সমাজতন্ত্রের নেতিবাচক ও ইতিবাচক প্রভাব আলোচনা কর
সমাজতন্ত্রের সুবিধা বা ইতিবাচক দিক (Positive side of socialism):
সমাজতন্ত্রের সুবিধাসমূহ নিম্নরুপ-
১. অর্থনৈতিক যুক্তি: সমাজতন্ত্রে ব্যক্তিগত মালিকানা না থাকায় শোষণ ও নির্যাতন সমাজে কম মাত্রায় বিদ্যমান থাকে। এখানে মানুষ অর্থনীতিতে সমতার ভিত্তিতে অংশগ্রহণ করে।
২. বৈজ্ঞানিক যুক্তি: সমাজতন্ত্রে শ্রেণি ধারণা না থাকায় এ মতবাদে বিশ্বাসীরা মনে করেন যে, ব্যক্তি শ্রেণিহীন সমাজব্যবস্থায় নিজস্ব গুণ ও যোগ্যতার বিকাশ ঘটাতে পারে। ব্যক্তি তার উপযোগী পরিবেশ গড়ে তুলতে পারে এবং নিজেকে সে অনুযায়ী পরিচালিত করতে পারে। যোগ্যতমদের টিকে থাকার অর্থনৈতিক যুক্তিকে এখানে অস্বীকার করা হয়।
৩. নৈতিক যুক্তি: সমাজতন্ত্রে ব্যক্তিমালিকানা না থাকায় মুনাফা লাভের কোনো সুযোগ নেই। ব্যক্তিকে মুনাফা লাভের জন্য অসদুপায় অবলম্বনের প্রয়োজন হয় না। সুতরাং ব্যক্তির নৈতিক চরিত্র এখানে উন্নতি লাভ করে।
৪. রাজনৈতিক যুক্তি: রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সকলের মসঅংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়। সকলে যে কোনো ধরনের কর্মে সমানভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে। সমাজতন্ত্রে ব্যক্তিগত মালিকানা না থাকায় এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতা থাকার কারণে সকলের আর্থিক অবস্থা সমান থাকে।
৫. মানবিক যুক্তি: সমাজতন্ত্রে মনন বিকাশে অন্যান্য যে কোনো ব্যবস্থার তুলনায় বেশি সুযোগ থাকে। এখানে সকলে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে সমান মর্যাদাবান হওয়ার ফলে মানবিক বিকাশ ঘটাতে পারে।
৬. দার্শনিক যুক্তি: সমাজের উন্নয়নের জন্য রাষ্ট্র সর্বদা বন্ধপরিকর। সমাজতন্ত্র সমাজের সকল মানুষের সুখ ও সমৃদ্ধির কথা বলে। সমাজতন্ত্র সমষ্টির কল্যাণ সাধনের কথা বলে এবং সমষ্টির কল্যাণ সাধিত হলে ব্যক্তির কল্যাণ সম্ভব।
৭. বাণিজ্যিক চক্র: সমাজতন্ত্রে পরিকল্পনা অনুযায়ী উৎপাদন করা হয়। ফলে অধিক উৎপাদন বা কম উৎপাদনের সমস্যা এখানে থাকে না। এভাবে বাণিজ্যিক চক্রের প্রভাব থেকে দূরে অবস্থান করা যায়।
৮. বেকারত্বের অবসান: রাষ্ট্র যোগ্য ব্যক্তিদের কাজের সুযোগ করে দেয়। সমাজতন্ত্রে ব্যক্তি যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ পায়। এভাবে সমাজতন্ত্রে বেকার সমস্যার অবসান ঘটে।
সমাজতন্ত্রের অসুবিধা বা নেতিবাচক দিক (Demerits or negative side of socialism):
সমাজতন্ত্রের নেতিবাচক বা বিপক্ষে যুক্তির যেসব অবতারণা ঘটানো হয় তার উল্লেখযোগ্য দিকসমূহ নিম্নরূপ:
১. ব্যক্তিস্বাধীনতার বিরোধী: ব্যক্তিগত স্বাধীনতাকে সমাজতন্ত্র মূল্যায়ন করে না। সমাজতন্ত্রে ব্যক্তির তুলনায় রাষ্ট্রকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। ব্যক্তির চিন্তা চেতনা সমাজে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে না।
২. উৎপাদন হ্রাস: সমাজতন্ত্রে ব্যক্তিগত মালিকানা না থাকায় ব্যক্তি উৎপাদনে মনোযোগী হয়ে উঠে না। ফলে উৎপাদন হ্রাস পায়।
৩. ন্যায় প্রতিষ্ঠা: সমাজতন্ত্রে সর্বদা ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হয় না। ন্যায়ের পাশাপাশি এখানে অন্যায়কেও প্রশ্রয় দেয়া হয়।
৪. আমলাতান্ত্রিক জটিলতা: অর্থনৈতিক কার্যাবলির জন্য রাষ্ট্রের উপর বেশি মাত্রায় নির্ভর করতে হয়। কেননা রাষ্ট্রই সফল। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পাদন করে। রাষ্ট্রকে এ জন্য অত্যধিক গুরুত্ব দেয়া হয়। এভাবে রাষ্ট্রের উপর অধিক নির্ভরশীলতা থেকে আমলাতন্ত্রের উদ্ভব ঘটে।
৫. স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতির অভাব: পুঁজিবাদে দ্রব্যর মূল্য নির্ধারণের মাধ্যমে চাহিদা ও যোগানের মধ্যে সামঞ্জস্যতা প্রতিষ্ঠা করা হয়। এভাবে সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টন নিশ্চিত করা হয়। কিন্তু সমাজতন্ত্রে এ ধরনের কোনো স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি নেই।
৬. ভোগের স্বাধীনতা না থাকা: রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে উৎপাদিত প্রব্যাদি বণ্টন হয় বিধায় সমাজতন্ত্রে ব্যক্তির ভোগের স্বাধীনতা। প্রতিষ্ঠিত হয় না। এভাবে ভোক্তার সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ণ হয়।
৭. বস্তুতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি: সমাজতন্ত্রে সবকিছুকে অর্থনীতির আলোকে বিচার করা হয়। সমাজতন্ত্রে মানুষের আবেগ, মানবিকতা, নৈতিকতার মূল্যায়ন করা হয় না। ফলে বস্তুতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ ঘটে।
৮. উদ্যোক্তার স্বাধীনতার অভাব: সমাজতন্ত্রে সবকিছু। রাষ্ট্রীয় মালিকানায় পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। ফলে ব্যক্তিগত উদ্যোগের অবকাশ থাকে না।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, পুঁজিবাদী অর্থনীতির কতকগুলো সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠার লক্ষ্যে সমাজতন্ত্রের উদ্ভব ঘটলেও পৃথিবীতে সমাজতন্ত্র বেশিদিন টিকে থাকতে পারেনি। মূলত সমাজতন্ত্রে ব্যক্তিগত মূল্যায়নহীনতা, বস্তুতান্ত্রিকতা ইত্যাদি কতকগুলো বিষয়ের পতনের জন্য দায়ী। পরিশেষে বলা যায়, সমাজতন্ত্র পুঁজিবাদ থেকে বিভিন্ন দিক থেকে আলাদা।