর গ্রাম সম্প্রদায় এসব কারণে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ধারার সামন্তপ্রথা ছিল। আর এ বৈশিষ্ট্যগুলো ইউরোপের সামন্ততন্ত্রে না থাকার জন্যেই পুঁজিবাদের জন্ম হয় আর প্রাচ্যে হয়নি। কিন্তু উভয় সমাজে ভূমিই ছিল প্রধান সম্পদ আর কৃষিই ছিল অর্থনৈতিক ভিত্তি।

No comments:

Post a Comment