শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর আত্মজীবনী

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর আত্মজীবনী

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর আত্মজীবনী

ভূমিকা: বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক অমর নাম — শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর সাহিত্য যেন প্রতিধ্বনি তোলে গ্রামীণ বাঙালির হৃদয়ে, আবার শহুরে মানুষের মনের টানাপোড়েনেরও দর্পণ হয়ে ওঠে। প্রেম, সমাজ, আত্মত্যাগ ও বাস্তবতা—এসবই যেন মিশে থাকে তার লেখায়। আজকের এই ব্লগে আমরা জানব তাঁর জন্ম, মৃত্যু, পারিবারিক জীবন, শিক্ষাজীবন, সাহিত্যকর্ম ও স্থায়ী অবদান সম্পর্কে একটি পূর্ণাঙ্গ ও অনন্য আলোচনা।

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর আত্মজীবনী


🎂 জন্ম ও পারিবারিক পটভূমি

জন্ম: ১৫ই সেপ্টেম্বর, ১৮৭৬

জন্মস্থান: দেবানন্দপুর, হুগলি জেলা, ব্রিটিশ ভারত (বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ)

শরৎচন্দ্র জন্মগ্রহণ করেন এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে। তাঁর পিতার নাম ছিল মতিলাল চট্টোপাধ্যায় এবং মাতার নাম ভুবনমোহিনী দেবী। শরৎচন্দ্রের ডাকনাম ছিল “ন্যাঁড়া”। পিতৃসূত্রে কাঁচড়াপাড়ার মামুদপুর ও মাতৃসূত্রে হালিশহর ছিল তাঁর পারিবারিক শিকড়।


👦 বাল্যকাল ও শিক্ষাজীবন: 

শরৎচন্দ্রের শৈশব কেটেছে ভাগলপুর শহরে। তার বাবার আর্থিক দুরবস্থার কারণে পড়াশোনায় বেশ কিছু বাধা আসে।


* প্রথমে দেবানন্দপুরের পাঠশালায় প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন।

* পরে ভাগলপুরের দুর্গাচরণ বালক বিদ্যালয় এবং পরে ভাগলপুর জেলা স্কুলে পড়াশোনা করেন।

* অবশেষে তেজনারায়ণ জুবিলি কলেজিয়েট স্কুল থেকে ১৮৯৪ সালে এনট্রান্স পাশ করেন।

* অর্থাভাবে এফএ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারেননি।

এই সময়ই তিনি সাহিত্য চর্চা শুরু করেন, লিখেছিলেন 'কাশীনাথ’, ‘ব্রহ্মদৈত্য’ ইত্যাদি গল্প।


💍 ব্যক্তিগত জীবন ও বিবাহ: 

শরৎচন্দ্রের ব্যক্তিজীবন ছিল বর্ণময় এবং কিছুটা বেদনাদায়ক।

* প্রথম বিয়ে করেন শান্তি দেবী নামে এক ব্রাহ্মণ মিস্ত্রির কন্যাকে। তাঁদের এক পুত্রসন্তান জন্মায়, তবে রেঙ্গুনে প্লেগে আক্রান্ত হয়ে স্ত্রী ও পুত্র উভয়েই মৃত্যুবরণ করেন।

* পরবর্তীতে মোক্ষদা (পরে নাম রাখা হয় হিরন্ময়ী দেবী) নামে এক কিশোরীকে বিয়ে করেন। এই দাম্পত্য জীবন নিঃসন্তান ছিল।


💼 কর্মজীবন

জীবনের এক পর্যায়ে তিনি পাড়ি জমান রেঙ্গুন (বর্তমান ইয়াঙ্গুন)-এ। সেখানে বর্মা রেলওয়ে ও পাবলিক ওয়ার্কস বিভাগে কেরানির চাকরি করেন প্রায় দশ বছর। এরপর লেখালেখির প্রতি মনোনিবেশ করতে চেয়ে চাকরি ছেড়ে তিনি বাংলায় ফিরে আসেন।


✍️ সাহিত্যকর্ম ও বিখ্যাত উপন্যাস: 

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সাহিত্যকর্ম সমাজের বাস্তবতা, নারীর অবস্থান, প্রেম-বিরহ, দুর্বলতা ও সংগ্রামের এক অসাধারণ প্রতিচ্ছবি। তার উপন্যাসগুলো পড়লে মনে হয় যেন সে সময়ের বাংলার জীবনযাপন চোখের সামনে ভেসে উঠছে।

📚 উল্লেখযোগ্য উপন্যাস ও গল্পসমূহ:

*দেবদাস (১৯১৭)

*পরিণীতা (১৯১৪)

*বড়দিদি (১৯১৩)

*চরিত্রহীন (১৯১৭)

*শ্রীকান্ত (১৯১৭–১৯৩৩)

*দত্তা (১৯১৮)

*পথের দাবী (১৯২৬)

*শেষ প্রশ্ন (১৯৩১)

*গৃহদাহ, পল্লীসমাজ, চন্দ্রনাথ, রাজলক্ষ্মী-শ্রীকান্ত প্রভৃতি


🔎 কবিতা ও প্রবন্ধ: যদিও তিনি মূলত কথাসাহিত্যিক, তবুও তাঁর কিছু গল্প ও সংলাপ কবিতার মতোই ছন্দবদ্ধ ও হৃদয়গ্রাহী।


🎬 সাহিত্যকর্মের চলচ্চিত্রায়ন: 

শরৎচন্দ্রের উপন্যাসগুলোকে ভিত্তি করে প্রায় ৫০টিরও বেশি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। সবচেয়ে আলোচিত হলো 'দেবদাস', যেটি বাংলা, হিন্দি ও তেলুগু ভাষায় একাধিকবার নির্মিত হয়েছে।

* অভিনেতা: প্রমথেশ বড়ুয়া, দিলীপ কুমার, শাহরুখ খান

* অভিনেত্রী: কানন দেবী, সুচিত্রা সেন, মাধুরী দীক্ষিত, ঐশ্বর্য রাই

অন্যান্য চলচ্চিত্র:

* বড়দিদি

* চন্দ্রনাথ

* পরিণীতা

* দত্তা

* স্বামী

* ছোটি বহু (বিন্দুর ছেলে অবলম্বনে)

* তুমহারি পাখি (নববিধান অবলম্বনে)


🏆 সম্মাননা ও পুরস্কার

*কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়: ১৯২৩ সালে *জগত্তারিণী স্বর্ণপদক* প্রদান

*ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: ১৯৩৬ সালে *ডি.লিট উপাধি*

*ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড: ১৯৭৭ সালে ‘স্বামী’ সিনেমার জন্য সেরা লেখক


⚰️ মৃত্যু

তারিখ: ১৬ই জানুয়ারি, ১৯৩৮।

স্থান: কলকাতা

শরৎচন্দ্র তার জীবনের শেষ দিনগুলো কাটিয়েছেন হাওড়ার সামতাবেড় গ্রামে। তাঁর যকৃতের ক্যান্সার ধরা পড়ে এবং অস্ত্রোপচারের পরও আর সুস্থ হননি। তাঁর মৃত্যুতে বাংলা সাহিত্য হারিয়েছিল এক অদ্বিতীয় কথাসাহিত্যিককে।


📌 উপসংহার: 

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় শুধু একজন সাহিত্যিক নন, তিনি বাংলা সাহিত্যের এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী কণ্ঠস্বর। তাঁর সাহিত্য আজও পাঠকের হৃদয় জয় করে চলছে। গ্রামীণ সমাজ, নারীজীবন, সামাজিক অনুশাসন আর মানবিক টানাপোড়েন — সবকিছুই তিনি তুলে ধরেছেন সহজ কিন্তু প্রাঞ্জল ভাষায়।

আজকের এই ডিজিটাল যুগেও শরৎচন্দ্রের লেখা আমাদের শেখায় জীবন, প্রেম, দায়িত্ব আর প্রতিকূলতাকে জয় করার দীক্ষা।

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post