কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের সুবিধা গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তাসমূহ লিখ

কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের সুবিধা, গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা


ভূমিকা:- রাষ্ট্রের মূল উদ্দেশ্য শুধু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করা নয়; বরং নাগরিকের আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, তাদের মৌলিক অধিকার রক্ষা এবং মানবিক জীবন যাপনের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করাও রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এই বিস্তৃত দায়িত্ব পালনের ধারণা থেকেই ‘কল্যাণমূলক রাষ্ট্র’ (Welfare State) ধারণার জন্ম। কল্যাণমূলক রাষ্ট্র এমন এক রাষ্ট্রব্যবস্থা, যেখানে সরকারের প্রধান কর্তব্য হলো নাগরিকের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, সামাজিক নিরাপত্তা, ন্যায়বিচার এবং সর্বোপরি মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনের নিশ্চয়তা প্রদান করা। আধুনিক বিশ্বে এই ধারণাটি উন্নয়নের ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের সুবিধা গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তাসমূহ লিখ

বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশ উন্নয়নের কাঠামো তৈরি করতে এবং দারিদ্র্য কমাতে কল্যাণমূলক রাষ্ট্র ব্যবস্থার বাস্তবায়নের প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছে। কারণ, অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করা, সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এবং মানবসম্পদ উন্নয়নে কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের ভূমিকা অপরিসীম।


কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের সুবিধা

১. সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে:

কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো সামাজিক নিরাপত্তার জাল বিস্তার। এই ব্যবস্থায় বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর সহায়তা, খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচি ইত্যাদির মাধ্যমে সমাজের দুর্বল শ্রেণিকে সহায়তা দেওয়া হয়।
এতে তারা আর্থিক দুরবস্থায় না পড়ে সমাজে টিকে থাকার সক্ষমতা অর্জন করে।

২. দারিদ্র্য হ্রাস করে:

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, যে দেশ যত বেশি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বিনিয়োগ করে, সে দেশে দারিদ্র্যের হার তত কমে। কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে শিক্ষা-চিকিৎসা সাশ্রয়ী হওয়া, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, সামাজিক ভাতা এসবের ফলে মানুষের আয়-ব্যয় সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় এবং দারিদ্র্য কমে।

৩. স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করে:

একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্র নাগরিকদের জন্য মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করে। সরকারি হাসপাতালে কম খরচে চিকিৎসা, বিনামূল্যে টিকা, মাতৃস্বাস্থ্য কর্মসূচি এসবই সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নত করে। স্বাস্থ্য খাতে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি পেলে মানুষের আয়ুষ্কালও বৃদ্ধি পায়।

৪. সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করে:

শিক্ষা হলো উন্নয়নের ভিত্তি। কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে সরকারি পর্যায়ে বিনামূল্যে বা স্বল্প খরচে শিক্ষা প্রদান করা হয়। বৃত্তি, উপবৃত্তি, শিক্ষা উপকরণ বিতরণ, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ইত্যাদির মাধ্যমে সমাজে শিক্ষার বিস্তার ঘটে। ফলে শিক্ষিত জনশক্তি তৈরি হয়, যা দেশকে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে নেয়।

৫. কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করে:

রাষ্ট্র যখন অবকাঠামো, কৃষি, শিল্পায়ন ও প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ করে তখন নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। কর্মসংস্থান বৃদ্ধি মানেই জনগণের আয় বৃদ্ধি, ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে সরকার উদ্যোক্তা তৈরিতেও সহায়তা করে, যার ফলাফল দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক উন্নয়ন।

৬. সামাজিক বৈষম্য কমায়:

অসমতা সমাজে অশান্তি তৈরি করে। কল্যাণমূলক রাষ্ট্র করনীতি, ভর্তুকি, সামাজিক নিরাপত্তা ও উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে ধনী-দরিদ্র বৈষম্য হ্রাস করে। ফলে সমাজে সমতা ও স্থিতিশীলতা বজায় থাকে।

৭. মানবাধিকারের সুরক্ষা দেয়:

স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসস্থান, সামাজিক নিরাপত্তা এসবই মানুষের মৌলিক অধিকার। কল্যাণমূলক রাষ্ট্র এসব অধিকার রক্ষায় দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে। এর ফলে নাগরিকের মধ্যে রাষ্ট্রের প্রতি আস্থা বাড়ে এবং রাষ্ট্রীয় ঐক্য শক্তিশালী হয়।

৮। দুর্যোগ মোকাবিলায় সহায়তা:

কল্যাণমূলক রাষ্ট্র প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অর্থনৈতিক মন্দার সময় নাগরিকদের দ্রুত সহায়তা প্রদান করে। যেমন খাদ্য ও নগদ সহায়তা, জরুরি চিকিৎসা।

৯। সামাজিক সম্প্রীতি বৃদ্ধি:

বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি এবং ভর্তুকির মাধ্যমে রাষ্ট্র নাগরিকদের মধ্যে সমবেদনা ও সহযোগিতার মনোভাব গড়ে তোলে।


কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের গুরুত্ব

১. সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকে:

দারিদ্র্য, বেকারত্ব এবং বৈষম্য কমে গেলে সমাজে অপরাধ, সন্ত্রাস, অস্থিতিশীলতা কমে যায়। কল্যাণমূলক রাষ্ট্র মানুষকে সুযোগ দেয়, যা তাদের হতাশা কমায় এবং সামাজিক শান্তি আনে।

২. মানবসম্পদ উন্নয়নে ভূমিকা রাখে:

সুস্থ, শিক্ষিত ও দক্ষ জনশক্তি হলো দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ।
কল্যাণমূলক রাষ্ট্র শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে বিনিয়োগ করে মানবসম্পদ উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখে, যা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকতে সহায়তা করে।

৩. গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে:

যে দেশে নাগরিকেরা মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারে, সে দেশেই গণতন্ত্র টিকে থাকে। কল্যাণমূলক রাষ্ট্র মানুষের জীবনে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে, ফলে তারা রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে উৎসাহিত হয়।

৪. করদাতার দেশপ্রেম ও অংশগ্রহণ বাড়ায়:

যখন মানুষ দেখে যে তাদের করের অর্থ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো ও সামাজিক নিরাপত্তায় ব্যয় হচ্ছে, তখন কর প্রদানে তাদের আগ্রহ বাড়ে।
এতে রাষ্ট্রের আয় বৃদ্ধি পায় এবং উন্নয়ন আরও গতিশীল হয়।

৫. সংকট মোকাবিলায় সহায়তা করে:

মহামারি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অর্থনৈতিক মন্দার সময় কল্যাণমূলক রাষ্ট্র নাগরিকদের পাশে দাঁড়াতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে খাদ্য সহায়তা, নগদ ভাতা, স্বাস্থ্যসেবা প্রদান মানুষের জীবন বাঁচায় এবং তাদের অর্থনৈতিক ধ্বংস থেকে রক্ষা করে।

৬। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে:

নাগরিকদের মৌলিক চাহিদা পূরণের মাধ্যমে তারা রাষ্ট্রের প্রতি আস্থা অর্জন করে এবং রাজনীতি ও প্রশাসনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে।

৭। দেশের আন্তর্জাতিক মর্যাদা বৃদ্ধি পায়:

কল্যাণমূলক রাষ্ট্র সামাজিক নিরাপত্তা, শিক্ষার প্রসার ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশের সুনাম বৃদ্ধি করে

৮। সামাজিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করে:

কল্যাণমূলক রাষ্ট্র সকল নাগরিককে, বিশেষ করে প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে সমাজের মূলধারায় যুক্ত করে। এটি সাম্য ও ন্যায়বিচারের পরিবেশ তৈরি করে।

৯। প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করে:

কল্যাণমূলক রাষ্ট্র শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে বিনিয়োগের মাধ্যমে নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ ও উদ্ভাবনের মানসিকতা তৈরি করে, যা দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।


কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা

১. দেশের উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য:

বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এখনও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও বৈষম্য রয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য কল্যাণমূলক রাষ্ট্র ব্যবস্থা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এটি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDGs) অর্জনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

২. প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষায় জরুরি:

হিজড়া, আদিবাসী, প্রতিবন্ধী, সুবিধাবঞ্চিত শিশু, দরিদ্র নারী এদের উন্নয়নে রাষ্ট্রীয় সহায়তা ছাড়া অগ্রগতি সম্ভব নয়।
কল্যাণমূলক রাষ্ট্র তাদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করে সমাজের মূলধারায় যুক্ত হওয়ার সুযোগ দেয়।

৩. দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ভিত্তি:

কল্যাণমূলক রাষ্ট্র তাৎক্ষণিক সাহায্য নয়; বরং শিক্ষা-স্বাস্থ্য, প্রযুক্তি, দক্ষতা উন্নয়ন, সামাজিক নিরাপত্তা সবকিছুর মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের ভিত্তি তৈরি করে।
এ ধরনের বিনিয়োগ ভবিষ্যতে রাষ্ট্রকে আত্মনির্ভরশীল করে তোলে।

৪. বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য প্রয়োজন:

একবিংশ শতাব্দী হলো জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির যুগ। এখানে টিকে থাকতে হলে দক্ষ, সুস্থ ও শিক্ষিত নাগরিক প্রয়োজন। সেই প্রেক্ষিতে কল্যাণমূলক রাষ্ট্র ছাড়া উন্নত জাতি হওয়া সম্ভব নয়।

৫. ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনে প্রয়োজন:

সমাজের সকলে যদি সমান সুযোগ না পায়, তবে ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র গঠন করা সম্ভব নয়।

৬। যুবসমাজের ক্ষমতায়ন:

শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার মাধ্যমে কল্যাণমূলক রাষ্ট্র যুবসমাজকে দক্ষ ও আত্মনির্ভর করে তোলে।

৭। সামাজিক বৈষম্য ও বঞ্চনা হ্রাস:

প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ সহায়তা এবং সুযোগ প্রদান করে কল্যাণমূলক রাষ্ট্র সমাজে সমতা ও ন্যায়ের পরিবেশ বজায় রাখে।


কল্যাণমূলক রাষ্ট্র নিশ্চিত করে
সবার জন্য শিক্ষা
সবার জন্য চিকিৎসা
সবার জন্য কর্মসংস্থান
সবার জন্য ন্যায়বিচার
এর ফলে সমাজে সমান সুযোগ সৃষ্টি হয়।

কল্যাণমূলক রাষ্ট্র শুধু একটি রাজনৈতিক ধারণা নয়, বরং একটি মানবিক রাষ্ট্রব্যবস্থা যেখানে মানুষের জীবন, মর্যাদা ও নিরাপত্তা সর্বোচ্চ গুরুত্ব পায়। আধুনিক সভ্য রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকতে হলে এবং টেকসই উন্নয়ন অর্জন করতে হলে কল্যাণমূলক রাষ্ট্র ব্যবস্থা অপরিহার্য।
এ ধরনের রাষ্ট্র মানুষের উপর বিনিয়োগ করে, যার ফলাফল ভবিষ্যতে বহুগুণে ফিরে আসে সমাজ ও অর্থনীতির উন্নতির মাধ্যমে।
অতএব, কল্যাণমূলক রাষ্ট্র শুধু রাষ্ট্রের দায়িত্ব নয়; এটি জাতির অগ্রগতির অন্যতম প্রধান শর্ত। সমাজে বৈষম্য দূর করে মানবিক ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

No comments:

Post a Comment